বাংলাদেশের বিজয় দিবস সমাসন্ন। এবার ১৬ ডিসেম্বর বায়ান্নতম বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে দখলদার পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইটের মধ্যদিয়ে বাঙালির যে বহুল কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, সেই স্বাধীনতা অর্জিত হয় বহু ত্যাগের মধ্যদিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন দিয়ে। সেদিন সেই বিজয় অর্জিত হয় ৩০ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ, ২ লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রম হারানো এবং বহু বাঙালির বিপুল ত্যাগ ও ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে।
এবারের বিজয় দিবস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বিজয় দিবসের পরই জাতীয় নির্বাচন। এই মুক্তিযুদ্ধের পেছনের কারণ খুঁজলে দেখা যাবে এর সবই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি পাঞ্জাবি, বেলুচি, বিহারিদের গভীর ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের কথা বলে বাঙালি-মুসলমানদের সবকিছু থেকে বঞ্চিত করার কারসাজি। ১৯৪৭ সালে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনায় পূর্ব বাংলার বাঙলিদের মুখে দ্বিজাতিত্ত্বের স্লোগান ধরিয়ে দিয়ে বৃটিশ-ভারত থেকে মুসলমানদের দেশ হিসেবে পাকিস্তান নামক কিম্ভূত একটি রাষ্ট্র জন্ম নেয়। দু’হাজার মাইলের ব্যবধানে পূর্বে ও পশ্চিমে দুটি ডানা পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান। ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই বাঙালি মুসলমানরা আর মুসলমান থাকে না। পাকিস্তানি অবাঙালিদের কাছে তারা ‘বাঙালি’ এবং ‘বিশ্বঘাতক হিন্দুস্তানের চর!’
পাকিস্তানের কুচক্রী পাঞ্জাবিরা ইতিমধ্যেই বুঝতে পেরে গিয়েছিল যে, বাঙালিদের সুযোগ দিলেই তারা যে শিক্ষা, দীক্ষা, জ্ঞান ও গুণে এতটাই এগিয়ে যাবে যে, তারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের মাথায় চড়ে বসবে। কোনভাবেই আর মাথা থেকে তাদের নামানো যাবে না। তাই পাকিস্তানের পাঞ্জাবি সেনা শাসক বুটের তলায় বাঙালিদের ফেলে পূর্ব পাকিস্তানকে নিজেদের উপনিবেশ বানিয়ে যতরকম শোষণ-শাসন, নিপীড়ন-বঞ্চনা সব চালাতে থাকে চরম নির্মমতার সঙ্গে। তারা পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করে পশ্চিম পাকিস্তানকে তিলোত্তমা করে গড়ে তুলতে শুরু করে।
কিন্তু ইতিহাস বড়ই নির্মম, নিষ্ঠুর। ইতিহাসের শিক্ষা যারা ভুলে যায়, ইতিহাস কানে ধরে তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৪৮-এ পাকিস্তানের বড়লাট, পাকিস্তানের কায়েদে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ বাঙালিদের সংস্কৃতিহীন করতে, তাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা করলেন, উর্দু হবে পাকিস্তানের একামত্র রাষ্ট্রভাষা। সেই ঘোষণার পরপরই পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। সেই আন্দোলন ধিকিধিকি জ্বলতে জ্বলতে কত বাঁক পেরিয়ে বাঙালিরা উপনীত হয় তাদের পরম কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার আন্দোলনে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে বিপুল বিজয় অর্জন করলে পরবর্তী সরকার গঠনের দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার কথা ছিল আওয়ামী লীগের হাতে। কিন্তু জে. ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে সে সুযোগ না দিয়ে ১ মার্চ ঢাকায় নির্ধারিত সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে দিলে পূর্ব পাকিস্তানে আগুন জ্বলে উঠে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস ছোট করে বললে, সেদিন থেকে পূর্ব পাকিস্তানে কার্যত কেন্দ্রীয় শাসন অচল হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশে দেন, সেই নির্দেশই বাঙলিরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলে।
বাঙালিদের ঘরে ঘরে তখন পূর্ব বাংলার মানচিত্র সম্বলিত লাল সবুজের পতাকা উড়তে থাকে। পূর্ব পাকিস্তান তখন স্বাধীনতার দাবিতে টগবগ করছে।
এরপর আসে সেই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন সোহরাওয়ার্দী রেসকোর্স ময়দানে।
কী ভাষণ দেবেন বঙ্গবন্ধু! অধীর প্রতীক্ষা! অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। লক্ষ লক্ষ জনতার সেই উত্তাল তরঙ্গ আরো উত্তাল হয়ে ওঠে, যখন নেতা
ঘোষণা করলেন- ‘এবারে সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
আরো নির্দেশে দিলেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর।’ ব্যস, সবকিছু পরিস্কার। বাঙালিরা বুঝে নিলো তাদের কী করণীয়।
এরপর পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খান এবং জুলফিকার আলী ভূট্টোর সংলাপের নাটক। শেষে ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত বাঙালির উপর পাকিস্তানিদের সর্বাত্মক হামলা- ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। অন্যদিকে বাঙালিদের যার যা কিছু ছিল, তাই নিয়ে প্রতিরোধ। জলে-স্থলে-আকাশে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। তারপর আসে ১৬ ডিসেম্বর। যুদ্ধ শেষ। ৩০ লাখ মানুষের রক্ত এবং ২ লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রম দিয়ে বাংলাদেশ মুক্ত, স্বাধীন। কিন্তু সেই বিজয় যেনো পরিপূর্ণ নয়। বঙ্গবন্ধু তখনও পাকিস্তানের কারাগারে। অবশেষে ২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির ঘোষণা। ঘরে ঘরে আনন্দ-উল্লাস।
এবার ৫৩তম বিজয় দিবস উদযাপনে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক উদ্যোগ। স্বাধীনতাহীনতায় বাঙালিরা কখনও বাঁচতে চায় না। বিজয় দিবসে সব মানুষের প্রার্থনা- এবারের নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হোক। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা স্বাধীনতার সূর্যকে যেনো অমলিন রাখি।