‘কোনো নির্বাসনই কাম্য নয়’-কবির এই আকুতি চিরকালীন সত্য। বদ্ধ ঘরে বন্দী হয়ে থাকা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি নয়। বিশ্বটাকে আবিষ্কারের নেশায় মানুষ বেরিয়ে পড়ে, কখনো পর্যটনের নেশায়, কখনো-বা জীবিকার সন্ধানে। তবে পর্যটনের নেশা মানুষের ষোলো আনা থাকলেও কলম্বাসের মতো আমেরিকা আবিষ্কারের ন্যায় কেউ নতুন কোনো দেশ আবিষ্কারে বের হয় বলে মনে হয় না। এখন সে রকম কোনো অনাবিষ্কৃত দেশ আছে বলেও কেউ মনে করে না। এখন ধন-সম্পদের অধিকারীরা পর্যটন বা নতুন বাজার খোঁজার অভিলাষে ঘর থেকে বের হয়ে পড়েন। অন্যদিকে অর্থ-বিত্তহীন আরেক শ্রেণি ঘর থেকে বের হয়ে আসে ধন-সম্পদে ভরপুর কোনো দেশের সন্ধানে নেহাত জীবিকার আশায়। এই শ্রেণির সামনে থাকে জীবিকা এবং যে স্বপ্ন নিয়ে তারা বের হন, সেই স্বপ্ন পূরণের ঘোরতর অনিশ্চয়তা।
যে দেশের মানুষ দরিদ্র, সামনে কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না অথচ জেদ আছে, আত্মবিশ্বাস আছে দারিদ্র্য ঘুচিয়ে একটি আলোকিত ভবিষ্যৎ ধরার, তারা সব চ্যালেঞ্জ, সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে, দালালদের খপ্পরে পড়ে শেষ সম্বল ভিটেমাটি বিক্রি করা অর্থ এবং জীবন খোয়ানোর আতঙ্ক পাত্তা না দিয়ে সব ঝুঁকি তুচ্ছজ্ঞানে ঘরবাড়ি, পিতা-মাতা, স্বজন ছেড়ে জীবিকার তাগিদে বেরিয়ে পড়েন। সাগর-মহাসাগর, বন-জঙ্গল পাড়ি দিয়ে যাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকে তারা কূল পান। যারা হতভাগ্য তারা বনে-জঙ্গলে হিংস্র জীবজন্তুর আক্রমণে জীবন হারায় কিংবা সাগরে সলিলসমাধি ঘটে।
পৃথিবীর সব অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ দেশ থেকেই ভাগ্যবদলের আশায় দেশ ছাড়ে হাজার হাজার মানুষ। আর তাদের ভাগ্যেই নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়। বিনা অপরাধে তারা প্রাণ হারায়। যাদের মুখে হাসি ফোটানোর আশা নিয়ে এই ঝুঁকি তারা নেয়, সেই মুখে হাসি তো ফোটেই না, বরং অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে নেমে আসে। এই হতভাগ্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম একটি নাম বাংলাদেশ। এসব ভাগ্যবঞ্চিত মানুষের অধিকার আছে নিজেদের ভাগ্য বদলের। তারা সব বঞ্চনার শিকার হয়েছেন বিশ্বের সব বিত্তশালী দেশের বিত্তবান মানুষদের দ্বারা। তাদের তৈরি আইন, তাদের প্রতিষ্ঠিত সব সামাজিক, রাষ্ট্রীয় আইনকানুন, পাইক-পেয়াদা সবকিছু সৃষ্টি করে নিজেদের ক্ষমতার আধিপত্য নিশ্চিত করে সবার ভাগ্য বঞ্চনার বন্দোবস্ত করে চলেছেন। সেই শক্তিবলয়ের বাইরে নয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষও তাদের দ্বারাই বঞ্চিত।
বিশ্ব যদি একটাই হয়ে থাকে, আজকের সময়টা যদি গ্লোবাল ভিলেজের বিশ্বাস নিয়ে সামনে চলে, তবে কেন এই সীমানার বিভক্তি। কাঁটাতারের বেড়া। সীমানা চিহ্ন। কেন হবে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমের বিভাজন। সাদা-কালো, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের বিভক্তি। কাউকে বড় করে দেখা, কাউকে ছোট করে দেখা। একুশ শতকের প্রায় পোয়া ভাগ শেষ করেও আমরা নিজেদের আধুনিক ভাবতে, উদার ভাবতে পারি না। এখনো কেন তবে আমেরিকার পুলিশের তাড়া খেয়ে আফ্রিকার মানুষ জলে ডুবে মরছে। মধ্যপ্রাচ্যের মরুতে তপ্ত বালুতে বাংলাদেশের মানুষ পুড়ছে। কেন সভ্যতা এত দূর এগিয়ে এলেও আমরা বিশ্বময় ভালোবাসার ঝাণ্ডা ওড়াতে পারছি না। একে অপরকে আপন করে নিতে পারছে না। প্রতিনিয়ত অভিবাসনপ্রত্যাশীদের দুর্ভোগ ও বঞ্চনার খবর কেন দেখতে হচ্ছে।
স্রষ্টা তো কাউকে বড়-ছোট, বিত্তশালী দরিদ্র করে দুনিয়াতে পাঠায়নি। তবে কেন আজ এই শ্রেণিবৈষম্য, শ্রেণিবিভেদ। দুনিয়া যত অগ্রসর হচ্ছে, দেশে দেশে অভিবাসন আইন কঠোর থেকে কঠোরতর হচ্ছে। অন্যদিকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কাফেলা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। স্রষ্টার দেওয়া নিয়ামত থেকে জোর করে অধিকাংশের হক কেড়ে আমরা মুষ্টিমেয় মালিকানা দাবি করছি। আমরা কেন ‘সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ হতে পারছি না।