বাংলাদেশে যত রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, বিবাদ, কলহ; নির্বাচন নিয়ে যত রকম বিতর্ক, অনৈক্য, বিভেদ-মোটাদাগে দেখলে দেখা যাবে, তার পেছনে রয়েছে নির্বাচন কমিশন। বাংলায় প্রবাদ আছে, ‘অঘটন-ঘটন-পটিয়সী’। সহজ অর্থ, যারা অঘটন ঘটাতে খুব পারদর্শী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সাম্প্রতিক ২০২৪ এর ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন পর্যন্ত সব নির্বাচন নিয়েই মানুষ কমবেশি অসন্তুষ্ট এবং কোনোটার ফলাফলই সব মানুষ গ্রহণ করতে পারেনি। বিশেষ করে, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন কোনোভাবেই মানুষ মেনে নিতে পারেনি। মানুষ ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠতে থাকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে জোর করে, চালাকি করে ক্ষমতা ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল। কিন্তু শেষ পরিণতিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় এবং দলটির সভাপতিসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে হয়। এ-যাবৎ প্রায় সব প্রধান নির্বাচন কমিশনারকেই (সিইসি) সরকারের তল্পিবাহক হয়ে জি হুজুরের ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন করে আবারও আলোচনা হচ্ছে ‘সিইসি কে হচ্ছেন’? সে নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়ে গেছে। এই শিরোনামে ঠিকানার ১৩ নভেম্বর সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ‘গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৫ সেপ্টেম্বর সাবেক সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন পদত্যাগ করে। এরপর গত ৩১ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীকে প্রধান করে ৬ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সার্চ কমিটিতে নাম প্রস্তাব করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। তবে পতিত আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী জোটের কাছ থেকে কোনো নাম চাওয়া হয়নি।’
সার্চ কমিটির কাছে তিন শতাধিক নাম এসেছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদের জন্য। যার মধ্যে সর্বাধিক নাম এসেছে সাবেক সচিব এবং শিক্ষাবিদদের মধ্য থেকে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে কার নাম শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়, কে জানে। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো নয়। এখন পর্যন্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নাম চূড়ান্ত হয়েছে ক্ষমতাসীনদের আকাক্সক্ষা মেটাতেই। এবার অবশ্য কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় নেই এবং তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না বলেই এ পর্যন্ত মনে হচ্ছে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি রাজনৈতিক দল গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেয়, তবে সে ক্ষেত্রে অতীতের মতো ঘটনা ঘটবে কি নাÑতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় থেকে যেতে পারে।
এখন পর্যন্ত এমন একজন সিইসি পাওয়া গেল না, যার ওপর বিরোধী পক্ষ পূর্ণ আস্থা রাখতে পেরেছে। তাদের সেই বিশ্বাস এ পর্যন্ত ভুল প্রমাণিত হয়নি। তারা চেয়ারে বসেই বড় বড় কথা বলবেন, নীতি-আদর্শ আওড়াবেন, মনে হবে যেন আসমান থেকে নাজিল হয়েছেন; কিন্তু শেষ বেলায় যা ঘটাবেন, তাতে যে কেউ জ্ঞান হারাবেন। বিশেষ করে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪-এর নির্বাচনে যা ঘটেছে, তা ইতিহাস তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও একটি উদাহরণ মিলবে না। তার পরিণতিও হয়েছে ভয়াবহ। ছাত্র আন্দোলনের ফলে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে, সাধের রাজ্যপাট ফেলে রেখে।
সব সিইসিকেই দেখা গেছে লোভের বৃত্তে বন্দী। অথচ তার হওয়ার কথা নির্মোহ, নির্লোভ, প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন দৃঢ়চিত্তের অধিকারী একজন মানুষ। বাংলাদেশের মানুষ সত্যিই হতভাগ্য, সব সিইসি মিলেছে যারা ছিলেন অতিমাত্রায় উচ্চাভিলাষী, প্রাপ্তি প্রত্যাশায় নতজানু, মেরুদণ্ডহীন। তারা প্রভুর কথায় উঠেছেন, প্রভুর কথায় বসেছেন।
এবার যেন এমনটা না হয়, মানুষের প্রত্যাশা তেমনটাই। মানুষের আশাভঙ্গ যেন না ঘটে এবার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে সম্মান-মর্যাদা নিয়ে এসেছে, ঠিক সেভাবেই যেন বিদায় নিতে পারে।