নিউইয়র্কের শরৎকাল। পাতার রং বদলাচ্ছে, সোনালি থেকে লাল, তারপর বাদামি হয়ে মাটিতে ঝরে পড়ছে। ব্রুকলিনের এক প্রান্তে চারতলা ব্রাউনস্টোন বাড়ির এক ফ্লোরে সাজসজ্জা চলছে জোর কদমে। আলো-ঝলমলে লাইট, টেবিলে সাজানো নানা রকম খাবার, জানালায় নীল পর্দা।
আজ সুবহার জন্মদিন।
সুবহার মা মাহফুজা রহমানের বাসার লিভিং রুমটা আজ অদ্ভুত এক আন্তর্জাতিক শব্দে ভরপুর। বাংলাদেশি গজল, আরবি পপ এবং সেলিনা গোমেজের ইংলিশ গানের একটা মিশ্র সিম্ফনি বাজছে।
দেয়ালে ঝোলানো ‘Happy 30th Birthday Subah’ ব্যানারটার নিচে দাঁড়িয়ে সুবহা সালসাবিল তার ফিলিপিনো বন্ধু মারিয়ার সঙ্গে সেলফি তুলছে।
‘Girl, you are thirty, flirty and thriving’
মারিয়া চিৎকার করে বলল, তার এক গ্লাস মার্গারিটা উঁচু করে।
‘Damn right!’ সুবহা হেসে উত্তর দিল, তার হাতে থাকা inger ale এর গ্লাস দিয়ে মারিয়ার গ্লাসে টোকা দিয়ে।
কোনায় বসে সুবহার মা মাহফুজা রহমান তার আমেরিকান সহকর্মী লিন্ডা ও জেনিফারের সঙ্গে গল্প করছিলেন। লিন্ডা তার পিনোট নয়ার গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, ‘I still can’t get over your story, Mahfuza. Leaving a successful medical career back home, starting over as a nurse here in your forties? That’s some serious grit.’ (আমি এখনো তোমার গল্পটা ভুলতে পারি না, মাহফুজা। দেশের সফল চিকিৎসকের ক্যারিয়ার ছেড়ে চল্লিশের বেশি বয়সে এখানে এসে নার্স হিসেবে নতুন করে শুরু করলে? এটা আশ্চর্য ব্যাপার নয়?)
মাহফুজা একটু হেসে বললেন, ‘Well, you know what they say? When life gives you lemons, ...you make a whiskey sour!’ (ওই যে কথায় আছে না-জীবন যখন তোমাকে লেবু উপহার দেয়, তুমি তা দিয়ে লেবুর শরবত বানানোর পরিবর্তে সেটা হুইস্কিতে ঢেলে তেতো বানিয়ে নাও!)
মাহফুজার এই শ্লেষাত্মক পরিহাসে জেনিফার তার গ্লাস উঁচু করে ইন্টারাপ্ট করল।
সবাই হেসে উঠল।
বাংলাদেশ থেকে নিউইয়র্ক শহরে আসা নবাগত অভিবাসী পরিবারের আমানতউল্লাহ, তার স্ত্রী এবং আরও কয়েকজন এসে মাহফুজার কাছে বসলেন। আমানতউল্লাহর চোখ ঘুরছে রুমজুড়ে।
আমানতউল্লাহ বিস্মিত কণ্ঠে বলেন, ‘মাহফুজা আপা, এক্কেরে আমেরিকান হইয়া গেছেন নাকি?’ আমানতউল্লাহ হেসে বললেন, ‘খুব ভালো লাগতেছে দেখে। কিন্তু... এত লোক, হইচই, আপনার স্বামী? শাহরিয়ার ভাই? তিনি নাই? সুবহার বাবার তো থাকার কথা...’
একপ্রকার নীরবতা নেমে এল। মাহফুজার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। লিন্ডা আর জেনিফার অস্বস্তিতে একে অপরের দিকে তাকাল।
‘ও...তিনি...আসবেন। ব্যস্ত আছেন সম্ভবত,’ মাহফুজা সংক্ষেপে বললেন। তারপর জোর করে কথাটা ঘুরিয়ে দিলেন, ‘আপনারা কিছু খাবার নিন না। বিরিয়ানি আর রোস্ট টার্কি চিকেন, বিফ, মটন ইলিশ, রুই মাছ সবই আছে, যা ইচ্ছা একটু করে টেস্ট করেন।’
আমানতউল্লাহ বুঝতে পারলেন, তিনি কোনো না কোনো অদৃশ্য সীমানা অতিক্রম করে ফেলেছেন। তিনি নীরব হলেন কিন্তু তার কৌতূহল দমে গেল না।
বাংলাদেশি আত্মীয়স্বজনেরা এক কোণে বসে আড্ডা দিচ্ছে।
সুবহার এক চাচাতো ভাই বলল, ‘সুবহা, তুই এখন থার্টিতে পা দিলি। এবার একটা সেটেলড ডাউন হওয়ার পালা। বিয়েটিয়ের পরিকল্পনা নাই?’
