বাহারুল আলম
যুক্তরাষ্ট্রে বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কাল ‘হলিডে সিজন’ হিসাবে পরিচিত। যার রেশ নতুন বছরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত চালু থাকে। এ সময়ে হ্যালোইন, থ্যাঙ্কস গিভিং, খৃষ্টমাস ও নিউ ইয়ার্স ডে’র মতো দিন ও উৎসবগুলো পালিত হয়ে থাকে। বহু বাড়িঘর বর্ণময় আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়। বহু মানুষ নিজের আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও একসাথে ডিনার টেবিলে বসে খাওয়ার জন্য দূর-দূরান্তে ছুটে যান। তথ্য মতে, প্রতি বছর এ সময় কমবেশি ৫ কোটি মানুষ এ উদ্দেশ্যে ট্রাভেল করে থাকেন। দাতব্য কাজে অর্থ ব্যয়ের কারণে এ সময়টি ‘সিজন অব গিভিং’ নামেও পরিচিত।
নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে একটি ডিনারে অংশ নেয়ার জন্য আমি সপরিবারে নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় যাই। সেখানে আমাদের বর্ধিত পরিবারের প্রায় সবাই হাজির ছিলেন। রাজনীতি, ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলাপের এক পর্যায়ে চ্যারিটির প্রসঙ্গ উঠলে আমার এক আত্মীয়, সাইফ, জানায় সে ঢাকায় তাদের বাসায় দীর্ঘদিনের গৃহকর্মীর মেয়েকে তার পড়াশোনার জন্য প্রতি মাসে ২০ হাজার বাংলাদেশী টাকা দিয়ে থাকে। মেয়েটি বর্তমানে মানিকগঞ্জের কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তার অন্যান্য ভাইবোন এবং আমাদের এক খালু, তাজু মোহাম্মদ মিয়াও, বাংলাদেশে নানাজনকে অনুরূপ সাহায্য-সহায়তা করেন বলে জানান। সমাজের কম ভাগ্যবান দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের প্রতি তাদের এহেন কর্মকাণ্ডের কথা শুনে অনেক প্রীত হলাম। তাদের সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ।
চ্যারিটি প্রসঙ্গে আলোচনায় অবধারিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের দু’জন ব্যতিক্রমী কিংবদন্তি পরোপকারী (Philanthropist) মানুষের কথা উঠে এলো। এদের একজন বিল গেটস এবং অপরজন ওয়ারেন বাফেট।
বিল গেটস একজন মার্কিন ধণাঢ্য ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারী। যিনি তার এসব পরিচয়কে ছাপিয়ে দুনিয়াজোড়া সুখ্যাতি অর্জন করেছেন একজন অসাধারণ মানব হিতৈষী হিসাবে। তিনি সফট্ওয়ার-জায়ান্ট মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। অন্য সহ-প্রতিষ্ঠাতা হলেন তার শৈশবের বন্ধু পল অ্যালেন।
বিল গেটস বিভিন্ন সময়ে এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, সিইও এবং চিফ সফটওয়ার আর্কিটেক্ট হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি ৭০ ও ৮০’র দশকের মাইক্রো কম্পিউটার বিপ্লবের প্রধান রূপকার।
মাইক্রোসফট ছাড়াও তিনি ক্যাসকেড ইনভেস্টমেন্ট, টেরা পাওয়ার, ব্রেকথ্রু এনার্জিসহ বহু বিজনেস এন্টারপ্রাইজের প্রতিষ্ঠাতা। বিল গেটস বিশ্বের প্রথম পার্সোনাল কম্পিউটার অলটেয়ারের প্রোগ্রামিং ভাষা BASIC রচনা করে সর্বপ্রথম পার্সোনাল কম্পিউটার যুগের সূচনা করেন। সে সময়, এমআইটি, ক্যালটেক, স্ট্যানফোর্ড, আইবিএম, জেরক্সসহ বহু প্রতিষ্ঠান ও স্কুলে কম্পিউটার সায়েন্স ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে অনেক দক্ষ মেধাবী ছাত্র ও জনশক্তি থাকলেও তাদের কেউই তার পূর্বে এ কাজটি করে উঠতে পারেননি, যা বিল গেটসের অসাধারণ প্রতিভার পরিচয়বহ। এ কাজটি সম্পন্ন করার জন্য বিল গেটস হার্ভার্ড স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ না করে (Drop Out) দিনরাত কম্পিউটার কোড রচনায় সব উদ্যাম নিয়োজিত করেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে পার্সোনাল কম্পিউটার ঘরে ঘরে ডেস্কে ডেস্কে ছড়িয়ে পড়ে।
মাইক্রোসফট একটি অত্যন্ত সফল কোম্পানিতে পরিণত হলে তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলে ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিনি দুনিয়া থেকে ম্যালোরিয়া, এইডস, পোলিও দূরীকরণ, উন্নয়ন, ওয়াটার রিসাইক্লিনিং, শিক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করেন। ২০১০ সালে তিনি Giving Pledge নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে বিশ্বের বহু ধনাঢ্য ব্যক্তি তাদের অর্থবিত্তের অর্ধেকেরও বেশি দাতব্য কাজে ব্যয়ের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন। হার্ভার্ডে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, Melinda and for me, the challenge is the same, how we do the most good for the greatest number of people with the resources we have.
