Thikana News
০৬ অক্টোবর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫

পাহারাদার

পাহারাদার



 
জাগতে রহ, জাগতে রহ-শব্দগুলো পশ্চিমা ভাষায় ব্যবহৃত হয় আমাদের গাঁয়ে। শব্দগুলো ১৯৫২ সালের আগের, তা সহজেই বোঝা যায়। রাতে পালাক্রমে পাহারাদার পাহারা দিত। চোর-ডাকাতের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য। রাত দশটা থেকে ভোর পাঁচটা অথবা ফজরের আজান পর্যন্ত। বাড়ির ঘাটায় অথবা সদর দরজায় এসে লাঠি দিয়ে দু-চারটি বাড়ি দিয়ে শব্দ করেই একসঙ্গে চিৎকার দিয়ে বলবে, ‘জাগতে রহ’। সদর রাস্তায় দল বেঁধে বলবে, ‘জাগতে রহ’। অর্থাৎ জেগে থাকো। গ্রামবাসীকে যদি জেগেই থাকতে হয়, তবে পাহারাদার কেন? যে চোর, সে আমাদেরই কোনো প্রতিবেশী অথবা বন্ধু। আর পাহারাদারও আমাদেরই স্বজন। চোর পাহারাদারকে খুব ভালোভাবেই চেনে ও জানে। পাহারাদার চোরদের চেনে না, তবে সন্দেহের জালে আটকা পড়ে থাকে। প্রমাণ ছাড়া উপাধি দেওয়া অনুচিত। আমার গাঁয়ের পাহারাদার আমি দেখিনি। চোর-ডাকাত? অসম্ভব। বায়না ধরেছি পাহারাদার দেখব। মা বলেছেন দেখাবেন। এখনো হয়নি। এইটুকু জীবনে আড়তদার, দোকানদার, নৌকারদার, হাবিলদারÑআরও কত দার দেখেছি। নাম শুনলেই ভয় ভয় করে মন। চোর-ডাকাতও ভয় পায়। তবে কি পাহারাদার দৈত্য-দানবের মতো দেখতে? তাও দেখিনি কখনো।

আমাদের গাঁয়ের মানুষ বড় অসহায়। যুগে যুগে নিপীড়নের শিকার। শুধু নিপীড়নের শিকার নয়, আমলের শিকার। এই ধরুন, জমিদারি আমল, ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানি আমলÑআরও কত আমল। আমলের আমলনামা অনেক ভারী। পাকিস্তানি আমলে মিলিটারির দাপট, কিছুদিন পরপরই মার্শাল ল’। খুবই কঠিন শব্দ, কিন্তু আমাদের দাঁতে ও ঠোঁটে আটকাত না। প্রতিনিয়ত শব্দটি আমাদের সাথি হয়ে ছিল। মাঝে মাঝে দিন-রাত কারফিউ, শিথিল হলে রাত দশটা থেকে ভোর পাঁচটা। আহারে দুর্বিষহ জীবন। আমার মাকে বহুবার প্রশ্ন করেছি, মা, মার্শাল ল’ কী? আমার মায়ের অসহায় মুখে একটিই উত্তরÑওসব নিয়ে আমাদের কিছু বলা উচিত হবে না। তবু অস্পষ্ট স্বরে একাকী বললেনÑশাসন, সামরিক আইনের শাসন। অসহায় মা আমার ছিলেন ভীতসন্ত্রস্ত। পাটখড়িÑযাকে হম্বাইল বলে থাকি, হম্বাইলের সঙ্গে গোবর, তুষ, কুঁড়া ভাতের মাড় (ফেন) মিশিয়ে ঘুঁটি বানাতেন আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখতাম। ঘুঁটি বানানো একটা আর্ট বা কারিগরি কৌশল, তা আমার দেখার কোনো আগ্রহ ছিল না। আগ্রহ ছিল মায়ের কষ্ট ও দুঃখ নিবারণের কৌশল দেখার। প্রতিটি ঘুঁটির দেহে আমার মায়ের জেদ-ভরা ছাপ ছিল। ঘুঁটিতে এমনভাবে জেদ-মাখা টিপ দিতেন, যেন হম্বাইল ভেঙে যায়, কিন্তু ভাঙে না। ও হ্যাঁ, এই হম্বাইলের ঘুঁটি বর্ষার মৌসুমে হেঁশেলের বন্ধু। কচ্ছপ মাকরুহ হলেও মুসলমানরা কচ্ছপের মাংস খায় না। ঘুঁটি ভালো আগুন দিলেও ভদ্র পরিবার হেঁশেলে ঘুঁটি ব্যবহার করে না। কৃষকের ঘরে ঘুঁটিয়াÑধর্ম ও জাত খুঁজে না। আমার মা আমলের বিরুদ্ধে জেদ মেটাতেন প্রিয় ঘুঁটি টিপে। আমার মায়ের কষ্ট দেখেই মার্শাল ল’ শব্দটির প্রতি ঘৃণা জমে। তাই তো অতি অল্প বয়সেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া। হানাদার বাহিনীকে নির্মূল করার চেয়ে মায়ের বুকের কষ্ট লাঘবই ছিল মূলমন্ত্র।