সুবহা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘Oh, for GodÕs sake, Bhaiya! Settle down? I just started living! আমার ক্যারিয়ার, আমার বন্ধুবান্ধব, আমার freedom... এগুলো নিয়ে আমি বেশ খুশি। Marriage isnÕt the ultimate life goal, you know’
তার এল সালভাদরের বন্ধু কার্লোস, যে তিনটি হুইস্কি সোডা ইতিমধ্যে গলাধঃকরণ করেছে, সে চিৎকার করে বলল, ‘ThatÕs my girl! You donÕt need a man! You need more tequila’ (ওহে বালিকা! তোমার কোনো পুরুষের প্রয়োজন নেই? তুমি কি শুধু খাদ্য আর পানীয় নিয়েই ফুর্তি করবে?)
সবাই আবার হাসতে লাগল।
সুবহার ভারতীয় প্রতিবেশী প্রিয়া, যে মারাঠি মহিলা সবুজ কুর্তি লেহেঙ্গা পরে এসেছে, সে হিন্দি ও ইংরেজির সংমিশ্রণে বলল, ‘But beta, having a partner, a family, itÕs nice also-na? একলা লাগে না?’
‘কখনোই না, প্রিয়া অঁহঃরব!’ সুবহা জোর দিয়ে বলল, ‘I have my mom. SheÕs my rock. আমার বাবাও তো আছেন।’ সে বলল, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর একটু নিচু হয়ে গেল। সে অজ্ঞাতেই মাস্টার বেডরুমের বন্ধ দরজার দিকে তাকাল।
আমানতউল্লাহর চোখও সেই দরজার দিকে গেল। দরজাটা বন্ধ। নিঃশব্দ। পুরো পার্টির উৎসব থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন। তার মনে হলো, দরজার নিচ দিয়ে একটা আলো পড়েছে, মানে ভেতরে কেউ আছে।
একপর্যায়ে আমানতউল্লাহর কৌতূহল আরও বাড়ল। তিনি পাশের এক বাঙালি ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই মেয়ে তো বাবার আদরের, তার জন্মদিনে বাবা কোথায়?’
ভদ্রলোক দ্বিধা করে উত্তর দিলেন, ‘তিনি তো এখানেই আছেন, তবে মাস্টার বেডরুমে থাকেন।’
আমানতউল্লাহ অবাক হয়ে বললেন, ‘একই ঘরে থাকেন, অথচ এখানে আসেন না?’
ভদ্রলোক ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সংসারের হিসাব মেলে না, ভাই। এখানে অনেক বিয়ে ভাঙে, আবার মানুষ এক ছাদের নিচে থেকেও আলাদা হয়ে যায়।’
শেষ পর্যন্ত কেক কাটার সময় এল। সুবহা তার বন্ধুদের নিয়ে গোল করে দাঁড়াল। একটি বিশাল, তিনতলা চকলেট কেক, তাতে জ্বলজ্বল করছে ৩০টি মোমবাতি। সবাই ‘Happy Birthday’ গান গাইতে শুরু করল।
মাহফুজা তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে চোখের কোণটা মুছলেন। তারপর তিনি দ্বিধাগ্রস্তভাবে মাস্টার বেডরুমের দরজার দিকে তাকালেন।
গান শেষ হওয়ার ঠিক আগেই... ক্রিইইক... করে শব্দ হলো।
সবাই থেমে গেল। মাস্টার বেডরুমের দরজা ধীরে ধীরে খুলল।
দরজা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে ছিলেন শাহরিয়ার রহমান-সুবহার বাবা। তিনি পরিপাটি প্যান্ট, টি শার্টে পরেছেন, কিন্তু তার চেহারায় কোনো উৎসবের আমেজ নেই। একটা গভীর অন্ধকার, বিরক্তি আর বিচ্ছিন্নতা যেন তার মুখে সেঁটে আছে।
সবাই নিঃশব্দ। শুধু মোমবাতির সলতে জ্বলার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
সুবহা নরম গলায় বলল, ‘Baba? Will you join me?’
