Thikana News
১৭ অক্টোবর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

এমন যদি হতো

এমন যদি হতো



 
আজও কাজে দেরি করে ফেলল নাফিসা। অনেক চেষ্টা করেও এড়াতে পারল না। সুপারভাইজার সুজানের মুখটা গম্ভীর। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। এটাই সাদাদের বৈশিষ্ট্য। ওরা মুখে কিছু বলে না। কাজের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয়। আজ হয়তো-বা আরেকটা ওয়ার্নিং ইমেইল পাবে ও। নিজেকে সতর্ক করল নাফিসা। আর নয়। তাহলে এই ভালো জবটা হারাবে। এবার সব চিন্তা মন থেকে সরিয়ে দিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল ও।
একটি সরকারি অফিসে জব করে নাফিসা। ফেডারেল অফিস এটা। এখানে ম্যাটার অ্যানালিস্ট ও। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও করেছে গত দুই বছরে। সুপারভাইজার সুজান ওর কাজে খুব সন্তুষ্ট। ইঙ্গিত দিয়েছে এভাবে আর কিছুদিন পরিশ্রম করতে পারলে কপালে নিশ্চিন্ত প্রমোশন। কিন্তু তার পরই এসব ঘটছে। অফিসে দেরি করে আসা, কাজে ভুল, সবকিছু ওলটপালট করে দিচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও এসব এড়াতে পারছে না ও।

অস্ট্রেলিয়ার একটি ইউনিভার্সিটি থেকে ফিজিক্সে মাস্টার্স করেছে নাফিসা। সেখানে জবের অফার থাকলেও ও পাড়ি জমিয়েছে আমেরিকায়। কারণ বিয়ে। ওর স্বামী নিউইয়র্কের সেন্ট জনস ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। এখানে এসে কাজ পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার ওর প্রফেসরের রিকমেন্ডেশন লেটার ওর জব পেতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
একনাগাড়ে কাজ করে চলেছে নাফিসা। লাঞ্চ আওয়ার অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। আরেকটু আরেকটু করতে করতে একসময় মাসখানেক পাওয়া অ্যাসাইনমেন্টটা ওয়েলডান করে ফেলল নাফিসা। সঙ্গে সঙ্গেই রেজাল্ট সুজানের কাছে ইমেইল করল ও। তারপর লাঞ্চ করতে বসল। লাঞ্চ শেষের পথে, এমন সময় সুজান এল হাসতে হাসতে। ‘ওয়েলডান নাফিসা, ওয়েলডান। এক্সিলেন্ট জব। আয়াম রিয়েলি প্রাউড অব ইউ।’ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল নাফিসা। আজ তাহলে আর ওয়ার্নিং নোটিশ আসছে না। নিজেকে অনেকটা ভারমুক্ত মনে হলো নাফিসার।

সন্ধ্যায় আকাশের দিকে তাকিয়ে আবেগে বিহ্বল হলো নাফিসা। আজ ভরা পূর্ণিমা! চাঁদের নরম, স্নিগ্ধ আলোয় চারদিক ভরে গেছে। আবুকে স্টাডি টেবিল থেকে একরকম টেনে ওঠাল ও। তারপর দুজন কাছের ক্যাপ্টেন টিলি পার্কে পায়ে পায়ে চলে এল। আবুকে একটা বেঞ্চে বসিয়ে সামনের ঘাসে জুতা খুলে নেমে পড়ল। হেমন্তকাল। মৃদু শিশিরে ঘাসগুলো যেন গোসল করেছে। ধীরে ধীরে পায়চারি করছে নাফিসা। মাঝে মাঝেই চোখ তুলে প্রাণভরে মমতাময়ী চাঁদকে দেখছে। অনেক স্মৃতি মনে ভেসে আসছে। এবার ফিসফিসিয়ে চাঁদের সাথে কথা বলা শুরু করল ও। ‘ও চাঁদ, তুমি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছ? আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? তোমাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম মায়ের কোলে শুয়ে। কত হবে আমার বয়স তখন? হয়তো-বা কয়েক মাস। আমাকে কোলে নিয়ে জানালার ধারে বসেছিলেন তিনি। তারপর তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেনÑচাঁদ মামা! সেদিনও এ রকমভাবে চারদিকে আলো ছড়াচ্ছিলে তুমি। আমি তন্ময় হয়ে দেখছিলাম তোমাকে। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল হাত বাড়িয়ে তোমাকে ধরি। ঠিক যেমনটা মাকে ধরি। কিন্তু তুমি যে অনেক দূরে, এটা আমি সেই বয়সেই বুঝেছিলাম। তোমাকে মায়ের মতো ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। আচ্ছা চাঁদ, তোমার কি জিপিএস আছে? সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ একসঙ্গে তোমাকে দেখে। তুমি কি দেখতে পাও সবাইকে? তোমাকে নিয়ে মানুষ বিভিন্ন ভাষায় কবিতা, গল্প লেখে। তুমি কি জানো সেটা? ও চাঁদ, ও চাঁদ মামা, আজ যে তোমাকে ধরতে, তোমাকে একটু ছুঁতে বড্ড ইচ্ছে করছে। তুমি কি নেমে আসবে আমার কাছে? আমার যে রকেট নেই। তোমার কাছে আমি যে যেতে পারছি না। আমার বড্ড কষ্ট, চাঁদ মামা, বড্ড কষ্ট!

