সূচনা পর্ব
আজও ক্লাসে যেতে দেরি করে ফেলল অনামিকা। কারণ মায়ের হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়া। সাধারণত মা অসুস্থ হন না। প্রচণ্ড পরিশ্রমী তিনি। রাত-দিন সমানে খাটতে পারেন। বাসার সব কাজ থেকে শুরু করে অসুস্থের সেবা করা, বাবার মেহমানদের উপযুক্ত আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা সবই তার সহজ কাজ। বাবার আছে পীর। পীরের মুরিদ তিনি। বছরে একাধিকবার তাদের বাড়িতে আসেন। তারও যথোপযুক্ত আতিথেয়তা করা হয়।
বাবা সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি। রেডিওতে বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করে থাকেন। পাড়ার সাংস্কৃতিক ক্লাবের তিনি সাধারণ সম্পাদক। তরুণদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এ জন্য তরুণদের মাঝে তার দারুণ জনপ্রিয়তা। এ ছাড়া তিনি নিয়মিত কবিতা, গল্প, উপন্যাস লেখেন। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতে অসম্ভব দক্ষ তিনি। এ ছাড়া হিন্দিতে বেশ কিছু গজলও রচনা করেছেন তিনি। তার কবিতা দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই প্রকাশিত হয়। তবে উপন্যাস বেশ কয়েকটি লিখলেও মনের মতো প্রকাশক পাচ্ছেন না বলে ছাপাতে পারছেন না।
ক্লাস শেষে বান্ধবী জেসমিনের সঙ্গে টিএসসিতে গেল অনামিকা। পরবর্তী ক্লাস বিকালে, তিনটায়। অন্য দিন হলে লাইব্রেরিতে চলে যেত। কিন্তু আজ আর লাইব্রেরি ওয়ার্ক করতে ভালো লাগছে না। এমনিতে সিরিয়াস স্টুডেন্ট ও। আজেবাজে কারও সঙ্গে মেশে না। খুব বেশি আড্ডাও দেয় না। কিন্তু আজ মনটা ভালো নেই তার। তাই টিএসসিতে গিয়ে মনটা কিছুটা হালকা করা।
টিএসসির সবুজ ঘাসের ওপর বসে পড়ল ওরা। আশপাশে তাকাল দুজনে। প্রচুর স্টুডেন্ট এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসেছে। কেউ কেউ জোড়ায় জোড়ায়, আবার অনেকে দল বেঁধে। জেসমিনই শুরু করল, তোর কী হয়েছে বল তো? মুখটা শুকনো শুকনো লাগছে। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। মনে হয় কয়েক দিন হলো ঘুমাসনি। কী এত দুশ্চিন্তা তোর?
মনে মনে কথা গুছিয়ে নিল অনামিকা। একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। এলিফ্যান্ট রোডে বাড়ি। জয়েন্ট ফ্যামিলি। কিন্তু পাত্র পাস করেছে রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে। পলিটিক্যাল সায়েন্সে। হাইটও তেমন সুবিধার নয়। তার থেকে এক ইঞ্চি লম্বা আমি। চেহারাও ইমপ্রেসিভ নয়। মাথার চুল কম। গুণের মধ্যে একটাইÑতিনি একজন বিসিএস অফিসার। আর এ কারণেই তাকে আব্বার খুব পছন্দ। আম্মা রাজি না। এ নিয়ে আমাদের পরিবারে দারুণ অশান্তি। আমি কী করব বল তো! অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করল অনামিকা।
কিছুক্ষণ গভীরভাবে ভাবল জেসমিন। তারপর কথা বলা শুরু করল। মনে হলো এ রকম কঠিন দায়িত্ব এর আগে কখনো পালন করতে হয়নি তাকে।
সুষ্ঠুভাবেই বিয়ে সুসম্পন্ন হলো অনামিকার। জয়েন্ট ফ্যামিলি শ্বশুরবাড়িতে। জনা বিশেক স্থায়ী সদস্য, চার-পাঁচজন ফ্লোটিং। এত বড় বিশাল ফ্যামিলি এর আগে কখনো কাছ থেকে দেখেনি অনামিকা। তাই প্রতিদিন বিশেষ বিশেষ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় ও। পরিবারের একেক সদস্যের মন, মেজাজ একেক রকম। তাই প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয় অনামিকাকে। ওদের প্রত্যেকের মনের গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সফল হলেও কয়েকটি চরিত্রের বিশ্লেষণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর তখনই নিজের ভেতরকার দৈন্য প্রকাশ পায় তার কাছে।