বিল গেটস বিপুল অংকের অর্থ-বহু দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা কর্মসূচিতে দান করেছেন। তথ্যমতে, বর্তমানে তার অর্থবিত্তের পরিমাণ ১৩৪ বিলিয়ন ডলার, যা তাকে বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ ধনী ব্যক্তির মর্যাদা দিয়েছে।
এবারে বলি অপর এক অসাধারণ মানব হিতৈষী ওয়ারেন বাফেটের কথা। তিনিও একজন শীর্ষ ধনী, ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী। দাতব্য কাজে তার অবদানের জন্য তিনিও একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। ওয়ারেন বাফেট বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ হোল্ডিং কোম্পানি বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের চেয়ারম্যান ও সিইও। রিয়েল এস্টেট ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান হিসাবে এটি একটি অত্যন্ত সফল কোম্পানি। নেব্রাঙ্কায় জন্মগ্রহণকারী ওয়ারেন বাফেট তরুণ বয়স থেকেই ব্যবসা ও বিনিয়োগে আগ্রহী হন। তিনি নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়, পেনস্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের হোয়ার্টন বিজনেস স্কুল ও নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিজনেস স্কুলে লেখাপড়া করেন। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত the Giving Pledge সংগঠনের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি চটকদার টেক কোম্পানির স্টকের পরিবর্তে ট্রাডিশনাল বিভিন্ন স্টক, যেমন, আইবিএম, অ্যাপেল, হোমডিপো, ব্যাংক অফ আমেরিকা, কোকাকোলা, শেভরন ইত্যাদি কোম্পানির স্টকে বিনিয়োগ করে বিরাট অংকের ডিভিডেন্ট লাভের মাধ্যমে বিত্তবান হন। তার অর্থবিত্তের একটি বড় অংশ বিল গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দাতব্য কাজে ব্যয় করেন। জানা যায়, ২০২৩ সাল নাগাদ দাতব্য কজে তিনি কমবেশি ৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন। বর্তমানে তার অর্থবিত্তের পরিমাণ ১১৮ বিলিয়ন ডলার, যা তাকে বিশ্বের সপ্তম শীর্ষ ধনী ব্যক্তির মর্যাদা দিয়েছে। তিনি তার অর্থবিত্তের একটি ক্ষুদ্র অংশ তার সন্তানদের দিয়েছেন।
এ সম্পর্কে তার মন্তব্য হলো, I want to give my kids just enough so that they wood feel they could do anything, but not so much that would feel like doing nothing।
বই কিনে যেমন কেউ দরিদ্র হয় না, দানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। নাগরিক অধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছেন, জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে- আপনি অন্যের জন্য কী করেছেন?
নিজের সামান্য কিছু দিয়ে অন্যের জন্য কিছু করতে পারার মধ্যে যে আনন্দ ও তৃপ্তি রয়েছে, তার কোনো তুলনা হয় না। এই প্রেক্ষাপটে আমরা সবাই যদি যে যার অবস্থান থেকে যার যার সাধ্যমতো সমাজের দুর্বল ও কম ভাগ্যবান মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করি, তাহলে তা সমাজকে উন্নত ও প্রাণবন্ত করে তুলতে বিরাট ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।
লেখক : কলামিস্ট।