ষড়যন্ত্র ও গুজব-এ দুই বুঝি বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, ডান হাত এবং বাম হাত। বাংলাদেশের রাজনীতি কল্পনাই করা যায় না এই দুই ষড়যন্ত্র এবং গুজব ব্যতীত। গুজব ও ষড়যন্ত্রহীন রাজনীতি বাঙালিদের কাছে যেন লবণহীন তরকারি। রাজনীতি বিষয়ে যে ঘটনাই ঘটুক, তার মধ্যে আমাদের এই দুই মসলার গন্ধ পেতেই হবে। নইলে রাজনীতি জমে না, রাজনৈতিক আলোচনার আসর সম্পূর্ণ হয় না। জমবে না চায়ের টেবিল বা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে যেকোনো জম্পেশ আড্ডা।
আর কোনো দেশের রাজনীতিতে এমন ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব বা ডালপালা ছড়ানো গুজব আছে কি না, কে জানে। তবে তাদের রাজনীতিতে আমাদের মতো এতটা হওয়া সম্ভব নয়। কেননা অন্য কোনো দেশের মানুষের অলস সময় কাটানোর সুযোগ কম। আমরা অনেকেই অলস সময় কাটাতে ভালোবাসি। আলসেমি আমাদের জীবনে উপভোগের অন্যতম একটি অংশ। আমাদের অলস মস্তিষ্কে তাই সহজেই গুজব বাসা বাঁধতে পারে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন বা অন্য কোনো যোগাযোগমাধ্যমেও সে কারণে প্রতিদিন গুজব বা ষড়যন্ত্রের খবর মেলে। গুজব ও ষড়যন্ত্রের উদাহরণের অভাব হবে না একটুও।
অতীতের কথা স্মরণে যদি না-ও আসে, তবে গত এক বছর অর্থাৎ ২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের অতিসম্প্রতি সময়ের হিসাব আমাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। শুরু শেখ হাসিনা দিয়ে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতাসীন হয় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে। গুজব ডালপালা বিস্তার করতে শুরু করল প্রায় তখন থেকেই। অভ্যুত্থানের মাসখানেক পর থেকেই শুরু হয় ‘শেখ হাসিনা যেকোনো সময় তার দলবল নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়বেন এবং ড. ইউনূস পালাবেন’ কিংবা ‘ড. ইউনূস কিছুক্ষণের মধ্যেই রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাবেন’ কিংবা ‘রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন পদত্যাগ করেছেন’।
আমরা ষড়যন্ত্র দেখে অভ্যস্ত সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ছাত্রদের জীবনদান, তার পেছনেও আমরা ষড়যন্ত্র দেখেছি। মানুষ ষড়যন্ত্র দেখেছে ’৫৭ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পেছনেও। ’৬৯-এর উত্তাল গণ-আন্দোলনকেও সাধারণ মানুষের বঞ্চনা-হতাশার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখতে চায়নি অনেকেই। এরপর ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তো বারবার পাকিস্তান ভাঙার পেছনে ভারতের বিরাট ষড়যন্ত্রের কথা উচ্চারিত হয়েছে এবং এখনো সেই ষড়যন্ত্রের ভূত আমাদের পিছু ছাড়েনি।
আসলে যখন কোনো দেশে গণতন্ত্র কার্যকর থাকে না, তখন সেই দেশে গুজব ও ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ যখন সত্য প্রকাশ করতে পারে না, সত্য জানতে পারে না, তখনই গুজব বা ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব ডালপালা ছড়ায়। প্রকৃত অর্থে যদি কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রে গণতন্ত্র কাজ করে, সেই সমাজে কখনো গুজব বা ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব কাজ করতে পারে না। মানুষ যখন সহজেই সত্য জানার সুযোগ পাবে, তখন তারা কোনো অবস্থাতেই গুজবে কান দেবে না বা কোনো ষড়যন্ত্রের কথা বিশ্বাস করবে না। সুতরাং একটি রাষ্ট্রকে গুজব বা ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের অপছায়া থেকে রক্ষা করতে হলে প্রথম শর্ত, সেই সমাজ বা রাষ্ট্রকে গণতন্ত্রের শুদ্ধতায় যুক্ত রাষ্ট্র হতে হবে। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি আধুনিক কোনো রাষ্ট্রকে আলোকিত করতে পারে না। মুক্ত বাতাসে সেই রাষ্ট্রকে শ্বাস নিতে দেয় না। গণতন্ত্রহীনতা সেই রাষ্ট্রকে কল্যাণের পথ দেখাতে পারে না।
তাই কোনো রাষ্ট্রকে আধুনিক, আলোচিত এবং অগ্রগতির শীর্ষে নিয়ে যেতে চাইলে তার গণতন্ত্রের জানালা খুলে দিতে হবে। না হলে গুজব ও ষড়যন্ত্রের ভূত রাষ্ট্রের ঘাড়ে চেপে ঘাড় ভেঙে দেবে। রাষ্ট্রকে করে দেবে চিরতরে পঙ্গু। সেই রাষ্ট্র কখনো আর ঘাড় সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না।