দেশ স্বাধীন হলো, সবার মুখে হাসি। পাখির ডাক, শিয়ালের হাঁক, মৃদু হাওয়ায় জবা ফুল দোল খায়। আহা কী মধু, আরও মধু। স্বাধীন দেশ, তবু পরাধীন। আমরা সবাই একটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। মা-বাবা সন্তানের, শিক্ষক ছাত্রছাত্রীর, সমাজ সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। মূলত প্রতিনিয়ত বাংলার মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। মোগল আমলের, ইংরেজ আমলের, পাকিস্তান আমলের, এরপর পুঁজিবাদ আমলের। আমল যেন সাধারণ মানুষের পিছু ছাড়ছে না। এখন চলছে রাজনৈতিক পুঁজিবাদের আমল। শুধু রাজনৈতিক নয়, শুধু রাজা হওয়ার একটা নীতি আছে। এসব নীতিমালায় মানুষের কল্যাণই আছে, অকল্যাণ নয়। রাজনৈতিক পুঁজিবাদের লোকেরা সাধারণত রাজনৈতিক মুখোশ পরে সাধারণ মানুষের ওপর খবরদারি করে থাকে। একটা অসৎ শক্তিশালী জাল বিছিয়ে রাখে। এই জাল থেকে সাধারণ মানুষ বেরোতে পারে না। আর বেরোবার কথা মুখেও আনে না।
ভয়! শুধু আমলের ভয়। তবে কি যুগের পরে যুগ সাধারণ মানুষ মুখ ফুটে কিছু বলতে পারবে না? মানুষের স্বাধীনতা নেই? হয়তো স্বাধীনতা আছে ভাষণে, কাগজে-কলমে। জীবন চলাতে নয়। পুঁজিবাদী রাজনৈতিক লোকদের কিছুসংখ্যক লোক পুষে রাখতে হয়, তা হবে তরুণ সমাজ। হাতের লাঠি। হাতের লাঠি শব্দ প্রয়োগে ভুল আছে। আসলে হাতের কাঠি হবে। যেদিকে ঘোরায় সেদিকেই ঘোরে। হাতের লাঠি বলতে বুড়া-বুড়ির সাহায্যকারী বোঝায়। নাতি-নাতনির মাঝে যে সবচেয়ে বেশি বুড়োদের সেবা করে, তাকেও হাতের লাঠি বলা হয়। অজ্ঞ, অলস, বেকার তরুণ-জীবনের হাতে বেশ কিছু নামধারী রাজনৈতিক পুঁজিবাদীরা আশার ছলনায় তুলে দেয় দাদার লাঠি আর ‘বাবা’। আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেইÑদাদার লাঠি এখানে কাজ করে হকিস্টিকের। অবশ্যই খেলার জন্য নয়, এই হকিস্টিক দিয়ে কী করে, তা আর বলার অবকাশ রাখে না। সাধারণ নিরীহ মানুষ ভালো জানে। তবে এটুকু বলতে পারি, কল্যাণময় কিছু নয়। দাদার হাতে আর লাঠি নেই, দাদার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হলো। আর ‘বাবা’? এই ‘বাবা’ সেই বাবা নয়। আমার মা হালিমনির ভাষায় ‘ইয়াবা’। ভয়ে, লজ্জায়, সংকোচে আমার মা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না, ‘ইয়াবা’। ঘোমটার একচিলতে আঁচলের একটু তুলে অতি গোপনে বলেন, ‘বাবা’, জানে শুধু মায়ের আঁচল আর থরথর কম্পিত ঠোঁট। আহারে জীবন, মা করতে পারে না শিশুকে শাসন, কিছু বলতে পারে না বাবা। শাসন করে বেড়ায় ‘ইয়াবা’। দিনে ঘুমায়, রাতে ইয়াবায়। রাজনৈতিক পুঁজিবাদীরা প্রকাশ্য দিবালোকে শাসন করে বেড়ায়। তবে কি আবার আরেক আমলের জালে জড়াল নিরীহ প্রাণ এ বাংলার? ভালো মানুষকে ভালো থাকতে দেবে না ভয়ংকর এই ইয়াবা। এই ভয় সবার মনে, সবাই জানে। মুখ ফুটে বলার সাহস নেই মানুষের। আমার মা হালিমনিও জানেন। এ-যাবৎ মায়ের কথা বলেছি, বাবার কথা নয়। আমার বাবার নাম মরহুম সুখেনূর। বাবা আমার আটচল্লিশ সালে খাজা নাজিমুদ্দিনের গাদ্দারির প্রতিবাদ করেছেন। আমার বাবার পছন্দ ছিল না দুমুখী সাপ নাজিমুদ্দিন সাহেবকে। একদিকে নিরীহ বাঙালিকে ভাই বলে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করবে। অন্যদিকে পাকিস্তানিদের দোসর হয়ে উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। সাক্ষী আছে রেসকোর্স মাঠ আর সাধারণ মানুষ। শত মানুষের সঙ্গে আমার বাবা প্রতিবাদ করেছেন। বাবার মৃত্যুর বহুকাল বাদে নাজিমুদ্দিন রোডকে গাদ্দার সড়ক নাম দেওয়ায় লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন আমার মা। এখনো সমাধি শোভা পায় শহীদ মিনারের সামনে। আহারে বাংলার মানুষ, আহারে বাংলাদেশ। প্রযুক্তির অগ্রগতি, সামাজিক অবনতি ঘটেছে। ইয়াবাকে বাবা ডাকতে বাধ্য হয়েছে। হতাশার আরেক নাম ‘বাবা’ অর্থাৎ ইয়াবা।