বাড়িতে মায়ের পরে মেজো ভাবি এই বিরাট সংসারের হাল ধরেছেন। তার নির্দেশনায় পুরো পরিবার চলছে। কিছুদিন বাজার ও রান্না-বান্না মেজো ভাবির একক দায়িত্বে চলেছে। বাড়িতে বর্তমানে তিন ছেলের বউ রয়েছে। মেজো ভাবি এই তিনজনের মধ্যে সংসার পরিচালনা করার দায়িত্ব ১০ দিন করে ভাগ করে দিলেন। এই তিন বউ ১০ দিন করে চালাবে। বাজার-ঘাট করা থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়ে এই তিন বউ সিদ্ধান্ত নেবে। অবশ্য জটিল বিষয়ে হয় আব্বা অথবা আম্মা অথবা মেজো ভাবির সঙ্গে আলোচনা করে।
বাসররাতেই মোস্তফা অনামিকাকে সবকিছু খুলে বলে। সে বছরের অধিকাংশ সময় অসুস্থ থাকে, বাজার করতে পারে না ইত্যাদি। সেই সঙ্গে বিশেষ করে বাজারের দায়িত্বটা নিজ কাঁধে তুলে নিতে অনামিকাকে অনুরোধ করে সে। সবকিছু মেনে নিতে কষ্ট হয় অনামিকার। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়ায় ও।
বছরখানেকের মধ্যে ওদের সংসার আলো করে আসে পুত্র শাদ। এর বছর পাঁচেক পর আবারও সংসার আলোকিত করে কন্যা ফাতিমা। ওদের সংসারে সুখের কোনো রকম অভাব থাকে না।
ধীরে ধীরে সংসার-দায়িত্বের আরও গভীরে প্রবেশ করে অনামিকা। বাজার-ঘাট, শাদ-ফাতিমার লেখাপড়ার সুব্যবস্থা করা, ওদের জন্য উপযুক্ত হাউস টিউটর খুঁজে বের করা, ওদের দুজনকে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে আসাÑসবই অনামিকাকে একা সামলাতে হয়। মোস্তফা ওদের শুধু সকালে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে অফিসে চলে যায়। একটা প্রাইভেট কলেজে শিক্ষকতার চাকরি করে অনামিকা। কলেজ থেকে সময় ম্যানেজ করে এসব দায়িত্ব পালন করে যায় ও।
অনামিকার বড় বোন আমেরিকার নিউইয়র্কে থাকেন। তিনি সবার ইমিগ্র্যান্ট ভিসার জন্য আমেরিকা সরকার বরাবর আবেদন করেন। দীর্ঘ ১৩ বছর ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সবার আবেদন মঞ্জুর করা হয়। শুরু হয় অনামিকার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়।
জীবনযুদ্ধ পর্ব
পৃথিবীর প্রায় সব দেশের নাগরিক আমেরিকান হতে চায়। অনেকে জানে, এখানকার সংগ্রামী জীবনের কথা। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই জানে না এখানে এলে কী পরিমাণ সংগ্রাম করতে হয় সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার জন্য। এর পরও সারা পৃথিবী থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ এ দেশে মাইগ্রেট করে। অনেকে টিকে যায়, কেউ কেউ ফিরে যায় নিজ নিজ দেশে। আমেরিকান সরকার কয়েক বছর পরপরই অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারীদের এ দেশ থেকে বিতাড়িত করে।
