সুফি সাহেব মুখের সাদা চাপদাড়ি কেটে ফেলে দিয়ে, মাথার সাদা চুলে কালো কলপ লাগিয়ে নিজের চেহারা দেখে আঁতকে ওঠে। এ কাকে দেখছে! নিজেকে চিনতে পারে না। এ চেহারা তো চোরের মতো লাগছে। নিজের কাছে নিজে লজ্জিত হয়, এটাই কি তাহলে তার আসল চেহারা। মুখভর্তি সফেদ সাদা দাড়ি, মাথায় সাদা চুল দেখে লোকে তাকে বলত, ‘আপনার চেহারায় নুর চমকায়।’ যদিও সে জানত, এটা তোষামোদকারীদের কথা, তারাই ওকে সুফি সাহেব নামকরণ করেছিল। এই নামের আড়ালে আসল নামটা চাপা পড়ে গেছে। এখন সুফি সাহেব নামেই সবার কাছে পরিচিত। যদিও অন্যদল পেছনে ভিন্ন কথা বলে, ‘ওই চেহারার পেছনে চোর বললে ভুল হবে, ডাকাত লুকিয়ে; দেশের সম্পদ ভাগেযোগে লুট করছে।’
সুফি সাহেবের কারও কথায়ই কিছু আসত যেত না। দলের আস্থাভাজন হয়ে মন্ত্রীর পদ পেয়েছে। সেই সুবাদে ব্যবসার ভালো লাইন পেয়ে শনৈঃ শনৈঃ সম্মান, অর্থ, প্রতিপত্তি বেড়েই চলে। সুফি সাহেবের দেশের ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা হাজার কোটি ছাড়িয়েছে। বিদেশের ব্যাংকে পুঁজি বাড়ছে, সেই সঙ্গে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি কেনে। সুখের হাওয়ায় ভর করে ভাসতে থাকে দিন, ক্ষণ, বছর। সুফি সাহেবের মনে হয়, টাকার কাছে সারা পৃথিবী পদানত। কখনো ভাবেনি দৈবাৎ তার জীবনের পট উল্টে যেতে পারে। যার আগে পিছে কত বন্ধু, আত্মীয়-পরিজন ভিড় করে থাকত, তারা পিছপা হয়ে ঘুরে দাঁড়াবে, একটা রাত কারও বাসায় ঠাঁই দেবে না-এমনটা সে ভাবতেও পারেনি। হাজার কোটি টাকাও কাজে লাগাতে পারে না। যৎসামান্য টাকা গামছায় জড়িয়ে কোমরে বেঁধে নেয়। নিজের চেহারা, বেশভুষা পাল্টে নেয়। চেহারা পাল্টে যেমনই দেখা যাক না কেন, পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বর্ডারটা পার হতে পারলেই বাঁচে। সুফি সাহেব এখন অন্য কিছু নিয়ে ভাবে না। শুধু ভাবে জীবনটা নিয়ে বেঁচে থাকার। যাকে বন্ধু ভেবে সঙ্গী করে নিয়েছিল, সে ধরা পড়ে সুফি সাহেবকেও ধরিয়ে দিল। একসময় যে পুলিশ সুফি সাহেবের পিছু ঘুরত, সাংবাদিক ছুটত ক্যামেরা নিয়ে, আজ তারা এসেছে ভিন্ন চেহারায়, সুফি সাহেবকে হাতকড়া পরাতে। সাংবাদিক এসেছে সেই দৃশ্যের ছবি তুলতে। সুফি সাহেবকে প্রিজন ভ্যানে তোলা হলো। অন্যদের সঙ্গে গাদাগাদি করে গাড়ির রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। যার দামি গাড়িগুলো লুটেরা ভাগাভাগি করে লুট করছে। সবাইকে থানাহাজতে এনে জড়ো করা হলো, ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সুফি সাহেব এক কোণে মাথা নিচু করে বসে থাকে। শরীরটা ক্লান্তিতে অবসন্ন। গায়ের গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে জবজবে। ঘুমের ঝিমুনিতে মাথাটা বার কয়েক ঘাড় থেকে ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ে। যাকে গদি আটা বিছানায় এয়ারকন্ডিশন ছেড়ে কাজের ছেলে গা টিপে ঘুম পাড়াত, সেই মানুষটা আজ এদিক-ওদিক তাকায় উদাস দৃষ্টিতে শোয়ার জায়গা খুঁজে। অগত্যা দেয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ বুজে। বুকের ভেতরটা অপমানের তীক্ষè নখর দিয়ে আঁচড় কেটে রক্তাক্ত করতে থাকে। দামি ফার্নিচারে সাজানো প্রাসাদোসম বাড়ি, আত্মীয়-পরিজন-সব মাথা থেকে সরে যায়, শুধু অনুভব হয় হৃৎপিণ্ডের ধুঁকধুঁক নিঃশ্বাসের ওঠানামা।