শাহরিয়ার কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি শুধু এগিয়ে এসে কেকের টেবিলের পাশে দাঁড়ালেন। তিনি মাহফুজার দিকে তাকালেন না। তিনি কারও দিকে তাকালেন না।
সুবহা নিঃশ্বাস নিয়ে মোমবাতিগুলো ফুঁ দিতে গেল। শাহরিয়ারের মুখে একটা অতিক্ষীণ, প্রায় অদৃশ্য স্নেহের আভাস মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠল। তিনি তার মেয়ের দিকে এক সেকেন্ডের জন্য তাকালেন। তারপর তিনি অন্যরা যা করছে যন্ত্রের মতো তা-ই করলেন। তিনি কেকের পাশে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে থাকলেন।
এরপর কেক কাটা হলো। সবাই হাততালি দিল। শাহরিয়ার এক টুকরো কেক নিলেন, একটি চামচ সুবহার মুখে তুলে দিলেন, চামচটি ঘুরিয়ে সুবহাও চামচে থাকা কেকের অবশিষ্টাংশ তার বাবার মুখে তুলে দিল।
তারপর কোনো কথাবার্তা না বলে একই নিঃশব্দ পায়ে তিনি তার ঘরের দিকে চলে গেলেন । দরজা বন্ধ হওয়ার আগে তিনি একবার পেছন ফিরে তাকালেন-সেই দৃষ্টি সরাসরি মাহফুজাকে স্পর্শ করল, যাতে ছিল তিরিশ বছরের স্মৃতি, বিশ্বাস-অবিশ্বাস এবং দাম্পত্য বিরোধ ও বিচ্ছেদের তিক্ত অধ্যায়ের ভাঙা সেতুর ওপর পলক দৃষ্টিপাত।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ক্লিক... চাবি আবার ঘুরল।
পুরো রুমটা নিস্তব্ধ, তারপর ধীরে ধীরে আবার কথাবার্তা, হাসি শুরু হলো, কিন্তু সেটা আগের মতো স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না।
আমানতউল্লাহ এই পুরো দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেছেন। তিনি এক পাশে সরে গেলেন, তার হাতে থাকা এক গ্লাস শরবত নিয়ে। তিনি দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন, মাস্টার বেডরুমের সেই বন্ধ দরজার দিকে তাকালেন। তার মনে হচ্ছিল, এই দরজাটা শুধু একটি কক্ষকে বন্ধ করে রাখেনি, এটি একটি পুরো জীবন একাকিত্বে এবং বিচ্ছিন্নতায় আবদ্ধ করে রেখেছে।
কিছুক্ষণ পর তিনি দেখলেন মাহফুজা আর সুবহা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। মাহফুজা বললেন, ‘শোনো সুবহা, তুমি যেভাবে চাইবে জীবন কাটাবে, আমি তাতে বাধা দেব না। কিন্তু মনে রেখো, একাকিত্বেরও একটা ভার আছে।’ সুবহা দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘মা, আমি স্বাধীন থাকতে চাই। সংসারের নামে যন্ত্রণা ভোগ করতে চাই না।’
মাহফুজা মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘তাহলে অন্তত মনে রেখো, দরজা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ো না। আলো যেন নিভে না যায়।’
‘বাবার সঙ্গে তুমিও তো অনেক আশা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে সুখের আশায় এ দেশে পাড়ি জমিয়েছিলে মা! তুমি কি সুখ পেয়েছ? কেন আদালতের আদেশে বিচ্ছেদের পর একই ছাদের নিচে তুমি এবং বাবা আলাদাভাবে বাস করো? বাবার ঠিকানা হয় শুধুই মাস্টার বেডরুমে?’
মাহফুজা রহমান আশা করেছিলেন, আজকের এই আনন্দঘন দিনে তিনি তার মেয়েকে বিয়েতে রাজি করাবেন। কিন্তু তার আশা নিরাশায় পরিণত হলো। তিনি জানেন, তিনি এই বাকপটু মেয়ের সঙ্গে কথায় পারবেন না। তাই হাল ছেড়ে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে মুখে হাসির অভিনয় টেনে অতিথিদের মাঝে মিশে গেলেন। আমানতউল্লাহর কেমন জানি দম বন্ধ হয়ে এল। তিনি অনুভব করলেনÑএই প্রজন্মের কাছে সংসার মানে আর বাঁধন নয়, বরং স্বাধীনতা।
‘ও... এইটা হইলো মাস্টার বেডরুমের দরজা বন্ধ থাকার রহস্য? এটা তো একটা জীবন্ত কবর... একজন মানুষের বসতঘর নয়, একই ছাদের নিচে, একই বাতাসে, কিন্তু আলাদা মহাকাশে... আহ... Allah....’
তিনি ফিসফিস করে শুধু নিজেকেই শুনিয়ে বললেন, হায়রে জীবন!
তার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তিনি শুধু সেই বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন, যেন সেখানে তিনি জীবন উপভোগ করতে আসা জীবনের কাছে প্রতারিত দুটি নিঃসঙ্গ জীবনের একটি করুণ চিত্র দেখতে পেয়েছেন। পার্টিতে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের নানাবিধ আওয়াজ হচ্ছিল কিন্তু আমানতউল্লাহর কানে এখন সেটা বিরক্তিকর শোনাচ্ছিল। এই সমাজে নতুন আগমনকারী এই বয়স্ক বাংলাদেশি ভদ্রলোক যেন একটা বিরাট কালচারাল ধাক্কা অনুভব করেন। পুরো বিষয়টা তার কাছে মনে হয় যেন-উজ্জ্বল রঙিন কাগজে মোড়ানো উপহারের বাক্স, যার ভেতরটা সম্পূর্ণ ফাঁপা।
রাস্তার নিয়ন বাতিগুলো তখন উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছিল। আমানতউল্লাহ গাড়িতে উঠলেন স্তব্ধ হয়ে। তার চোখে ভাসতে থাকে সেই বন্ধ মাস্টার বেডরুমের বন্ধ দরজার ছবি। -লং আইল্যান্ড, নিউইয়র্ক, ইউএসএ।