কামরুন আক্তার
সখিনা বিবির এই উন্নত দেশে আসার মাত্র ছয় মাস শেষ হলো। এখানে এসে সে একটি হোঁচট খেল। তার স্বামী সবকিছুকে এমনভাবে তার কাছে তুলে ধরে, যেন সবকিছু করা কঠিন কাজ। এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না, চিৎকার করে বা উচ্চস্বরে কথা বলা যাবে না। প্রতিবেশী বলতে সবাই ভিন্ন দেশি, সুতরাং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যাবে না। যা করার সব ঘরে থেকে করতে হবে। ঘরে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে গেলে মুভি দেখবে, আর কথা বলবে দেশের আপনজনদের সঙ্গে।
সখিনা বিবি দশম শ্রেণির ছাত্রী, বিয়ের কারণে আর লেখাপড়া করা হয়নি। কত স্বপ্ন দেখেছে এই উন্নত দেশকে নিয়ে। সে তো কেবল স্বপ্নই দেখত কিন্তু গ্রামের আশপাশের লোকে নানা রকম প্রশ্ন করত তার বাবা-মাকে, কবে যাবে?
এখনো কেন কাগজ আসে না? আর কত দিন? এত সুন্দর একটি মেয়েকে আপনারা কিনা বুড়ো লোকটির হাতে তুলে দিলেন। এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর সখিনার মা দিতে পারত না, কারণ এই সংসারে দাপট ছিল তার স্বামীর। স্বামী জানিয়েছে, হালিমা বিবিকে কে কী বলে, তা নিয়ে আমি কেয়ার করি না বরং এমন এক সময় আসবে, আমরা দুজনই উন্নত দেশে পাড়ি জমাব, তখন দেখবে কত মানুষ আসবে তোমাকে দেখতে।
পড়ন্ত দুপুরে শুয়ে শুয়ে সখিনা এসব অতীত নিয়ে ভাবে আর কাঁদে। ছয় মাস যেতেই সখিনা অনেক কিছু আঁচ করতে পেরেছে। এটা এক বন্দিখানা। অনেক কাজ করার বিনিময়ে কেবল মেলে তিনবেলার খাবার। তার স্বামী কী চাকরি করে, তা জিজ্ঞাসা করার সাহস তার নেই। ঘরে প্রবেশ করেই বলবে, ‘খাবার চাই’। না আছে ভালোবাসার কথা, রসিকতা, কোথাও নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব। তার পরই সে গভীর ঘুমে অচেতন।
ছুটির দিনে সখিনা অনেক সাহস করে একটি প্রশ্ন করে বসল তার স্বামীকে। প্রশ্ন শুনে স্বামী তারেক স্তব্ধ।
‘এই সংবাদ তুমি কার থেকে জানলে?’
সখিনা মুচকি হেসে বলল, ‘কেন, ইউটিউব হতে জেনেছি। লিটল বাংলাদেশ এর মানে কী? তোমাদের এত উন্নত দেশের কোনো এক এলাকার নামকরণ করা হয় Little Bangladesh আর সেখানে এমন কিছু নেই যে বাংলাদেশ হতে না আসে।
‘এত খবর জানো তুমি! এত হাসছ কেন?’
‘আমি কি মিথ্যা বলেছি?’
‘না না, তুমি কেন মিথ্যা বলবে, তোমাকে আমি সময় হলেই সেখানে নিয়ে যাব।’
সখিনা বিবির আর সময় কাটতে চায় না, সে সময় কবে হবে? আজ সোমবার, বেলা প্রায় শেষের দিকে। তারেককে অসময়ে বাসায় আসতে দেখে সখিনা বিবি অবাক। ছয় মাসে কখনো তারেককে এ সময়ে আসতে দেখেনি। প্রশ্ন করে বসল, ‘কী তোমার শরীর খারাপ? অসময়ে বাসায় এলে যে!’
‘কেন, ভুলে গেলে! তোমাকে নিয়ে আজ লিটল বাংলাদেশে যাব। তাই কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই চলে এলাম, তুমি তৈরি হয়ে নাও। আজ ষোলোই ডিসেম্বর। সুতরাং সেখানে গেলেই তুমি বিজয়ের যে আনন্দ, তা উপলব্ধি করতে পারবে। আর উপভোগ করবে দেশের বিজয় দিবসের আনন্দ।’
স্বামীর কথা শুনে সখিনার আর আনন্দ ধরে না। মনে পড়ে গেল তার হারানো অতীতকে। কত বার গিয়েছে বিজয়ের মেলায়, কত কিছু কিনেছে অথচ আজ সে সেই অতীতকে ভুলতে বসেছে।
স্বামী তাকে জানাল, যা খাওয়ার একসঙ্গে লিটল বাংলাদেশে গিয়ে খাব।
আজ সখিনা অনেক খুশি। সুন্দর করে সাজল, কারণ আজ দেশের বিজয়ের আনন্দের সঙ্গে তার আনন্দ মিলে একাকার হয়ে গেল। দেরি না করে অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি হতে লাগল।