আমেরিকায় অন্য কোনো দেশের শিক্ষাগত সার্টিফিকেট অনুমোদন করে না। তাই অনেকে এখানকার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয় কোনো ডিগ্রি অর্জন অথবা কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে শর্ট কোর্স সম্পন্ন করে কোনো ভালো জব পেতে। অনেকে নিজ নিজ শিক্ষাগত সার্টিফিকেট একটি অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে ইভ্যালুয়েশন করিয়ে মোটামুটি কোনো ভালো জবের চেষ্টা করে। অনামিকাও তার সার্টিফিকেট ইভ্যালুয়েশন করিয়ে একটি প্রি-স্কুলে যোগদান করে। সবই ঠিকঠাকমতো চলে। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় অন্য জায়গায়। অনামিকার ঘনিষ্ঠতম শত্রুও স্বীকার করবে যে শারীরিক ও মানসিকভাবে সে অত্যন্ত শক্তিশালী যোদ্ধা। তাই যখন মোস্তফা উচ্চারণ করে যে বাংলাদেশের এই ভালো জব ছেড়ে আমেরিকার অনিশ্চিত জীবন তার পছন্দ নয়, তখন তা স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করে অনামিকা। প্রকৃতপক্ষে সেও চাইছিল না যে বাংলাদেশের এত সুন্দর জব ছেড়ে এসে মোস্তফা আমেরিকান অড জব করুক। তবে সে চাইছিল মোস্তফা মাঝেমধ্যে এসে তাদের সঙ্গে থাকুক। সেটা অবশ্য মোস্তফা করছিলও। কিন্তু বিদেশ-বিভুঁইয়ে সংসারের কর্তাব্যক্তির দিনের পর দিন অনুপস্থিতি সংসারে যে কত বড় অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করে, তা অনামিকা আগে বোঝেনি। সংসার তো শুধু উপার্জন করা, রান্নাবান্না করা, খাওয়াদাওয়া আর ঘুমানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একটা সংসারে প্রতিদিন অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আর সেটা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব। এখন স্বামী যদি হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থান করে এবং এই দুই স্থানের সময় পার্থক্য যদি আকাশ-পাতাল হয়, তখন সেখানে ছোটখাটো সিদ্ধান্ত গ্রহণও বিরাট ঝুঁকির সৃষ্টি করে। আর ঠিক এ জায়গাতেই অনামিকার সকল ত্যাগ, সকল পরিশ্রম বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।
নিউইয়র্কের পাবলিক স্কুলগুলোতে টিচার অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে কয়েক বছর পরপর অনেক শিক্ষক নিয়োগ দেয়। ওই সব জব টার্গেট করে অনামিকা নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তাকে ভাগ্য বারবার চ্যালেঞ্জ করতে থাকে। কিছুদিন পরপরই স্কুলের জবে টারমিনেশন নোটিশ আসতে থাকে। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান আর্থিক অনিয়ম, কোনোটি অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়ার ফলে এ রকম জব অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। ওদিকে দেশে বেশ কিছু লোন থাকায় মোস্তফা সেসব লোন শোধ করাকেই প্রাধান্য দেয়। ফলে নিউইয়র্কের মতো ব্যয়বহুল শহরে অনামিকার একার আয়ের ওপর তিন-তিনজনকে নির্ভর করতে হয়।
যেসব স্কুলের জব অস্থায়ী হওয়ায় সমস্যা হয় সেসব ক্ষেত্রে জব হারানোর পরদিনই নতুন জবের সন্ধানে আবার সেই কষ্টকর যুদ্ধে নেমে পড়ে অনামিকা। এভাবে সে কুইন্স আর ব্রুকলিনের অনেক স্কুলে সিভি জমা দেয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফলাফল নেগেটিভ। এভাবে খুঁজতে খুঁজতে বাসার কাছেই এক ইলিমেন্টারি স্কুলে জব হয় তার। হাঁপ ছেড়ে বাঁচে ছেলেমেয়ে। ওদের মুখে আবার হাসি ফুটে ওঠে অনেক দিন পর।
উইক ডেজগুলোর প্রতিটি দিন একই রুটিনে চলে। অনামিকা সকালে তার ছেলেমেয়ের নাশতা তৈরি করে নিজেও মুখে কিছু একটা দিয়ে স্কুলের দিকে রওনা দেয়। উইকেন্ডের প্রথম দিন শনিবার। এদিন সবাই দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। নিজ হাতে আটার রুটি তৈরি করে অনামিকা। সঙ্গে থাকে ভাজি আর মিষ্টিজাতীয় কোনো খাবার। কোনো দিন সকালে খিচুড়ি আর ডিম ভাজা। এই দুদিনেই সপ্তাহের বাজার, পুরো সপ্তাহের খাবার রাঁধতে হয়। এভাবে সাপ্তাহিক ছুটির দিনও অন্যান্য দিনের মতোই কর্মব্যস্ত থাকতে হয় সব গৃহিণীকে। সব কাজ-কর্ম শেষে তারা বসে মোবাইল নিয়ে। সপ্তাহের জমে থাকা গল্প ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
