গণতন্ত্র নিয়ে যেমন কথার শেষ নেই, গণতন্ত্রের ধারণাও অনেকটা অন্ধের হাতি দেখার মতো। একেকজন একেকভাবে দেখেন, একেকভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। কেউ বলেন, মৌলিক গণতন্ত্রই আসল গণতন্ত্র। কেউ বলেন, উন্নয়নের আরেক নাম। দেশের মানুষ যেমন থাকে থাকুক। যেমন ভাবে ভাবুক। সবার আগে চাই উন্নয়ন। মানুষের পেটে খাবার জুটলে সব ভালো লাগে। তাই সবার আগে মানুষ চায় খাবার। চায় সুযোগ-সুবিধা, আরাম-আয়েশ। তাই গণতন্ত্রের আগে মানুষের চাহিদা উন্নয়ন। সরকারের কাছে মানুষ চায় খাবার, সুখ-শান্তি। কথায় বলে, পেটে সইলে পিঠেও সয়। পেটে ক্ষুধা থাকলে সবকিছু অন্ধকার। ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’।
তেমনি রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র। উত্তরাধিকার সূত্রে বা পারিবারিক পরিচয়ে রাজনীতিচর্চা নতুন কিছু নয়। দেশে দেশে, যুগে যুগে রাজনীতিতে পারিবারিক পরম্পরা লক্ষ করা যায়। পাক-ভারত উপমহাদেশেও পারিবারিক রাজনীতির ধারা অতি প্রাচীন যুগ থেকেই চলে আসছে। অনেক ক্ষেত্রেই পারিবারিক রাজনীতির ধারায় অতীতের চেয়ে মানুষ অনেক বেশি সুফল পেয়েছে। তাদের কাছে পারিবারিক ধারা অনেক বেশি কল্যাণকর, মঙ্গলময়। মানুষের কাছে অনেক বেশি কাম্য। তাদের কাছে ‘অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল’-প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের এই তত্ত্ব গুরুত্বহীন। কোনো তাৎপর্যই বহন করে না। গণতন্ত্রের এই সর্বকালীন বক্তব্যটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা নয়।
প্রেসিডেন্ট লিংকনের সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা অনেক দেশেই মান্যতা পায় না। তা মান্যতা না পেলেও রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র নিয়ে যত সমালোচনা এবং বিতর্ক হয়, প্রেসিডেন্ট লিংকনের সংজ্ঞা নিয়ে সমালোচনা হয় না। দেশে দেশে পরিবারতন্ত্র থাকলেও বাংলাদেশে পরিবারতন্ত্র বহুল কথিত। বহুল আলোচিত এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশটাকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন করেন। বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের ১৯ জন সদস্যসহ হত্যা করা হয়। নিহতদের মধ্যে তাঁর স্ত্রী, রাজনীতির সঙ্গী ফজিলাতুননেছা মুজিব, তিন সন্তানÑশেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু রাসেল অন্যতম। বঙ্গবন্ধু ঘাতকদের হাতে নিহত হওয়ার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসেন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে এক সেনা বিদ্রোহে নিহত হওয়ার পর ক্ষমতায় আসীন হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়ার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নিলে বাংলাদেশে পারিবারিক সূত্রে রাজনীতির ধারা চালু হয়।
এরপর খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে সরাসরি রাজনীতিতে পারিবারিক ধারার সূচনা করেন। তার জ্যেষ্ঠ সন্তান তারেক রহমান উত্তরাধিকারসূত্রে দলের দ্বিতীয় প্রধানের দায়িত্ব নেন। এখন তিনি বিদেশে জীবনযাপন করলেও দলের প্রধান হিসেবে গণ্য এবং দল ক্ষমতায় গেলে তিনিই যে সরকারের প্রধান হবেন, এটা সবার কাছেই প্রায় নিশ্চিত।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার হিসেবে তাঁর আত্মজা শেখ হাসিনা প্রায় ১৫ বছর টানা এবং সব মিলে ২০ বছর, রেকর্ড সময়, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এরপর তার পুত্র-কন্যাসহ প্রায় ৮৬ জন পারিবারিক সদস্য এমপি পদসহ নানা ক্যাপাসিটিতে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। গত ২০ সেপ্টেম্বর সংখ্যা ঠিকানায় রাজনীতিতে পারিবারিক উত্তরাধিকার নিয়ে ‘৯৮ পারিবারিক এমপি’ শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সেই খবরে রাজনীতিতে উত্তরাধিকার নিয়ে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, বর্তমান জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উত্তরাধিকারসূত্রে এমপি আছেন ৮৬ জন, জাতীয় পার্টির ৭ জন এবং বিএনপির ১ জন।
পারিবারিক উত্তরাধিকারের রাজনীতি নিয়ে অনেকের ব্যক্তিগত আপত্তি থাকলেও বলার কিছু নেই। তবে উত্তরাধিকারের সঙ্গে সঙ্গে যদি থাকে যোগ্যতা এবং জনসেবা করার মতো মানসিক প্রস্তুতি, তবে অবশ্যই তাদের রাজনীতিতে স্বাগত। এখানেই আমাদের দুর্ভাগ্য। সবাই উত্তরাধিকারকেই একমাত্র যোগ্যতা ভাবলে সেখানেই প্রশ্ন এবং সংকট। এই সংকট কাটিয়ে কেউ উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে এলে তাকে অবশ্যই স্বাগত।