বসে বসে তারেক তাকে দেখছে। বুড়ো বয়সেও সে এত সুন্দরী বউ পেল! বিড়বিড় করে বলল, ‘আমেরিকা বলে কথা! হুমায়ূন আহমেদও তো এ বয়সেই কুমারী ও সুন্দরী বউ সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি করেছিলেন লেখকের সুনামের আদলে আর সে জোগাড় করল উন্নত দেশের আদলে। তারেক ছিল হুমায়ূন আহমেদের অন্ধভক্ত। হুমায়ূন আহমদের কোনো গল্প-উপন্যাস সে বাদ রাখেনি। বেলায় বেলায় তার বয়স এখন পড়ন্ত।
হঠাৎ সখিনার প্রশ্ন। সে সচেতন হলো, ‘চলো আর দেরি নয়, রাত হয়ে যাচ্ছে।’ প্রথমে বাস, তারপর ট্রেন। সখিনা লক্ষ করল, কেউ কোনো টুঁ শব্দটি করছে না তবে সবাই মাথা নিচু করে মোবাইলের ধ্যানে মগ্ন। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখছে কী সুন্দর এ দেশ, যেন কেউ নিজ হাতে সাজিয়ে রেখেছে। কত রং-বেরঙের গাড়ি, আর এখানকার মেয়েরা কী সুন্দর! তবে তাদের পোশাক দেখে সখিনা অনেক লজ্জা পেল। তার মনে হলো, ওসব মেয়ে বুঝি পাজামা পরে আসতে ভুলে গেছে। আহারে! ওরা কত ব্যস্ত, নিজেই ভুলে যায় সে কী করছে? তখন তার স্বামীর কথা মনে পড়ল। ভাবল সবাই বুঝি কাজপাগল, কেবলই তারা কাজের পেছনে ছুটে ভুলে যায় তার বউ-সন্তানদের। পেছন থেকে তারেকের ডাকে চিন্তায় ছেদ পড়ল, ‘কী হলো, নামবে না?’ জি আচ্ছা, উত্তর দিল সখিনা।
তারেক নেমে কিছুক্ষণ একটি সাইনবোর্ডের নিচে দাঁড়াল আর উপরের দিকে তাকিয়ে সখিনাকে বলল, ‘উপরের দিকে তাকাও, পড়তে পারছ কী লেখা সাইনবোর্ডে?’
‘জি পড়তে পারছি, লেখা আছে Little Bangladesh.’
তারেক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল, ‘তুমি এখন তোমার সোনার বাংলাদেশে’, যা ইচ্ছা সে অনুসারে তুমি কেনাকাটা করতে পারবে আর শুঁটকি ভর্তা হতে শুরু করে মুগ ডালের স্যুপও খেতে পারবে। আচ্ছা সখিনা, তুমি ঠিক এখানে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখতে থাকো। এখান হতে নড়বে না। কারণ, এটা আমেরিকা! সরে গেলে আমি যেমন তোমাকে খুঁজে পাব না আর তুমিও আমাকে না। আমি কেবল ওষুধটা পিকআপ করে আনব।’
তারেক চলে গেল। অনেকক্ষণ সখিনা দাঁড়িয়ে কত কিছু দেখল। হরেক রকম মানুষ ও মহিলা। চারদিকে কেবল সবাই ছুটছে, কী কারণে তার জানা নেই। তবে সে অবাক হলো সবার মুখে বাংলা ভাষা। কত জনের কত কথা কিছু বোঝা যায়, কিছু না। অনেকক্ষণ পার হয়ে গেল। প্রচণ্ড পানির পিপাসা লেগেছে। সে এক বাঙালি মহিলাকে প্রশ্ন করল, ‘আপা, আমি পানি পাব কোথায়?’
মহিলাটির প্রশ্ন, ‘এ কথার মানে কী? আপনি কি নতুন?’
‘জি।’
‘তাহলে আসেন আমার সাথে, কোথাও বসে কথা বলা যাবে!’
‘না, আমার স্বামী আমাকে এখানে দাঁড়াতে বলেছেন।’
‘আরে রাখেন আপনার স্বামীর কথা, কল করে জানিয়ে দেবেন আপনি কোথায় আছেন? অত স্বামী স্বামী করেন কেন? এ দেশে কেউ স্বামীর বেশি তোয়াক্কা করে না। কারণ, সবাই ডলার কামায়। সুতরাং জীবন আপনার আর উপভোগ করার সুযোগও আপনার। কেবল বুদ্ধি দরকার।’
‘আমি আপনার কোনো কথা বুঝতে পারছি না। আমাকে আবার সেই জায়গায় রেখে আসেন। আমার স্বামী আমার জন্য অনেক চিন্তা করবেন।
‘আপনার কাছে স্বামীর ফোন নাম্বার আছে না, আমি কল করে এই ঠিকানা বলে দিলে তিনি এখানেই চলে আসবেন। আপনি নিশ্চিন্তে পানি পান করেন, সঙ্গে চা-শিঙাড়া।’
কিছুক্ষণ পর তারেক এসে দেখে সে জায়গায় সখিনা নেই। সে আশপাশ ঘুরে দেখতে লাগল, নেই তো নেই। ভাবতে লাগল, এটা তো বাটপারদের এলাকা। কেন জানি মনে হয়, সে কোনো বাটপারের কবলে পড়েছে। কী করবে সে? ৯১১ কল করবে নাকি এলাকার লোকের সহযোগিতা নেবে। কী করবে তারেক দিশেহারা। গ্রামের সহজ-সরল মেয়েটি। তাকে তারেক কিছুই শেখাতে পারেনি, এমনকি ৯১১ কল করাও নয়। কাঁদতে কাঁদতে তারেক রাস্তায় বসে পড়ল। সে কাঁদছে আর বলছে, মিনি বাংলাদেশটা তার দেখার অনেক শখ ছিল। তাই আমি...! বলতে বলতে সে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল। বিজয়ের আনন্দটা যেন তার কাছে ঘোলাটে হয়ে উঠল।