২. আজ উইকেন্ডের প্রথম দিন। সপ্তাহের উইক ডেজগুলোতে সবারই থাকে প্রচণ্ড ব্যস্ততা। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই কাজে যাবার তাড়াহুড়ো সবার মাঝেই কমন। ঠিক তেমনি উইকেন্ডের দিন দুটিও অনেকটা একই নিয়মে সবার মাঝে আসে-যায়। সকালে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা, বাইরে কোথাও দুপুরের খাবারটি খেয়ে নেওয়া, কোথাও দাওয়াত থাকলে অ্যাটেন্ড করা, ব্যস্ততা না থাকলে বিকেলে পার্কে বসে সময় কাটানো। অবশ্য শীতকালের কথা আলাদা। তখন পার্কের ঘাস, লেক থাকলে লেকের উপরিভাগের পানি পুরু বরফের চাদরে মোড়ানো থাকে। তখন কাজ শেষে কখন বাড়ি পৌঁছাবে, সেই চিন্তায় অস্থির থাকে সবাই। উইকেন্ডের দিন দুটিতে তখন ব্যস্ততা থাকে সাপ্তাহিক বাজার আর দাওয়াত রক্ষা, দাওয়াত দেওয়ায়। বছরের আর সব সিজনে উইকেন্ডের দিন দুটি সবার একটু সেøাই যায়।
আজ উইকেন্ডের প্রথম দিন- শনিবার। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর আবু গেছে হিলসাইডে রেস্টুরেন্টে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। অখণ্ড অবসর এখন নাফিসার হাতে।

দেশে ছোটবেলা থেকেই নাচ শেখার প্রতি এক দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল নাফিসার। বান্ধবীদের সাথে নাচের স্কুলে গিয়েছেও কয়েকবার। অবশেষে একদিন বাবা জানতে পেরে মন খারাপ করলেন। বাবা ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু। নাফিসা তার কনিষ্ঠ আর অত্যন্ত আদরের সন্তান। তিনি ধীর-স্থিরভাবে বোঝালেন নাফিসাকে। ধর্মের বিরুদ্ধে যেতে নেই। তাতে সার্বিকভাবে অমঙ্গল হয়। বাবার সেই বোঝানোর ধৈর্যে অবাক হয়েছে নাফিসা। বুঝেছে সবকিছুই। বাবা একদিকে তার মনে কোনো আঘাত দিতে চাচ্ছেন না, অন্যদিকে ধর্মের অনুশাসনও ভাঙতে নারাজ। ও বাবার মনের এই দোদুল্যমানতা বুঝতে পারল। আর তাতেই বাবার প্রতি একধরনের আজীবন কৃতজ্ঞতা অনুভব করল।
অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব ক্যানবেরায় পড়াশোনা করেছে নাফিসা। থাকত আর্সকট হাউসে। একদিন সন্ধ্যায় লাইব্রেরিতে যাওয়ার সময় ফয়েরের পাশের কাচঘেরা রুমে কিছু ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি তাকে সেখানে নিয়ে গেল। নাচের ক্লাস ছিল সেটা। আধা ঘণ্টা তন্ময় হয়ে দেখল নাফিসা। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাইব্রেরির দিকে এগিয়ে গেল।

