বাংলাদেশে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেক বিষয় নিয়েই বিতর্কের ঝড় বইছে। তার মধ্যে আলোচনার শীর্ষে রয়েছে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ বা অপসারণ এবং নির্বাচন কবে, কখন হবে-এ দুটি বিষয়। এসব বিষয় নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের পেছনে যেসব রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ছিল, সেসব রাজনৈতিক দল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের মধ্যে মন-কষাকষি লক্ষ করা যাচ্ছে। একটি বিষয় নিয়ে যদি সহমত হয়, তবে আরেকটি নিয়ে ভিন্নমত। রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে ছয়টি কমিটি করে দেওয়া হলেও তাদের কাজের অগ্রগতি এখন পর্যন্ত তেমন দৃশ্যমান নয়। হয়তো লোকচক্ষুর অন্তরালে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। তবে উপদেষ্টা কমিটির অনেককে বেশ সক্রিয় দেখা যায়। এখন বিভিন্ন দাবি নিয়ে প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী এবং অন্য শ্রমজীবীদের নানা স্থানে প্রায় প্রতিদিনই সড়কজুড়ে রাজপথে দেখা যায়। ফলে রাস্তার যানজটে নগরবাসীকে নাকাল হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
তবে একটা বিষয়ে এরই মধ্যে জট খুলতে দেখা গেল। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রাথমিক যেটা প্রয়োজন, নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে সেই সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে যারা মনে মনে চেয়েছিল, নির্বাচন যত বিলম্বে হবে তাতে তাদের সুবিধ, এই মনোভাবের মানুষ ছাড়া সব রাজনৈতিক দলই এখন নির্বাচনী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবাই ধারণা করছে, নির্বাচন যখনই হোকÑএবার নির্বাচন হলে জয়ী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) কিংবা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর। বর্তমান উপদেষ্টা কমিটি কোনো নতুন দল গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়। তবে ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করার ফল বাংলাদেশে কখনো তাদের বিরুদ্ধে গেছে দেখা যায়নি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী যুগপৎ আন্দোলন করে সফল হয় এবং পার্লামেন্টে সংবিধানে সংশোধনী এনে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়।
বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাস খুব সুখকর নয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হলেও জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা পূরণে সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর যৌথ ষড়যন্ত্রে সেই নির্বাচনের ফল অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব লাভে ব্যর্থ হয়। ফলে বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। শুরু হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির বিদ্রোহ। পাকিস্তানের সুপ্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ এবং সর্বশেষ ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে বাঙালিরা শোষণের জিঞ্জির ভেঙে মানুষের শ্রেষ্ঠ আকাক্সক্ষার ফল স্বাধীনতা অর্জন করে।
এরপর যাদের হাত ধরে বাঙালিরা স্বাধীনতা অর্জন করল, তাদের হাতেই স্বাধীনতার সূর্য মলিন হতে থাকল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে মানুষ তাদের কাক্সিক্ষত ফল থেকে বঞ্চিত হয়। ফল হাইজ্যাক হয়ে যায়। এরপর ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু মুজিব সপরিবারে নিহত হলে আওয়ামী লীগ ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকে। পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে ১৯৯৬ সালে। এরপর ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪-এর ৪ আগস্ট-টানা সাড়ে ১৫ বছর তারা সরকার পরিচালনা করে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচন নিয়েই দেশে-বিদেশে ভয়ংকর অভিযোগ ওঠে। তিনটি নির্বাচনকেই প্রহসনের নির্বাচন বলে অভিযুক্ত করা হয়। মানুষজনও ভোট দেওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্ষুব্ধ হয় সরকারের ওপর। সরকার ক্রমাগতভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকে। গণতন্ত্রের লেশমাত্র আর অবশিষ্ট থাকে না।
অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নির্বাচন না থাকলে গণতন্ত্র থাকে না। সব বিবেচনা এবং ব্যাখ্যায় শেখ হাসিনা সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে সংসদীয় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। শেখ হাসিনা কেবলই তার পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের এবং মুক্তিযুদ্ধের দোহাই দিয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে থাকেন। তার মন্ত্রিপরিষদ থেকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের যেকোনো পর্যায়ের নেতাকর্মী দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের সব সীমারেখা লঙ্ঘন করে যায়। এই আক্রোশের বিস্ফোরণ ঘটে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। পতন ঘটে শেখ হাসিনার প্রায় ১৫ বছরের একনায়ক শাসনের। শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
এখন আবার নির্বাচনের কথা শোনা যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে সার্চ কমিটিও গঠিত হয়েছে। আর মানুষের মধ্যেও নতুন আশার আলোর পাশাপাশি নতুন আতঙ্কও দেখা দিচ্ছে। ‘ঘর পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরায়’-বাংলাদেশের মানুষের মনেও নির্বাচনের নাম শুনে সেই অবস্থা। মনে মনে ভাবছে, কী জানি কী হয়। তবে অতীতের এ অভিজ্ঞতা থেকে রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দলগুলো যদি একটুও শিক্ষা না নেয়, তবে এর চেয়ে দুর্ভাগ্য বাংলাদেশ ও দেশের মানুষের জন্য আর কিছুই হতে পারে না। অবশ্য বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন কিছু উপলব্ধি দেখা যাচ্ছে, যা সত্যিই মানুষের মনে আশার সঞ্চার করছে।
যে সময় রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সাহাবুদ্দিনকে পদত্যাগ বা বরখাস্ত করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সমন্বয়কেরা, তখন অত্যন্ত প্রাজ্ঞতার পরিচয় দেন বিএনপি, বিশেষ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তারেক রহমানকে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত এবং পরিণত এক রাজনৈতিক নেতা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। বুঝতে কঠিন হয় না যে, গণতন্ত্রের শিক্ষা তিনি ভালোই নিয়েছেন। এ রকম নেতৃত্বের মাধ্যমে যদি বাংলাদেশে পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে সবাই নিজেদের পরিবর্তন করতে পারতেন, তবে বাংলাদেশের মানুষ অনেক সমস্যা ও সংকট থেকে মুক্তি পেত।
সবশেষে এই বলে সম্পাদকীয় শেষ করছি, ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনেক দোলাচলের মধ্য দিয়ে শেষ হলো। নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীকে ঠিকানার সব পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা ও শুভানুধ্যায়ীর পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভকামনা।