রাকেশ রাউত
সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে উৎসব হলো মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কোন উৎসব মানুষকে জীবনের ইঁদুর দৌড়ের চূড়ান্ত ব্যস্ততা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে দেয়। উৎসব যে ধরনেরই হোক না কেন, প্রত্যেকটি উৎসবের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন প্রত্যেক উৎসবে মানুষ প্রতিদিনকার ব্যস্ততা দূরে সরিয়ে রেখে আনন্দে মেতে ওঠে।
সেজন্যেই পৃথিবীর বেশিরভাগ উৎসবের সঙ্গে কোন না কোন ধর্মের সংযোগ থাকলেও বলা হয় ধর্ম যার যার, কিন্তু উৎসব সবার। কারণ আনন্দের যেমন কোন ধর্ম নেই, তাই উৎসব উদযাপনেরও কোন ধর্ম হয় না।
পৃথিবীতে এমন বেশ কিছু উৎসব রয়েছে, যেগুলির উদযাপনকালে সমগ্র বিশ্বজুড়ে মানুষ জাতি-ধর্ম ভুলে একই দিনে একই সাথে আনন্দে মেতে ওঠে। খ্রিস্টান ধর্মের উৎসব বড়দিন এ ক্ষেত্রে অন্যতম। প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর বিশ্বজুড়ে এই দিনটি পালন করা হয়। প্রাচ্য দেশগুলিতে এই দিনটি ‘বড়দিন’ নামে পরিচিত হলেও পাশ্চাত্যে এটি ‘ক্রিসমাস; নামে পরিচিত।
বড়দিনের ইতিহাস : সাধারণভাবে খ্রিস্টান সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বিশ্বাস করে এই দিনেই ঈশ্বরপুত্র যিশু খ্রিস্টের জন্ম হয়েছিল। এই উপলক্ষেই প্রতি বছর ২৫ ডিসেম্বর তারিখটিকে যিশুর জন্মজয়ন্তী হিসেবে পালন করা হয়। তবে এখনো যিশুখ্রিস্টের ঐতিহাসিক ঐতিহাসিক সত্যতা সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে আদিযুগীয় খ্রিস্টানদের বিশ্বাস, এইদিনে যিশু খ্রিস্ট মাতা মেরির গর্ভে প্রবেশ করেছিলেন।
এই দিনটির ঠিক নয় মাস পরে আসলে যিশুখ্রিস্টের জন্ম হয়। তারা এই দিনটিকে যিশুখ্রিস্টের পৃথিবীতে আগমনের দিন হিসেবে উদযাপন করার পক্ষপাতী। আবার অনেকে ২৫ ডিসেম্বর তারিখকে নিতান্তই একটি ঐতিহাসিক রোমান উৎসবের দিন বলে মনে করেন। তবে ঐতিহাসিক গুরুত্ব যাই হোক না কেন, পৃথিবীজুড়ে এই দিনটিকে ছুটির দিন হিসেবে পালন করা হয় এবং খ্রিস্ট ধর্মের মানুষ এইদিন থেকে শুরু করে ১২ দিনব্যাপী ক্রিসমাসটাইড উৎসব পালন করে।
শব্দগত ব্যুৎপত্তি : ২৫ ডিসেম্বর দিনটি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে পরিচিত হবার পিছনে রয়েছে এই নামগুলির শব্দগত ব্যুৎপত্তি। সাধারণভাবে ইংরেজিতে ‘ক্রিসমাস’ বা ‘খ্রিস্টমাস’ শব্দটির উৎপত্তি ‘খ্রিস্ট্রের মাস’ শব্দবন্ধ থেকে।
এইখানে মাস বলতে অর্থ হিসেবে উৎসব বোঝানো হয়। এর আদিমতম ইংরেজি হলো Cristes mæsse. আবার অন্যদিকে প্রাচীন গ্রিক ভাষায় ‘X’ হলো ‘Christ’ শব্দের প্রথম অক্ষর। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে খ্রিস্ট শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ বোঝাতে ‘ঢ’ অক্ষরটি ব্যবহৃত হতে থাকে। সেই থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এই দিনটি ‘এক্স মাস’ নামেও পরিচিতি পায়।
অন্যদিকে বাংলায় এই দিনটিকে ‘বড়দিন’ বলার কারণ হিসেবে আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধানে বলা হয়েছে ২৩ ডিসেম্বর তারিখ থেকে দিন ক্রমশ বড় এবং রাত ছোট হতে আরম্ভ করে। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের জনৈক অধ্যাপক বলেছিলেন মর্যাদার দিক থেকে বড় হওয়ার কারণে এই দিনটিকে বড়দিন বলা হয়ে থাকে।
বড়দিনের অনুষ্ঠানসমূহ : ইতিহাস কিংবা শব্দগত ব্যুৎপত্তি যাই হোক না কেন, কোনো উৎসবের প্রকৃত প্রাণ লুকিয়ে থাকে সেই উৎসবটির উদযাপনের মধ্যে। বিশ্বজুড়ে ২৫ ডিসেম্বর তারিখে দিনটির ব্যাপকভাবে উদযাপন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় এইদিন নানা অনুষ্ঠান পালন করা হয়ে থাকে।