সেদিন বাসায় ফেরার পথে হিলসাইড অ্যাভিনিউয়ের ১৭৫ স্ট্রিটে একটি নাচের স্কুলের সাইনবোর্ড দেখেছিল। আজ বিকেলে পায়ে পায়ে সেই নাচের স্কুলে গিয়ে হাজির হলো নাফিসা। এখনো ভর্তি চলছে। সাথে সাথে ভর্তি হয়ে গেল ও। পাশের রুমে নাচের ক্লাস। সেখানে ম্যানেজার তাকে নিয়ে গেল। একজন সাদা ভদ্রমহিলা নাচ শেখাচ্ছেন। তিনি নাচে একটু বিরতি দিয়ে নাফিসার দিকে এগিয়ে এলেন। হাই, আয়াম ক্যারোলাইন। তার বাড়িয়ে দেওয়া হাত চরম আবেগে আঁকড়ে ধরল নাফিসা। নিজের নাম বলল। ওয়ানা লারন ডান্স? মাথা উঁচু-নিচু করল ও। ভাবাবেগে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কল্পনায় নিজেকে ছোটবেলার সেই নাচের স্কুলে দেখতে পাচ্ছে। হুইচ কাইন্ড অব ডান্স ইউ প্রেফার? ওয়ালটজ, সংক্ষেপে জবাব দিল নাফিসা। যেন ওর ভেতরের অন্য এক নাফিসা আজ কথা বলে উঠেছে। পারফেক্ট, বলল ক্যারোলাইন। এসো, তোমাকে প্রাথমিক স্টেপিংগুলো শিখিয়ে দিই।

রুমের এক পাশে চলে এল দুজন। ক্যারোলাইন প্রথমে স্টেপিংগুলো ফেলল : ১-২-৩ ফরোয়ার্ড, ১-২-৩ ব্যাকওয়ার্ড। নাও সুইট হার্ট, ডান্স উইথ মি। প্রথম প্রথম ভুল হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই রিদমগুলো ধরে ফেলল নাফিসা। এরপর প্রায় আধা ঘণ্টা ক্যারোলাইনের সাথে অনুশীলন করল নাফিসা। ব্যাগে ওর মোবাইল বাজছে। আজকের মতো নাচ শেখায় সমাপ্তি টানল নাফিসা।
আবুকে ‘আধা ঘণ্টার মধ্যে ফিরছি’ বলে ধীর পায়ে বাসার ফিরতি পথ ধরল নাফিসা। এ সময় ওর বাবার কথা মনে পড়ল। মাথার উপর আকাশে চাঁদের দিকে তাকাল। বাবা, তুমি কি ওই সুদূর নক্ষত্রের রাজ্য থেকে শুনতে পাচ্ছ? আমি আজ ওয়ালটজ নেচেছি। তুমিও দেখলে খুশি হতে। নাফিসার মনে হলো চাঁদের আলো যেন হঠাৎ বেড়ে গেছে। একটা ঠান্ডা হাওয়া এসে ওর দেহ-মন জুড়িয়ে দিয়ে গেল।
একসময় হু হু করে কান্নায় ভেঙে পড়ল নাফিসা। স্পষ্ট জানে, বাবা উপর থেকে তাকে আশীর্বাদ করছেন।
৩. আজ রোববার। নাফিসাদের পাশের বাড়ির জাহানারা ভাবি এল বেড়াতে। কিছুক্ষণ গল্প করার পর সে বলল, চলুন, হিলসাইড অ্যাভিনিউতে যাই। সেখানে পানশি রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া দুটোই জমবে ভালো। 
সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেল নাফিসা। ইউনিভার্সিটিতে জরুরি মিটিং থাকায় সকালেই বেরিয়ে গেছে আবু। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। ওরাই লাঞ্চের ব্যবস্থা করবে। পাঁচ মিনিট ভাবি, আমি রেডি হয়ে আসছি।

