সম্পর্ক গিরগিটির মতো। রং পাল্টায়। ক্ষণে ক্ষণে কখনো লাল, কখনো নীল আবার কখনো আকাশি রং ধারণ করে। মানুষের সম্পর্কও ঠিক সে রকমই। সময়ে সময়ে পাল্টে যায়। আজ যার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কালকেই সে চরম শত্রু। সকালে যে মিত্র, বিকালেই হয়তো সে বৈরিতার তালিকায়। সকালে ঝকঝকে রোদ তো বিকেলেই কালো মেঘের ঘনঘটা। ঋতু যেমন পাল্টায়, বন্ধুত্ব তেমটি একরকমভাবে স্থির থাকে না। একসময় তাকে ছাড়া মনে হয় জীবনটাই বৃথা। সে রকম একজন মানুষের জীবন ঝরে যায়, তবু জীবন প্রবহমান। দু’দিন বাদে সয়ে যায়। জীবন চলমান, জীবনের চলার গতি থামে না।
তেমনিভাবে রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক সদা পরিবর্তনশীল। লক্ষ্য, আদর্শ, উদ্দেশ্যের মধ্যে মিল নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর একটার সঙ্গে আরেকটার সম্পর্ক গড়ে উঠতে না-ও পারে। বিভিন্ন দলের মধ্যে নানা কারণে বিভাজন ঘটে থাকে। আজ জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক দেখা গেলেও কাল যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াত গাঁটছড়া বাঁধবে না, কেউ বলতে পারে না। এখন তো অহরহই শুনতে পাওয়া যায়, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। আজ যে নিবিড় বন্ধু, কালই হয়তো সে শত্রু। রাজনীতিতে তাই স্থায়ী শত্রু-মিত্র বলে কিছু নেই।
আবার রাষ্ট্রীয় সম্পর্কও তেমনই। কূটনৈতিক সম্পর্কও আজ যে দেশের সঙ্গে মিত্রতা, আগামীকাল সে দেশের সঙ্গে সেই একই রকম সম্পর্ক থাকবে এ কথা দিব্যি দিয়ে বলা যাবে না। অখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকা অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র এবং পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যে সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর আজ বিশ্বে যেন শক্তির ভারসাম্য ওলট-পালট হয়ে গেছে। তেমনি এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সম্পর্কও বদলে গেছে। পূর্ব ইউরোপ ও পশ্চিম ইউরোপের আদর্শগত সম্পর্কও বিভিন্ন দেশের মধ্যে অদল-বদল ঘটেছে।
শুধুই ইউরোপ-আমেরিকা কেন, এশিয়াতেও এমন সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস ঘটেছে বিভিন্ন দেশের মধ্যে। সম্পর্কের সেই বিশেষ ভিন্নতা তুলে ধরতে ঠিকানার গত সংখ্যার প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম : ‘আফগানিস্তান কেন ভারতমুখী হলো’, উপশিরোনামে রয়েছে : ‘তালেবানের ইউটার্ন’। বিশ্ববাসীর জানা আছে, আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তালেবান আসীন থাক কিংবা অন্য কেউ, পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্কের কখনো কোনো অবনতি দেখা যায়নি এবং ভারতের সঙ্গে আফগান তালেবান সরকারের সুসম্পর্ক কখনোই দেখা যায়নি, শোনা যায়নি। শুধু কি সম্পর্কের রং বদল, আফগানদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এবং সে যুদ্ধে দুই পক্ষের বহু মানুষ হতাহত হচ্ছে বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রকাশিত খবরটিতে বলা হচ্ছে, ‘আফগানিস্তানের ভারত-ঘেঁষা কূটনীতি এখন পাকিস্তানের জন্য নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সালে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে দেশটির ওপর পাকিস্তানের একটি ভালো প্রভাব লক্ষ করা গেছে। তালেবানদের জয়কে ইসলামাবাদের কৌশলগত জয় হিসেবেই অনেকে দেখেছে।
তাহলে আজ সেই সম্পর্কের অবনতি কেন ঘটল? মনে করা হয়, সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘাত, কূটনৈতিক টানাপোড়েন, বাণিজ্যিক উত্তেজনা-সবকিছু মিলিয়ে তালেবান সরকার ক্রমে ক্রমে পাকিস্তান থেকে সরে গিয়ে ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আরেকটি বড় কারণ টিটিপি ইস্যু। টিটিপি একটি সংগঠন। এই সংগঠনটি তালেবানি আদর্শে বিশ্বাসী হলেও তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হয় পাকিস্তানের ভেতরে। এ বিষয়ে পাকিস্তান অনেকবার কাবুলকে অবহিত করলেও কাবুল এটাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও দমননীতির ফল বলে এড়িয়ে যায়।
আসলে শুধু পাক-আফগান সম্পর্ক নয়; বিশ্বের সব দেশের ক্ষেত্রেই এসব বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন ছাড়াও বড় বড় শক্তির ক্ষেত্রে যুদ্ধের উসকানি দিয়ে অস্ত্র ব্যবসা করা, নিজেদের প্রভাব বলয় বৃদ্ধি করাসহ বিভিন্ন কারণে সম্পর্কের এই ভাঙাগড়া, পুনর্বিন্যাস এবং রং বদল ঘটে। এটা অতীতে চলে এসেছে, এখনো চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলতে থাকবে।




