যুদ্ধ মানবসভ্যতার প্রাচীন এক শত্রু। মানবসভ্যতার বিরুদ্ধে যত কর্মকাণ্ড রয়েছে, তার মধ্যে মানুষের উদ্ভাবিত সমরাস্ত্রে মানুষেরই পরিকল্পিত ও পরিচালিত যুদ্ধ সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক মানবতাবিরোধী অপরাধ। অন্যদিকে যুদ্ধে স্বস্বার্থে উসকানি দেয়, সমর্থন দেয়, অর্থ-সম্পদ ও যুদ্ধাস্ত্র সামগ্রী দিয়ে যারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ বাধায়, যুদ্ধ বজায় রাখে, তাদের মুখেই আবার সদর্পে উচ্চারিত হয়, ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই।’ তাদের মুখেই উচ্চারিত হয় মানবতা, সভ্যতা ও গণতন্ত্রের কথা।
ইসরায়েল-হামাস মরণঘাতী যুদ্ধ শুরু হয়েছে অক্টোবর মাসের ৭ তারিখে ইসরায়েলে হামাসের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্য দিয়ে। সেই যুদ্ধ নিয়ে সম্পাদকীয় লেখার মুখবন্ধ হিসেবে উপরের কথাগুলো বলা হলো। যুদ্ধ কোনোভাবেই কোনো সংকটের সমাধান নয়, এই সত্যটি তুলে ধরাই এই সম্পাদকীয়ের লক্ষ্য। বিশ্ব এখন একই সঙ্গে দুটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রায় দুই বছর ছুঁই-ছুঁই যুদ্ধ চলছে রাশিয়া ও ইউক্রেনে মধ্যে। সব যুদ্ধই, যথার্থ সন্ধানে দেখা যায়, কোনো না কোনো শক্তির চাপিয়ে দেওয়া। এ যুদ্ধও বিশ্ব বিবেচনায়, রাশিয়ার চাপিয়ে দেওয়া। সেখানে এখনো মানবতা পদদলিত হচ্ছে। সভ্যতা ধ্বংস হচ্ছে। মানুষ মরছে। ক্ষুধার রাজ্যে কেউ ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে। অসংখ্য নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ খাদ্যহীন। আশ্রয়হীন, শিক্ষাবঞ্চিত। অপুষ্টিতে মানুষ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সমাধান না হতেই ভয়ংকর রূপ নিয়ে শুরু হয়েছে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ। শুরুর দিনেই মৃত্যুসংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। ইতিমধ্যে মৃত্যু পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। হামাসের দিক থেকে আকস্মিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্য দিয়ে শুরু হলেও ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলা এতটাই নির্বিচার এবং ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক হয়, এই হামলার হাত থেকে কিছুই এবং কেউই রেহাই পাচ্ছে না। স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল, চার্চ, মসজিদ, উপাসনালয়, নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ সবাই ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক জনমত বলছে, ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ফিলিস্তিনে ইতিমধ্যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। শিশু-বৃদ্ধ-নারীরা খাদ্য না পেয়ে ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে। হাসপাতালে রোগীরা ইসরায়েলের বোমায় অসহায়ভাবে প্রাণ হারাচ্ছে। আক্রান্তরা চিকিৎসা পাচ্ছে না। সময়মতো ত্রাণ না পৌঁছানোর কারণে অসহায় পরিস্থিতিতে অনেকেই মৃত্যুবরণ করছে, যারা হয়তো মানবিক দুর্দশায় পতিত না হলে প্রাণে বেঁচে যেত। বিপরীতে এখন বরং মধ্যপ্রাচ্যে এই যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়ার ভীষণ রকম আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কিন্তু যুদ্ধ মানবতা এবং সভ্যতার এমন এক শত্রু, যা সভ্যতা ও মানবতাসহ সবকিছুই ধ্বংস করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। জনপদের চিহ্ন থাকে না। মানুষের স্বপ্ন দিয়ে গড়া সোনার সংসার শত্রুর গোলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। প্রিয় সন্তানের লাশ খুঁজে পায় না বাবা-মা। একুশ শতকে দুটো বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধ মিলে কোটি লোকের অধিক মৃত্যুবরণ করেছে। হিরোশিমা, নাগাসাকি অ্যাটম বোমার দগদগে ঘা নিয়ে এখনো বিশ্বযুদ্ধের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে। বিশ্বে যুদ্ধ বন্ধের প্রয়াস নিয়ে গঠন করা হয় জাতিসংঘ। কিন্তু যুদ্ধবিরোধী বিশ্ববাসী যে প্রত্যাশা নিয়ে ভেবেছিল পৃথিবী থেকে যুদ্ধ বুঝি শেষ হলো, তাদের সে প্রত্যাশা পূরণ হলো না। হবেই-বা কেমন করে। যারা বিশ্ব মোড়ল, যারা যুদ্ধ বন্ধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে, তারাই উল্টো ভূমিকায় অভিনয় করতে শুরু করলে আর শান্তি এ বিশ্ব পাবে কী করে! ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব আজ চুপ।
বিশ্ব এখন স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে, যারাই সর্প, তারাই ওঝা। তাহলে বিষ নামার কথা নয়। আর নামছেও না। যত দিন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ভারত আন্তরিক না হবে, তত দিন যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী কেউ দেখবে না। তাই ওই বৃহৎ শক্তির প্রতি আহ্বান, তারা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় যেন আন্তরিক হয়ে বিশ্বটাকে যুদ্ধের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে এগিয়ে আসে। এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ফুঁসে উঠেছে। এই বিশ্ব জনমতকে যুদ্ধরত দেশ এবং তাদের মদদদাতারা বিবেচনায় নিলে ভালো হবে।