পানশি রেস্টুরেন্ট এমনিতে বেশ ভরাট থাকে। আজকে কোনো কারণে মানুষের ভিড় একটু কম। ওরা দুজন রেস্টুরেন্টের ভেতরের অংশে পেছনের দিকে একটা টেবিলে বসল। কিছুক্ষণ গল্প করার পর লাঞ্চের অর্ডার দিল জাহানারা। খেতে খেতে এবার নিজের গল্প বলা শুরু করল। জানেন তো ভাবি, ছেলেদের সব সময় চোখে চোখে রাখতে হয়। আপনার ভাই আর আমার সুখের সংসার। দীর্ঘ দশ বছর আমাদের মধ্যে কোনো বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়নি। আল্লাহ আমাদের দুটি সন্তানও উপহার দিয়েছেন এই সময়ে। একটু বিরতি নিল জাহানারা। তারপর আবার শুরু করল, গতকাল কী মনে হলো দীপ্তির আব্বার মোবাইলটা চেক করলাম। পাসওয়ার্ড আমার জানা। দেখি মেসেঞ্জারে এক স্প্যানিশ মহিলা কলিগের সঙ্গে অনেক দিন ধরে চ্যাটিং করছে। ওদের সম্পর্কটা এখন সিরিয়াস দিকে টার্ন নিয়েছে। আমি এখন কী করব, ভাবি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল জাহানারা।

বিচলিত বোধ করল নাফিসা। বাসা হলে কথা ছিল। এখন কীভাবে জাহানারাকে শান্ত করবে ও! ভাবির হাতে আলতো করে চাপ দিল ও। ভাবি, আমরা বরং আমাদের বাসায় গিয়ে আলাপ করি। এখানে অনেক মানুষ। মাথা নাড়ল প্রতিবেশী।
আবারও নিজেদের লিভিং রুমে এসে বসল ওরা। শুরু করল নাফিসা। ভাবি, আমার মনে হয়, আপনার কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে। মিজান ভাই সংসারের সবার সুখের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করছেন। প্রায়ই তিনি ওভারটাইম করেন। অফিসেও তার সুনাম আছে। তিনি কীভাবে তার স্প্যানিশ মহিলা কলিগের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক গড়ে তুলবেন?
আরে ভাবি, জাহানারা জবাব দিল, পুরুষদের শতভাগ বিশ্বাস করতে নেই। হোক না সে স্বামী। আমি ওই মহিলার ছবি আর ওদের চ্যাটিংয়ের কিছু স্ক্রিনশট নিয়েছি। আপনাকে দেখাচ্ছি ওসব।

সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল নাফিসা। আসলে ওদের দুজনের মধ্যকার সম্পর্ক অনেক গভীরে চলে গেছে।
দেখেছেন ভাবি, জাহানারা আবার শুরু করল, ওই মহিলা বেশ সুন্দরী। তার ওপর স্প্যানিশ! ওদের কাছে সেক্স করা একটা মামুলি ব্যাপার। এদিকে আমার দিকে তাকিয়ে দেখুন। পঁয়তাল্লিশ বছর হলো আমার। চেহারায় কি আর কিছু অবশিষ্ট আছে! সংসারের জন্য খাটতে খাটতে শেষ হয়ে গেছি। আমি বুড়ো হয়ে গেছি ভাবি, আমি বুড়ো হয়ে গেছি ওর কাছে।
ভাবি, এবার নাফিসা শুরু করল, আমি এখনো পুরোপুরি কনভিন্সড নই। আমার মনে হয়, সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। আপনি মিজান ভাইয়ের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করুন। নিশ্চয় দুজনে একটা সন্তোষজনক সমাধানে আসবেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জাহানারা। আপনি ঠিকই বলেছেন। আজই ওর সঙ্গে বসতে হবে আমাকে।
জাহানারা বিদায় নেওয়ার পর এবার নিজের সংসারের কথা ভাবল নাফিসা। আজ তো রোববার। সব অফিস-আদালত বন্ধ। এই প্রথম রোববার ইউনিভার্সিটিতে গেল আবু। নাকি অন্য কোথাও! আর ভাবতে পারে না নাফিসা। মাথাটা হঠাৎ করে ঘুরে ওঠে। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে।
একসময় জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ও।

৪. চোখ মেলে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করল নাফিসা। পাশে উদ্বিগ্ন মুখে বসে রয়েছে আবু। নাফিসা চোখ মেলতেই ওর কাছে আবু সরে এল।
এখন কেমন লাগছে? শুকনো মুখে জিজ্ঞেস করল আবু।
ভালো। তোমার মিটিং ভালো হয়েছে?
হ্যাঁ, অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি আমরা। বলল আবু।
তোমার নিজের ব্যাপারেও? বলে তির্যক দৃষ্টিতে আবুর দিকে তাকাল নাফিসা।
একটু অবাক হলো আবু। মিটিংয়ে আমার নিজের ব্যাপারে আলোচনা হবে কেন! এটা তো আমাদের ডিপার্টমেন্টের মিটিং। এবার নাফিসার দিকে তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকাল আবু। তোমার কী হয়েছে বলো তো? বাসায় কী হয়েছিল, যার জন্য তুমি জ্ঞান হারালে? তোমার তো সে রকম কোনো অসুখ নেই।

ও কিছু না। স্বাভাবিক হলো নাফিসা। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হঠাৎ করে কী যে হলো, সেটা আমিও বুঝতে পারছি না। চলো, বাড়ি যাই।
হ্যাঁ যাব। তোমাকে রিলিজ দিলেই চলে যাব। ওই যে ডাক্তার সাহেব আসছেন।
এই তো তোমার জ্ঞান ফিরেছে! মৃদু হাসল হোয়াইট লেডি ডাক্তার। ব্লাডে কিছু পাওয়া যায়নি। শুধু ইউরিন টেস্টটা বাকি। ওটা হয়ে গেলেই তোমাকে আমরা রিলিজ করে দেব। ওই তো নার্স আসছে সবকিছু নিয়ে। অন্য রোগীর কাছে চলে গেল ডাক্তার।
নার্স এসে ইউরিন সংগ্রহের একটা কন্টেইনার নাফিসার হাতে তুলে দিল। তারপর বুঝিয়ে দিল কী করতে হবে।
ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল নাফিসা।

রেজাল্ট নিয়ে এল হাসিমুখে ডাক্তারই। ইয়াং লেডি, তুমি কিছু টের পাওনি এত দিন?
মাথা দুদিকে নাড়াল নাফিসা। আবুর মনে হলো সময় খুব ধীরে এগোচ্ছে।
তুমি মা হতে চলেছ, মাই ডিয়ার। কনগ্রাচুলেশনস বোথ অব ইউ।
হঠাৎ করেই একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরল নাফিসাকে। দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে নিল। অবরুদ্ধ আবেগে আবু শুধু উচ্চারণ করল, নাফিসা, আমরা মা-বাবা হতে চলেছি!

৫. কে মেয়েটি? আর কেনই-বা তাকে এভাবে বিব্রত করছে? আজও নিজেকে প্রশ্ন করল আবু।
মাসখানেক আগে মেয়েটির সঙ্গে তার পরিচয়। তার ক্লাসেরই একজন ও। ক্লাস শেষে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল আবু। পেছন থেকে তাকে ধরে ফেলে মেয়েটি। নিজের নাম বলল প্রভা। কথা বলতে বলতেই তার রুমে প্রবেশ করল আবু। অনুমতি নিয়েই রুমে ঢুকল প্রভা। বেশ কিছুক্ষণ নিজের কথা বলে গেল। মনে মনে একটু বিরক্ত হলো আবু। প্রভা যেসব কথা বলছে, তা একজন ক্লাসমেটের সঙ্গে মানিয়ে যায়। কিন্তু সে তো! বিকালের ক্লাসের প্রস্তুতি নেওয়ার প্ল্যান ছিল আবুর। কিন্তু প্রভা ওঠার নাম করছে না। অবশেষে বাধ্য হয়ে ওকে বিকালের ক্লাসের কথা বলল আবু। সরি, সরি বলে উঠে দাঁড়াল প্রভা।
আমি কি মাঝেমধ্যে আপনার কাছে আসতে পারি? প্রভা জিজ্ঞেস করল আবুকে। এখানে আমি নতুন। দেশি কাউকে পাচ্ছি না, যার সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারি।

একজনও পেলেন না? এবার বিরক্তির বদলে অবাক হলো আবু। আমার মনে হয়, আপনার চোখে ঠিকমতো ধরা পড়েনি।
মøান হাসল প্রভা। আপনি ঠিকই বলেছেন। দু-একজনকে পেয়েছি। কিন্তু কয়েক দিন কথা বলার পর বুঝতে পেরেছি, হয় ওরা জীবনসঙ্গিনী চায় নতুবা অন্য কিছু।

যারা আপনার মাঝে জীবনসঙ্গী চায়, তারা তো খারাপ কিছু চায়নি। পুরুষ আকৃষ্ট করার মতো যথেষ্ট সুন্দরী আপনি।
আবারও মøান হাসল প্রভা। কিন্তু আমি তো ওসব চাই না। এখন প্রেম বা বিয়ে করার মতো কোনো প্রস্তুতি নেই আমার।
তো আমি আপনার কী উপকারে আসতে পারি বলুন। ধীরে ধীরে ধৈর্য হারাচ্ছে আবু। আপনি যদি অবসর সময়ে আমাকে একটু সময় দিতেন, তাহলে কৃতজ্ঞ থাকতাম।

দেখুন, আমি বিবাহিত। আপনাকে দেওয়ার মতো যথেষ্ট সময় আমার নেই।
মাঝেমধ্যে একটু কথা বললেই হবে। হাল ছাড়ল না প্রভা। আপনার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরটা পেতে পারি?
এবার রীতিমতো অপ্রস্তুত হলো আবু। এ দেশে ব্যক্তিগত ফোন নম্বর কেউ সহজে দেয় না। কিন্তু সে তো শিক্ষক। একজন স্টুডেন্ট চাইলে সে দিতে বাধ্য। দিয়ে দিল আবু। বিদায় নিল প্রভা।

বুর রুমে চলে আসে প্রভা। কখনো-বা শুধু গল্প করতে। একসময় আবিষ্কার করে আবু, মেয়েটির উপস্থিতি তার ভালো লাগতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে না এলে প্রভার জন্য মন খারাপ লাগা শুরু করেছে। বুদ্ধিমতী মেয়েটি সহজেই তা বুঝতে পারে। এবার আবু যখন বাসায় থাকে, তখন টেক্সট পাঠানো শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গেই সেসবের জবাব দেয় আবু। সম্পর্কটা আরেকটু গভীরে গেলে তা নাফিসার চোখে ধরা পড়ে। শুরু হয় মনোমালিন্য।

পরের দিন আবুর সঙ্গে দেখা করতে এলে প্রভাকে সবকিছু খুলে বলে সে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে মেয়েটি। তারপর বলে, তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি, আবু। আমি জানি না কীভাবে তুমি নেবে এই কথা। তুমি যদি বলো দূরে সরে যাব আমি। কিন্তু তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা থাকবে অটুট।

কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না আবু। প্রভার অনুভূতি যে আর আগের মতো নেই, তা কয়েক দিন আগে বুঝতে পেরেছে সে। আজ নিশ্চিত হলো।

কোনোমতে বলল, আমাদের এখানেই থেমে যাওয়া উচিত, প্রভা। প্রেগন্যান্ট নাফিসা। এখন কোনো ধরনের মানসিক চাপে থাকলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

আর কোনো কথা বলল না প্রভা। কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে রইল আবুর দিকে। ওর দু’চোখে জল। তিরতির করছে ওর ঠোঁট দুটো। কিছু বলতে গিয়েও সামলে নিল নিজেকে। এবার চোখ মুছতে মুছতে আবুর রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
দুদিন বাদে প্রভার শেষ টেক্সট মেসেজ পেল আবু। নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে গেছে ও।

৬. ডিসেম্বর মাস। আবুদের ইউনিভার্সিটিতে শীতকালীন বন্ধ চলছে। চিন্তাটা হঠাৎ করেই মাথায় এল আবুর। এই ছুটিতে অন্য স্টেটে বেড়াতে গেলে কেমন হয়! নাফিসাকে কথাটা বলতেই লাফিয়ে উঠল ও। খুব ভালো হয়। তাহলে কোথায় যাওয়া যায়?
আটলান্টা গেলে কেমন হয়? বলল আবু। ওখানে দেখার মতো দুটো জায়গা। জর্জিয়া অ্যাকুরিয়াম আর কোকা-কোলা হেড অফিস।
একমত হলো নাফিসা। যদিও সবাই গ্রীষ্মের ছুটিতে এসব জায়গায় গিয়ে থাকে কিন্তু আমরা তো যেতে পারিনি তোমার ব্যস্ততার জন্য। চলো তবে শীতেই যাব আমরা।

আবু আগেই শুনেছে দর্শনীয় স্থান দুটি পাশাপাশি অবস্থিত। তাই এবার জায়গা দুটির কাছাকাছি হোটেল অ্যাম্বাসাডরে একটি রুম তিন দিনের জন্য বুকিং দিল। প্লেনের টিকিট আগেই কেটেছে। ডাক্তারের কাছে জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিল নাফিসা।
নাহ্, তোমার এখন আর কোনো সমস্যা নেই। ডাক্তার হাসিমুখে বলল। তুমি নিশ্চিন্ত মনে আটলান্টা ঘুরে এসো।
আটলান্টায় ওদের কোনো আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধব নেই। তাই জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামের কাছে একটা হোটেল রিজার্ভ করল আবু।
হোটেলে পৌঁছে অবাক হলো ওরা। থ্রি-স্টার হোটেলেও যে সুইমিংপুল আছে, তা তাদের জানা ছিল না। শীতকালীন সময়ে সুইমিংপুলে নামা নিষেধ। কিন্তু এর চারপাশে বসতে তো বাধা নেই। তাই বেশ কয়েকজনকে এখানে বসে রোদ পোহাতে দেখা গেল।
হোটেলে পৌঁছেছে ওরা দুপুরের দিকে। মোবাইলে গুগল ম্যাপে সার্চ করে কাছের একটা রেস্তোরাঁ বেছে নিল লাঞ্চের জন্য। বেশ সুস্বাদু ওদের ডিশগুলো। বিকেলে আর বের হলো না। হোটেলেই বসে রেস্ট নিল।

এই হোটেলে ব্রেকফাস্ট ফ্রি। ভোর ছয়টা থেকে সকাল দশটা পর্যন্ত ব্রেকফাস্ট রুম খোলা থাকে। পরদিন ব্রেকফাস্ট করে বের হলো ওরা। জর্জিয়া অ্যাকুরিয়াম আর কোকা-কোলার হেড অফিস সারা বছরই ট্যুরিস্ট দর্শকদের দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে। তাই নিউইয়র্কে থাকতেই অনলাইনে টিকিট কিনে রেখেছে আবু।

জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামে প্রথম ওরা দেখল সিল মাছের অদ্ভুত সব খেলা। তিনজন মেয়ে আর একজন পুরুষ পুরো এক ঘণ্টা মাতিয়ে রাখল সবাইকে। এর পরের কয়েকটি আইটেম মোটামুটি একই ধরনের। মাথার ওপর পুরু কাচের তৈরি ট্রান্সপারেন্ট ছাদ। ওপারে কয়েকটি হাঙর ধীরগতিতে চলছে-ফিরছে। মনে হয়, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। পুরো অ্যাকুরিয়াম দেখতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা লেগে গেল।
জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামের পাশের বিল্ডিংটাই কোকা-কোলার হেড অফিস। মানুষের চাইতেও বড় বোতলের পাশে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়াল দুজন ছবি তুলতে। অবিস্মরণীয় এই সফট ড্রিংক এই বিল্ডিংয়ের একটি রুমে বসে আবিষ্কার করেছিলেন ফার্মাসিস্ট ডা. জন পেম্বারটন ১৮৮৬ সালে। ফর্মুলাটি যে রুমে সেফ-কাস্টডিতে রাখা হয়েছে, সে রুমেও ঢুকল ওরা। অবশেষে ওরা এল সেই বিশাল রুমে, যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রস্তুত এই কোম্পানির ব্র্যান্ডেড পানীয়গুলো বিনা মূল্যে টেস্ট করা যায়। এ জন্য একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের গ্লাস দর্শনার্থীদের হাতে রুমের প্রবেশপথেই তুলে দেওয়া হয়। একের পর এক পানীয় পান করে চলেছে ওরা। তবে বেছে বেছে অল্প পরিমাণে নিয়ে। কিছু কিছু পানীয় অপূর্ব, কোনো কোনোটা স্বাদে জঘন্য। স্বাদে দক্ষিণ কোরিয়ার পানির মতো স্বচ্ছ পানীয়টি বেস্ট বলে মনে হলো ওদের কাছে। কয়েকবার করে পান করল। কিছুটা পানীয়ের গুণে। বাকিটা জঘন্য স্বাদের পানীয়ের স্বাদ দূর করার জন্য।

