রাজতন্ত্রে রাজা-মহারাজাদের ক্ষমতার হাত অনেক লম্বা। তাদের ক্ষমতা, দাপট সর্বত্র দৃশ্যমান। রাজতন্ত্রে রাজার আকাক্সক্ষা, রাজার ইচ্ছা ও অভিলাষই সংবিধান, আইন-আদালত সবকিছুই। আইনকানুন, সেনাবাহিনী, আচার-অনুষ্ঠান চলে রাজার ইশারায়, ইঙ্গিতে। রাজতন্ত্রে রাজাদের কোনো অপরাধ নেই, পাপ নেই। আইনের হাত তাদের স্পর্শ করতে পারে না। তারা আইনের ঊর্ধ্বে। বর্তমান সময়ে রাজতন্ত্রেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। রাষ্ট্রের আইনকানুনে যেমন, তেমনি পরিবারের ক্ষেত্রে। অবগুণ্ঠন থেকে মেয়েদের অনেকটাই মুক্তি মিলেছে। নারী স্বাধীনতার হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সেই হাওয়া গায়ে লাগিয়ে তারা গাড়ি চালাচ্ছে, একা একা শপিং করছে। এখনো অনেক কিছুতেই তারা স্বাধীনতা ভোগ করছে। তাদের মধ্যে কোনো রাখঢাক বা কোনো গোপন করার প্রবণতা নেই। যা আমাদের সমাজে প্রবলভাবে বিদ্যমান। ‘উইনার টেকসঅল’-সাধারণ মানুষ এতকাল সেটাই জেনে এসেছে।
বাংলাদেশের বাঙালিরা অনেক সহজ বিষয়কেও সহজ করে বলতে পারে না। গ্রহণ করতে গেলেও অনেক জটিল করে তোলে। সমাজজীবনের অনেক কিছুতেই এই জটিল মানসিক প্রবণতার মতো রাজনীতিতেও এর ছাপ পড়তে দেখা যায়। এ জন্য তাদের মধ্যে দেখা যায় গণমানুষের সঙ্গে একটা লুকোচুরি খেলার মানসিকতা। সত্য গোপনের স্পৃহা এবং অকারণে মানুষের সঙ্গে মিথ্যার বেসাতি করা। অবশ্য এতে আখেরে লাভ হয় না কারোরই। সাধারণ মানুষ এবং দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। রাজনীতিকদের একটা বড় ক্ষতি হয়ে যায় নিজেদেরই পাতা ফাঁদে পড়ে। আমরা সবাই জানি, সত্যকে কখনো মেঘ দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না। মেঘ কেটে গেলে সত্য প্রকাশ পেয়ে যায়। দেখা যায়, এক সরকার যা লুকানোর চেষ্টা করে, অন্য সরকার এলে আগের সরকারের সকল গোমর ফাঁস হয়ে যায়। তখন রাজনীতিবিদদের ওপর থেকে সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। রাজনীতিবিদেরা যখন অনাস্থার শিকার হন, তখন তাদের ভালো কাজও আর দেশের মানুষের দৃষ্টিতে পড়ে না। অথবা ভালো কাজও মানুষ সমালোচনার চোখে দেখে। দুটি বিষয়ে মানুষ প্রথম স্বস্তি চায়Ñএক. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা। দুই. জানমালের নিরাপত্তা। কোনো সরকারই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য কমাতে পারেনি। বরং নতুন সরকার এলে নতুন করে মূল্যবৃদ্ধি পায়। মানুষের দুর্ভোগ কমার চেয়ে আরও বৃদ্ধি পায়। শুরু হয় মানুষকে নতুন নতুন রাজনৈতিক নির্যাতনের পদ্ধতি। এই নির্যাতনের কোনো কোনো আমলে নাম হয় হাওয়া ভবন, কোনো আমলে আয়নাঘর, আবার কোনো আমলে মব জাস্টিস পদ্ধতি। নামে কীবা আসে যায়। পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন হলেও ফল এক।
দেখা যাচ্ছে, নির্যাতনের এই কার্যক্রম পরিচালিত হতো মূলত ডিজিএফআই, র্যাব, দলীয় ক্যাডার দ্বারা এবং কখনো আবার মবের (উত্তেজিত জনতা) হাতে ছেড়ে দিয়ে দণ্ড নিশ্চিত করার নির্মমতা। ঠিকানার ৬ নভেম্বর সংখ্যার ৩ এর পাতায় একটি রিপোর্ট এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। খবরটির শিরোনাম : ‘ডিজিএফআইয়ের চেয়েও ভয়ংকর ছিল র্যাবের গোপন বন্দিশালা’। খবরের শিরোনাম থেকে নৃশংসতার গন্ধ পাওয়া যায়। খবরে বলা হয়েছে, ‘গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসন কার্যের দেড় দশকে গুমের ঘটনায় ১৬০০ (এক হাজার ছয়শ) অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৪০০ অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, এই অপরাধ করতে গিয়ে জোরপূর্বক মানুষ তুলে নিয়ে দীর্ঘদিন আটকে রাখা হতো, এমন আটটি গোপন বন্দিশালার সন্ধান পাওয়া গেছে। কমিশনের ভাষায়, র্যাব, ডিজিএফআই, ডিবি, সিটিটিসি, সিআইডি, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা এসব গুমের ঘটনায় জড়িত।’
গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির সভাপতি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর মাধ্যমে গুলশানে তাদের কার্যালয়ে জানা যায়, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়কালে এসব অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগের বাইরেও নিশ্চয় আরও ঘটনা ঘটেছে। সেসবের অভিযোগও গুম হয়ে গেছে। গুম এমন প্রকার বর্বরতা, কেউ তার শিকার হলে তার আত্মীয়-পরিজনের কাছে প্রতিদিনই তার মৃত্যু দিবস বলে মনে হবে।
বাংলাদেশকে বলা হয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। তার অর্থ বাংলাদেশ একটি প্রজাতন্ত্র, যার মালিক জনগণ। অথচ প্রকৃত বাস্তবতায় জনগণ কোনোভাবেই প্রজাতন্ত্রের মালিক নয়। প্রকৃত বাস্তবতা হলো, যে যখন ক্ষমতায় বসেন, তারাই প্রজাতন্ত্রের রাজা, মালিক, সবকিছু এবং এই রাজা-মহারাজাদের কাছে জনগণের দুটো পয়সার দামও নেই। গানে মূল গায়কের সঙ্গে দোহার তোলার মতো ‘আহা বেশ বেশ’।