এক উইকেন্ডে ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে সাবওয়ে করে জ্যাকসন হাইটসে যাচ্ছিল অনামিকা। হঠাৎ লক্ষ করে, কামরার অপর প্রান্ত থেকে এক তরুণ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছুটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো ও। কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য মৃদু হাসল অনামিকা। জবাবে ছেলেটিও হাসল। এবার সত্যি সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেল ও। ছেলেটি হয় তার পূর্বপরিচিত অথবা সে মানসিকভাবে সুস্থ নয়। উঠে গিয়ে কিছু বলবে কি না ছেলেটিকে তা ভাবছিল অনামিকা। এমন সময় ছেলেটি উঠে এসে তার মুখোমুখি দাঁড়ায়। ম্যাডাম, আপনি কি বাংলাদেশি?
হ্যাঁ। সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল অনামিকা।
আপনি কি কখনো কলেজে শিক্ষকতা করেছেন?
হ্যাঁ। আবারও সংক্ষিপ্ত জবাব দিল অনামিকা। স্মৃতির মানসপটে সে তোলপাড় করে খুঁজে চলেছে ছেলেটিকে।
আমি নেহাল, ম্যাম। ঢাকা ইম্পেরিয়াল কলেজে আপনার সাইকোলজি গ্রুপের ছাত্র।
এবার সবকিছু পরিষ্কার হয়ে আসে অনামিকার। ছেলেটির সঙ্গে অতীতের পথে হাঁটা শুরু করে। অল্পক্ষণ পরেই বাস্তবে ফিরে আসে সে। সিটের এক পাশে সরে গিয়ে ছেলেটিকে বসতে বলে অনামিকা। কিন্তু ছেলেটি না বসে বলে, আপনার মোবাইল নম্বরটি দেন, ম্যাম। আমি পরের স্টপেজে নেমে যাব। সেখানে পিসি রিচার্জ অ্যান্ড সনসের একটি ব্রাঞ্চ আছে। আমি সেখানে জব করি।
পরবর্তী স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে পড়ে নেহাল। তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অনামিকা। মনে হয়, নেহালের সঙ্গে সঙ্গে এক টুকরো বাংলাদেশ হারিয়ে যাচ্ছে দূর থেকে দূরান্তরে।
একদিন অনামিকা স্থানীয় মান্নান সুপার মার্কেটে গেছে সাপ্তাহিক বাজার করতে। সেখানে ছোট ভাইয়ের বউ সূচনার সঙ্গে দেখা। কথা বলতে বলতে দুজনে যার যার সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে থাকে। বাজার শেষে অনামিকাকে জোর করে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যায় সূচনা। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর দুজনে গল্প করতে থাকে। একথা-সেকথার পর সূচনা জিজ্ঞেস করে, আপা, এবার জীবনের কথা বলুন।
মৃদু হাসে অনামিকা। সে তো অনেক কথা। কোনটা শুনতে চাও তা স্পেসিফিক বলো।
মোস্তফা ভাইয়ের সঙ্গে আপনার পরিচিতি পর্ব। মৃদু হাসে সূচনাও।
মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিল অনামিকা, তারপর বলা শুরু করল। তো আমাকে দেখতে এল তোমাদের মোস্তফা ভাই। ওকে নিয়ে এসেছে ভাইয়ার এক বন্ধু। মোখতার ভাই নাকি মোস্তফারও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তো আমি ওদের সামনে গেলাম শুধু চুল আঁচড়িয়েই। আমার উদ্দেশ্য ছিল যদি আমাকে ভালো করে দেখে, তবে এটাই আমি। কিন্তু একবার আমার দিকে তাকিয়েই আর সরাসরি আমার চোখে চোখ রাখেনি ও। মনে হয়, ওই এক দেখাতেই সবকিছু দেখে নিয়েছে আমার!