৭. শীতকাল চলছে। এ বছর প্রচুর তুষারপাত হচ্ছে। অন্যদিকে বাচ্চা ডেলিভারির দিন গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। ডাক্তারের পরামর্শে এবার অফিস থেকে অ্যাডভান্স ছুটি নিয়ে নিল নাফিসা। বাসায় বসে সময় কাটতে চায় না। টিভি দেখে, এটা-সেটা করে সময় কাটাতে চেষ্টা করে ও। এদিকে ওর বাবু ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে। প্রায়ই পেটে ভালোমতোই নড়াচড়া করে। কষ্ট হয় নাফিসার। কিন্তু একজন সম্ভাব্য মায়ের যে এর চাইতে বড় সুখ আর কিছুই নেই। আজকাল আবুও ওকে বেশি বেশি সময় দেওয়ার চেষ্টা করে। সব সময় হাসি-খুশি রাখতে ব্যস্ত সে। আগত সন্তানের জন্য সব রকমের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে আবু। তবু দু-এক দিন পরপরই নতুন কিছু কিনে আনছে ঘরে।
সেদিন সন্ধ্যায় নাফিসাকে কিছুক্ষণ ঘরের ভেতর হাঁটাল আবু। নাফিসা একসময় টায়ার্ড হয়ে গেলে লিভিং রুমের সোফায় বসে পড়ে ওরা দুজন। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল ওরা।

আমি ভাবছি আগামী সামারে আমরা বাড়ি কিনে লং আইল্যান্ডে মুভ করলে কেমন হয়?
অবাক হয়ে আবুর মুখের দিকে তাকাল নাফিসা। যেই আবুকে জ্যামাইকা ছাড়ার কথা বলা যেত না, তার মুখে আজ একি শুনছে ও!
ইউনিভার্সিটিতে আজ কিছু ঘটেছে তোমার? আবুর হাত ধরল নাফিসা।
নাহ্, কী যে বলো! আমি বাবুর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছি আর কি। আমতা আমতা করতে লাগল আবু।
সত্যি তো? তবু সন্দেহ যায় না নাফিসার।

এবার নাফিসার কাঁধ স্পর্শ করল আবু। এই যে তোমায় ছুঁয়ে বলছি।
কিন্তু বাড়ি কেনায় যে মেলা টাকা লাগে! হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল নাফিসা।
এ নিয়ে তোমাকে কোনো দুশ্চিন্তা করতে হবে না। নাফিসাকে আশ্বস্ত করল আবু। আমার কয়েকজন কলিগ আমাকে লোন দেবে বলে কথা দিয়েছে। একজন রিয়েল এস্টেট এজেন্টের সঙ্গে আজ কথা বলেছি। নেক্সট উইকেন্ডে বাড়ি দেখতে যাচ্ছি আমরা।
নাফিসার হাতে হাত রাখল আবু। তুমি খুশি বউ?

নাফিসা জানে, আবু যখন কোনো স্বপ্ন দেখে, তখন এভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে কথা বলে। কিন্তু আজ সেও আবুর ওই স্বপ্নের নৌকায় সওয়ারি হলো বিনা বাক্যে। দিব্য চোখে দেখতে পেল নাফিসা, লং আইল্যান্ডে ওদের বাড়ির সামনে গার্ডেনে বাবু খেলছে। তার সঙ্গে খেলছে ওরা দুজনেও।
 

কমেন্ট বক্স