বাবার মৃত্যুর পরে ঢাকা ছেড়ে আমাকে নিয়ে গ্রামে চলে আসেন আমার মা। অনেক কষ্টে জীবন চলে। কারও শিশু পরিচর্যা, কারও বাগান পরিচর্যা, পাট তোলাÑআরও কত কী। কালু ও ধলু নামের দুটি গাভিও আমাদের বিপদের সাথি ছিল। যে পয়সা হয় কিছুটা নিজের কাছে রাখেন, বাকিটা সংসার খরচ। মায়ের আশা ছিল, এ গাঁয়ে ভাষাশহীদ পরিবারের কল্যাণে কিছু গড়বেন। ভাষাশহীদ, ভাষা-মানুষের জন্য। মানুষ যদি না-ই বাঁচে, তবে ভাষা কিসের জন্য? বিশ্বজোড়া প্রতি ১৪ দিনে একটি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে চলেছে। এই ভয় ভাষাজ্ঞানীদের মনে আছে। মনে আছে, আমার মা হালিমনির। তবু ভাষার চেয়ে মানুষ বড়। চোখের সামনে তরুণ সমাজ ঝরে যাচ্ছে। কে ধরবে দেশের হাল? কে করবে ভাষার চাষ? ভাষাশহীদ পরিবার কল্যাণ পরিষদ গড়ার চেয়েও বড় কাজ সমাজ থেকে ইয়াবা নিধন। পুঁজিবাদী রাজনৈতিক নেতার সামনে দাঁড়িয়ে আবার অপমানিত হতে চান না আমার মা। প্রতিবাদী হবেন গোপনে, কৌশলে। গাঁয়ের শিশুদের নিজের শিশু মনে করেই গোপনে পুলিশ ফাঁড়িতে যান, কিন্তু অসহায় পুলিশ কতজনের বিরুদ্ধে লড়বে, কতজনকে ধরবে?