কোথাও মহাসমারোহে পালন করা হয় যিশুর জন্মোৎসব, আবার কোথাও বা নানা জাঁকজমকপূর্ণ কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়। বিশ্বজুড়ে সব গির্জাগুলিকে অতি সুন্দর সাজে সাজিয়ে তোলা হয়। কোথায় আবার আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মীয়-পরিজনের মধ্যে চলে উপহার দেয়া-নেয়া। মানুষ এইদিনে যিশুখ্রিস্টের জন্ম দিবস উপলক্ষে কেক কাটে; ভোজসভার আয়োজন হয় পাশ্চাত্য বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়।
বড়দিন পালনের প্রকারভেদ : বিশ্বজুড়ে বড়দিনের প্রচলিত সাধারণ সংস্কারগুলির সঙ্গে লোকাচার জড়িত হয়ে এই দিনটি উদযাপন এর মধ্যে বৈচিত্র্য এনে দেয়। এই বৈচিত্র্যের কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বড়দিন উদযাপনের ধরণগুলিও ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন ক্যাথলিক দেশগুলিতে বড়দিনের আগেরদিন ধর্মীয় শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।
আবার অন্যান্য দেশগুলিতে সান্তাক্লজ এবং অন্যান্য প্রমোদমূলক চরিত্রগুলিকে নিয়ে মূলত ধর্মনিরপেক্ষ শোভাযাত্রা আয়োজিত হয়ে থাকে। কোন কোন দেশ যেমন বড়দিন উপলক্ষে পরস্পরের মধ্যে উপহার বিনিময় করে, তেমনি কোন দেশ আবার উপহার বিনিময়ের জন্য ৬ ডিসেম্বর কিংবা ৬ জানুয়ারিকে বেছে নেয়। বিশ্বজুড়ে আয়োজিত হওয়া ভোজসভাগুলির চরিত্রের ক্ষেত্রেও পার্থক্য দেখা যায়।
কোথাও ভোজসভা উপলক্ষে পরিবেশিত হয় ১২ রকমের মাছ; কোন কোন দেশে আবার ভোজসভায় পরিবেশন করা হয় আলু, শাকসবজি, সসেজ, পুডিং ও ফ্রুট কেক। ফিলিপিন্সে আবার ক্রিসমাস উপলক্ষে আয়োজিত পথসভায় প্রধান খাদ্য হলো হ্যাম। তবে ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে তৈরি বিশেষ ধরনের চকলেট সারা পৃথিবীজুড়েই সব মানুষের প্রিয়খাদ্য।
ভারতীয় উপমহাদেশে বড়দিন : ভারতীয় উপমহাদেশে পালিত হওয়া বড়দিনের একটি নিজস্ব স্বতন্ত্র চরিত্র রয়েছে। সুদীর্ঘকাল ব্রিটিশ শাসনাধীন থাকার কারণে দেশের শহরাঞ্চলে বড়দিন পালন উপলক্ষে ব্রিটিশ আদব-কায়দাগুলিই অধিক মাত্রায় প্রচলিত। ব্রিটিশদের মতন এইদিনে এ দেশেও ফ্রুট কেক খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। তাছাড়া জাতি-ধর্ম ভুলে এইদিন ভারতের মানুষ সেজেগুজে রাস্তায় বেরোয়।
শহরাঞ্চলে রাস্তাগুলি সেজে ওঠে অভূতপূর্ব সব আলোকসজ্জায়। শহরতলী তো বটেই, এমন কি গ্রাম থেকেও বহু মানুষ এই উদযাপন দেখার জন্য শহরে পাড়ি জমায়। এছাড়া ভারতীয় যেসব উপজাতির মানুষ খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল, তারা এই দিনটিকে তাদের ঈশ্বরের জন্মদিন বলে পালন করে। অত্যন্ত দরিদ্র এইসব মানুষ সাধারণত ঘরে তৈরি খাবার দিয়েই এই দিনটি উদযাপন করে থাকে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে বড়দিন উদযাপনে বিভিন্ন উপজাতীয় সংস্কৃতির ছোঁয়াও লক্ষ্য করা যায়।
বড়দিনের স্যান্টাক্লজ : বড়দিনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে স্যান্টাক্লজ-এর নাম। ছোটদের কাছে উপহার পৌঁছে দেওয়ার প্রবাদ নিয়ে এই ব্যক্তিত্ব বড়দিন উদযাপনে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। অনেকের মতে স্যান্টাক্লজ নামটি ডাচ সিন্টারক্লাস নামের অপভ্রংশ, যার সাধারণ অর্থ হলো সেন্ট নিকোলাস। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে তুরস্কের মীরার বিশপ সেন্ট নিকোলাস শিশুদেরকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন।
তিনি প্রতিনিয়ত তার অঞ্চলের শিশুদের পোশাক-আশাক, পড়াশোনা এবং স্বাস্থ্য সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতেন। এই খোঁজখবরের দ্বারা শিশুটির মূল্যমান যাচাই করে তিনি নির্ধারণ করতেন সেই শিশু পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য কিনা। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বিশপ সেন্ট নিকোলাস-এর নাম নেদারল্যান্ডে পরিচিতি লাভ করে এবং দক্ষিণ ইউরোপে তার নামে উপহার আদান-প্রদানের ঐতিহ্য চালু হয়ে যায়। যদিও আধুনিক যুগে স্যান্টাক্লজ-এর ঐতিহ্যের এই জনপ্রিয়তার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবদান সর্বাধিক।