একেবারে সবকিছু! চোখ মটকালো সূচনা।
জবাবে একটা কিল তুলল অনামিকা। তারপর দুজনই হেসে গড়িয়ে পড়ল। একটু পর আবার বলল সূচনা, আপা, মোস্তফা ভাই।
হ্যাঁ বলছি। তো তোমাদের প্রিয় মোস্তফা ভাই আমার সঙ্গে কোনো কথা বলল না। শুধু মোখতার ভাই-ই টুকটাক কথা চালিয়ে গেলেন। কেন যেন আমার মনে হলো, আমার সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চায় ও। এখানে নয়।
তারপর, তারপর? আগ্রহে সামনের দিকে একটু এগিয়ে এল সূচনা।
মৃদু হাসল অনামিকা। দুদিন বাদে মোখতার ভাই আবার এলেন। আম্মাকে বললেন, আমার সঙ্গে একান্তে কিছু কথা বলতে চায় মোস্তফা। তবে আমাদের বাসায় নয়। তখন তো ঢাকায় এত ভালো ভালো রেস্টুরেন্ট ছিল না। তাই ওর ইচ্ছা বোটানিক্যাল গার্ডেনে আমরা একান্তে কিছু সময় কাটাই। আম্মা দ্বিধা করছেন। আব্বাকে বলা যাবে না। তাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আম্মা। এককথায় রাজি হয়ে গেলাম আমি। কেন জানি ওকে বিশ্বাস করলাম।
তারপর? আগ্রহে এবার চোখ গোল হয়ে এল সূচনার।
তো বোটানিক্যাল গার্ডেনে পৌঁছালাম বেলা এগারোটার দিকে। কথায় কথায় বিকেল হয়ে গেল। প্রচুর খিদে পেয়েছে দুজনেরই। কিন্তু ধারেকাছে কোনো ভালো রেস্টুরেন্ট নেই। একটু থামল অনামিকা।
কে বেশি কথা বলল, আপা?
কে আবার? আমি। দু-একটি কথা বলেই চুপ হয়ে গেছে শাদের বাবা। আর সেদিন আমাকে যেন কথায় পেয়ে বসেছিল।
তারপর, তারপর? কোলের বালিশটাকে দুমড়ে-মুচড়ে নিয়ে বসল সূচনা।
সামনে দাঁড়িয়ে এক চটপটিওয়ালা। আমার দিকে তাকিয়ে বলল ও। কি খাবে? এদিকে কিন্তু তোমাকে নিয়ে বসার মতো কোনো ভালো রেস্টুরেন্ট নেই।
আমি রাজি হলাম। চটপটিটা খেতে বেশ ভালোই লেগেছে সেদিন।
তা তো লাগবেই। বলে খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ল সূচনা।
কিন্তু ঘটনা ঘটল তারপরই।
বলেন কী! রহস্যের গন্ধ পেয়ে সোজা হয়ে বসল সূচনা। কী ঘটল তারপর?