ধরলেই হবে না, আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই রাজনৈতিক পুঁজিবাদীর শিকার। থানাদারকে একটা ফোন, যার নাম হুমকি। ভিক্ষা চাই না গো, কুত্তা সামলাও। জাতি যাক জল্লায়, চাকরি বাঁচাও। হায়রে আমার জন্মভূমি, হায়রে আমার স্বাধীন দেশের মানুষ। অসম্ভব ভয়ংকর একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। ঢাকার বংশালে বাবার পরিচিতদের ছেলেরা বড় হয়েছে। এদের মধ্য থেকে চারজনকে বেছে নেওয়া হলো, যারা এখনো আমার মাকে শ্রদ্ধাভরে চাচি বলে ডাকে। সুবিধা-অসুবিধায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, সাহায্যের হাত বাড়ায়। ওদের পরিবারও শ্রদ্ধার চোখে দেখে। অনেকেই ভালো ব্যবসা করে বা বিদেশে থাকে। পছন্দসই চারজন বংশাল তরুণ সংঘের সঙ্গে জড়িত। ব্যায়ামাগার গড়েছে, তরুণ সংস্কারের অনেক কাজ করেছে। অত্যন্ত সাহসিকতার প্রমাণ দেখিয়েছে বিভিন্ন তরুণ সংস্কার অভিযানে।

সিদ্ধান্তে অটল আমার মা। নিজের গাঁও থেকে মাদক নিধন করে ছাড়বেন। বাংলার বুকে সবাই যদি নিজ গাঁও সংস্কার করে, মাটি আর মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসে, একদিন এই বাংলা বিশ্ব মানচিত্রে ইতিহাস গড়বে।
কোন সময়, কোথায় ইয়াবার আড্ডা বসে, কীভাবে যায়Ñসব খবর জোগাড় করা হলো অতি গোপনে। কালী মন্দিরের পেছনে, স্কুলের বারান্দায় দেয়াল টপকে যায়, গোডাউনের পেছনে টাট্টির পাশ দিয়ে যায়। সবগুলোই নীরব জায়গা। ইয়াবার স্থান কোনো মসজিদ-মাদ্রাসায় মেলে না। বুঝিয়ে দেওয়া হলো, ইয়াবাখেকোরা আর কেউ নয়, এ গাঁয়ের সন্তানÑআমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের প্রাণ। কাউকে কঠিন প্রহার করবে না। ওরা ভিতু নয়, অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী, এটাই ওদের স্বর্গরাজ্য। কখনো কল্পনা করেনি কেউ বাধা দিতে পারে। ভয় দেখাবে, প্রয়োজনে পাছায় দু-চারটা পিটান দেবে। আর চেহারায় মেহেদি বাটা মেখে দেবে, যত দিন মেহেদির রং চেহারায় থাকবে, অন্তত তত দিন ঘর থেকে বেরোবে না লজ্জায়। আর পাকা প্রুন ফল খাইয়ে দেওয়া হবে জোর করে। প্রুন ফল পেট পরিষ্কার করে। রাতে ভূতের ভয়, পুলিশ ফাঁড়ির লোকেরাও বুঝতে পারেনি কী ঘটেছে। পরপর চার দিন অভিযান চালানো হলো, গাঁও থেকে ইয়াবা উধাও। রয়ে গেল ইয়াবা পাচারকারী গুরু ঠাকুরেরা। ওদের আছে অর্থ ও অপকর্মের কৌশল। সব সময় প্রহরী-সজ্জিত জীবন। তবু নিরাপদ নয়। সমাজ সংসার ওদের ভালো চোখে দেখে না। প্রশাসনিক সকল ক্ষেত্রে সাধু বেশে পদচারণ। সুযোগ বুঝে চেহারায়ও তেলই দেওয়া হবে। মেহেদিমাখা তেলই, যেন হনুমানের রূপে ঘর থেকে বেরোতে লজ্জা ও সংকোচ লাগে। ইয়াবাখোরদের চেহারা চোখে ভেসে ওