দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্ধারিত দিন ঘনিয়ে আসায় এক দফার আন্দোলন আরও জোরদারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি ও তার মিত্ররা। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই ১৯ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করেছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। সরকার পতনের এক দফা দাবি এবং ‘একতরফা ও প্রহসনে’র নির্বাচনের তফসিল বাতিলের দাবিতে এ কর্মসূচি পালন করে তারা। একই দাবিতে চলমান কর্মসূচিতে ভিন্নতা এনে আন্দোলন অব্যাহত রাখবে বিরোধী দলগুলো। রাজপথের আন্দোলনে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি নির্বাচনকে ভোটারবিহীন করার কৌশলও নিয়েছে তারা। হরতাল-অবরোধের পাশাপাশি এবার অসহযোগ আন্দোলনের কথা ভাবছে বিরোধী দলগুলো। চলমান আন্দোলনকে পর্যায়ক্রমে দুটি ধাপে ওই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছেন নীতিনির্ধারকেরা। সাধারণ মানুষের প্রতি নির্বাচন-প্রক্রিয়া প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হতে পারে অসহযোগের প্রাথমিক প্রক্রিয়া। এরপর পর্যায়ক্রমে অসহযোগের এলাকা ও ক্ষেত্র বিস্তৃত হবে। চলতি মাসের শেষ নাগাদ আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে তখন দেশবাসীকে অফিস-আদালতে না যাওয়া, যান চলাচল বন্ধ রাখা, কলকারখানা বন্ধ রাখা তথা সরকারকে সর্বোতভাবে অসহযোগিতা করার আহ্বান জানানো হতে পারে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, যেকোনো সময় ঘোষণা হচ্ছে জামায়াত-বিএনপির এক মঞ্চে চূড়ান্ত কর্মসূচি। আগামী ২৩ ডিসেম্বর সম্ভাব্য দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এক মঞ্চের কর্মসূচি ঘোষণা হবে। জামায়াতকে নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের এত দিন মতানৈক্য থাকলেও সেটি কেটে গেছে। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এক বৈঠকে ইসলামী আন্দোলনও এক মঞ্চে কর্মসূচিতে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ঢাকাসহ সারা দেশে কয়েকটি কর্মসূচি দিয়ে আগামী ২৭ ডিসেম্বর থেকে যে আন্দোলনে সরকার ঠেকে, সেই আন্দোলনের পথেই হাঁটবে তারা। গত এক সপ্তাহ ধরে পর্দার আড়ালে জামায়াত ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সিরিজ বৈঠক চলছে। ইতিমধ্যে আন্দোলন সফলে ঢাকাসহ সারা দেশে সমন্বয় কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন বয়কট করে এক দফার আন্দোলনে থাকা বিএনপি ও শরিক দলগুলোর লক্ষ্য এখন ভোট ঠেকানো। এ লক্ষ্যে এবার সর্বাত্মক আন্দোলনে নামতে যাচ্ছে তারা। পাশাপাশি নির্বাচনে ভোটার ঠেকানোরও পরিকল্পনা করছেন তারা। এর অংশ হিসেবে হরতাল-অবরোধ শক্তভাবে পালনের পাশাপাশি সরকারের ‘একতরফা’ ভোট প্রত্যাখ্যানে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে জনসংযোগ কর্মসূচি নিয়ে আসছে দলগুলো। জনগণকে ভোটদানে নিরুৎসাহিত করতে প্রচারের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেই লক্ষ্যে দেশবাসীকে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে প্রচারপত্র ছাপানো হচ্ছে। দুই পৃষ্ঠার প্রচারপত্রের এক পাশে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি এবং অন্য পাশে ঘোষিত নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে। আগামী শুক্র অথবা শনিবার থেকে এই প্রচারপত্র বিতরণ শুরু হতে পারে। ভোট গ্রহণের নির্ধারিত দিন ৭ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত হরতাল-অবরোধের ফাঁকে ফাঁকে সারা দেশে ভোটবিরোধী এই প্রচারপত্র বিলি করা হবে।
জানা গেছে, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চসহ যুগপৎভুক্ত অন্যান্য জোট ও দল পৃথক প্রচারপত্র বিলি করবে। অন্যদিকে যুগপতের বাইরে থাকা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এরই মধ্যে ‘প্রহসনের নির্বাচন বর্জন করো, দুঃশাসন হটাও’ স্লোগান-সংবলিত প্রচারপত্র বিলি শুরু করেছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম এরই মধ্যে একাধিক কর্মসূচি থেকে বর্তমান সরকারের অধীনে ‘একতরফা’ নির্বাচনে অংশ না নিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বিএনপির নেতারা জানান, দেশের তরুণ ও যুবশ্রেণির একটি বিশাল অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব। সেখানেই মূলত তাদের মাধ্যমে দেশের প্রকৃত চিত্র দেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। দলের প্রতিটি নেতাকর্মী ওই কর্মসূচিতে সরব ভূমিকা পালন করছেন এবং অন্যদেরও সেখানে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে সারা দেশে মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মানবেতর জীবন, ঘরবাড়ি ছাড়ার দৃশ্য, স্বজনদের হয়রানি করার ঘটনাসহ আরও অনেক আলোকচিত্র, ভিডিও, পরিবারের সদস্যদের আহাজারি ও কান্নার দৃশ্যগুলোকে প্রচারণায় নিয়ে আসা হয়েছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দল ও জোটের ভেরিফায়েড ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব প্রচারণা চলছে। এর বাইরেও নেতাকর্মীদের অ্যাকাউন্ট থেকেও ‘একতরফা’ নির্বাচনের বিরুদ্ধে চলছে প্রচার। বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের ধারণা, বর্তমানে দৃশ্যমান তৎপরতা না থাকলেও বাংলাদেশে একটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাওয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব সরেনি। তাই তাদের এখন চেষ্টা হচ্ছে, আসন্ন নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। আর ভোটাররা বর্জন করলেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। একই সঙ্গে ভোটকেন্দ্রে না গেলে বিএনপিবিহীন নির্বাচনের প্রতি ভোটারদের চূড়ান্ত অনাস্থা প্রমাণিত হবে। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিশ্বে নির্বাচন আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সেটা হলে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরও আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ছাড়া কখনো অংশগ্রহণ, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও গ্রহণযোগ্য ভোট হতে পারে না। বিএনপিকে বাইরে রেখে যে ভোট হচ্ছে, তার জন্য অনেক অশনিসংকেত অপেক্ষা করছে। অনেক বিপদ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। সম্প্রতি বিএনপির অনুপস্থিতি অনুভব করে স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালও বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে ভালো হতো, সেটি সবাই অনুভব করেছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, দেশে সহিংসতা আটকাতে পরিকল্পিতভাবেই বিএনপির নেতাকর্মীদের জেলে রাখা হয়েছে। তারা যদি ভোটে আসতে রাজি হতেন, এক রাতেই বিএনপির সব নেতাকর্মীকে মুক্তি দেওয়া হতো। এ মন্তব্যের এক দিন পর জোর দিয়ে এ-ও বলেছেন, তিনি সামান্যতম ভুলও বলেননি। যা বলেছেন সত্য বলেছেন। এ নিয়ে পাল্টা জবাব দিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্য প্রমাণ করে, সহিংসতা-মামলা-গ্রেপ্তার সবকিছু পূর্বপরিকল্পিত।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রুহুল কবির রিজভী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে ফের ক্ষমতায় থাকতে একটি একতরফা, পাতানো, ডামি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা জনগণকে এই নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়েছি। তারা এরই মধ্যে একতরফা তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। আমাদের প্রত্যাশা, গণতন্ত্রের স্বার্থে জনগণ চূড়ান্তভাবে ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন করবে।