বড়দিন পালনের সামাজিক গুরুত্ব : অন্য সব উৎসবের মতই বড়দিন পালনেরও একটি বিশেষ সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে। বিশ্বব্যাপী পালিত হওয়া এই উৎসবে সর্বস্তরের মানুষের যোগদানের ফলে মানুষে মানুষে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়।
মানুষ তার প্রতিদিনকার ব্যস্ততা ভুলে একদিন সমষ্টিগত এই আনন্দ উৎসবে অংশ নেওয়ার ফলে আদপে সমগ্র সমাজের সার্বিক মানসিক চরিত্রে নবশক্তিবিধান হয়। তাছাড়া জাতি-ধর্ম-বর্ণ, উঁচু-নিচু সব ভেদাভেদ ভুলে একটি আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশ নেওয়ার ফলে সমাজে পারস্পারিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পায়।
বড়দিন উদযাপনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব : সামাজিক গুরুত্বের পাশাপাশি ক্রিসমাস বা বড়দিন উদযাপনের বিশেষ অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। বাঙালির দুর্গাপূজা বা ঈদকে কেন্দ্র করে যেমন লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের জীবন ও জীবিকা নির্ধারণ করে, তেমনি বড়দিন বা ক্রিসমাস পালনের উপর নির্ভর করেও বিশ্বের অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ধারিত হয়।
এই দিন উপলক্ষে পৃথিবীর সব পাইকারি ও খুচরা বাজারে কেনাবেচার পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। মানুষ বড়দিন উপলক্ষে ঘর সাজানোর দ্রব্য এবং উপহার সামগ্রী কেনে বলে এই সময়ের পূর্বে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং নতুন নতুন সামগ্রী বাজারে আসে।
একটি সমীক্ষায় জানা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বড়দিনের আগে আগেই বাজারের আসন্ন ভিড় সামলানোর জন্য প্রচুর পরিমাণে কর্মী নিয়োগ করা হয়। এছাড়া বড়দিনের শুভেচ্ছা প্রেরণের কার্ড তৈরির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কাগজের কারখানাতেও কর্মী নিয়োগের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
বড়দিন বিতর্ক এবং নিষেধাজ্ঞা : বড়দিন পালনকে কেন্দ্র করে পৃথিবীজুড়ে যেমন আনন্দের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়, তেমনি এক সময় বড়দিন পালন সম্পর্কেও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। সংস্কারবাদী খ্রিস্টানরা বড়দিন পালনকে পাপ বলে মনে করতেন। তাদের মতে এই দিনটির সাথে যিশুখ্রিস্টের জন্মের কোন সম্পর্ক নেই।
এই ধরনের মতবাদের অনুসারী দেশগুলিতে এক সময় বড়দিনের সঙ্গে সম্পর্কিত সব কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি ইংল্যান্ডেও ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বড়দিন পালন নিষিদ্ধ ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও একদল সংস্কারবাদী ক্রিসমাস উৎসব পালনকে ধর্মবিরোধী পাপাচার বলে মনে করত। তবে উৎসবের আনন্দে এর কাছে সব ফতোয়া ম্লান হয়ে যায়। একইভাবে সময়ের সাথে সাথে বিশ্বজুড়ে বড়দিন পালনের ক্ষেত্রেও সব নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়।
উপসংহার : বড়দিন বিশ্বজুড়ে আনন্দ উদযাপনের ক্ষেত্রে প্রকৃতই খুব বড় একটি দিন। ধর্মগতভাবে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে এই দিনটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। কিন্তু বড়দিন উদযাপন শুধুমাত্র খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভেদ ভুলে সব মানুষ এই দিনটির উদযাপনে অংশগ্রহণ করে। সুদূর অতীতে যিশু খ্রিস্ট সব মানুষের মধ্যে প্রেম ও ভালোবাসার যে বাণী প্রচার করতে চেয়েছিলেন, বড়দিন উদযাপনের মধ্যদিয়ে যিশুখ্রিস্টের সেই স্বপ্নই স্বার্থকভাবে রূপায়িত হয়।