সূচনার আগ্রহ দেখে এবার হেসে ফেলল অনামিকা। চটপটিওয়ালা বেশি দাম চাওয়ায় ওকে মারতে গেল শাদের আব্বা। আমার সামনেই।
এবার হাসিতে গড়িয়ে পড়ল দুজনই। স্কুল থেকে মাঝেমধ্যেই ট্রেনিং করার জন্য বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। এভাবে নিউইয়র্ক সিটির অনেক জায়গা চিনে ফেলল অনামিকা। কিন্তু সমস্যা একটাই। এসব চাকরির স্থায়িত্ব বেশি দিন হয় না। একবার ভাবে অন্য কোনো পেশা বেছে নেবে নাকি। কিন্তু পারে না। বাবা কথাটা শুনতেই রাজি নন। চেষ্টা কর। লাইগ্যা থাক। ইনশা আল্লাহ হবে। আমি দোয়া করতেছি। পেপারে মাঝেমধ্যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়। সিভি নিয়ে সেসব স্কুলে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে একধরনের ক্লান্তি আর হতাশা এসে ঘিরে ধরে অনামিকাকে। তবু হতোদ্যম হয় না ও। পরিচিত অনেকেই তাকে সাহস জোগায়। একটু ধৈর্য ধরো। পাবলিক স্কুলে হায়ারের বিজ্ঞপ্তি এল বলে। শোনা যাচ্ছে এবার বেশ বড় ধরনের হায়ার হবে। নিউইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজনের রেফারেন্সে একজন হিতৈষী এই খবর দিয়েছে। আশায় বুক বাঁধল অনামিকা। আমেরিকায় গ্রীষ্মকালের স্থায়িত্ব মোটামুটি মে মাসের শেষ থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত। এ সময় চারদিকে পিকনিকের ধূম পড়ে যায়। শাদ, ফাতিমাকে নিয়ে দু-তিনটি পিকনিকে অংশগ্রহণ করে অনামিকা। এগুলোর মধ্যে বড় বোন মালিহার আত্মীয়-স্বজনের পিকনিক, নিজ জেলা নারায়ণগঞ্জসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের ভ্যালি স্ট্রিমের পিকনিক এবং দেবর সুজনের পরিচিতদের পিকনিকে প্রতিবছরই অংশগ্রহণ করে তারা। সাধারণত এসব পিকনিক কোনো অঞ্চলের স্টেট পার্কে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রতিবছর এসব ভেন্যু চেঞ্জ করে থাকে সবাই। আমেরিকায় শীতকালীন জীবন অনেক কষ্টের। দিনের স্থায়িত্ব গ্রীষ্মের তুলনায় অনেক কম। অথচ নির্ধারিত কর্মকাণ্ড অনেক। এর ওপর রয়েছে অতিরিক্ত কাপড়চোপড়ের বহর। মানুষের জীবনযাত্রা অনেক সেøা হয়ে যায় এই সময়ে। আজ অনামিকার মনে অনেক আনন্দ। ছেলে শাদ লং আইল্যান্ডের ভ্যালি স্ট্রিমে বাড়ি কিনেছে। জ্যামাইকা থেকে সেই বাড়িতে মুভ করেছে তারা। সারা দিন ধরে ঘর সাজাচ্ছে ও। গুনগুন করে গান গাইছে। অনামিকার সব স্বপ্ন ধীরে ধীরে বাস্তবের মুখ দেখতে শুরু করেছে। আয়নায় নিজের মুখ কিছুক্ষণ দেখল। এখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখীদের একজন ও।
সমাপ্তি পর্ব
অনামিকাদের আমেরিকা পদার্পণ চল্লিশ বছর পূর্ণ হয়েছে। শাদ, ফাতিমা দুজনই বিয়ে করেছে। শাদের বউ জবা দেখতে খুব সুন্দর আর উন্নত মনের। ফাতিমার স্বামীও খুব ম্যানলি আর পরিশ্রমী। ভ্যালি স্ট্রিমের সেই বাড়ি ছেড়ে ওরা এখন একটা বড় ওয়ান ফ্যামিলি বাড়িতে থাকে। ফাতিমার বাড়িই কাছেই। পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়। ওদের দুজনের সংসার আলো করে এসেছে সন্তান। অনামিকার আনন্দ আর ধরে না। সুখ চারদিকে যেন উপচে পড়ছে। এখন আর কাজ করে না ও। বউ জবা সংসারের হাল ধরেছে। অনামিকা কিছুদিন শাদের সংসারে থাকে। আবার কিছুদিন ফাতিমার সঙ্গে।
এত সুখের মধ্যেও অনামিকার মনটা মাঝে মাঝেই খারাপ হয়ে যায়। মানুষটার কথা মনে পড়ে। মোস্তফা আরও কয়েক দিন বেঁচে থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো! সবকিছুতেই আত্মকেন্দ্রিক। বলা নেই, কওয়া নেই, হুট করে মরে গেল। তার সঙ্গে যে অনেক কথা বলা বাকি রয়ে গেল!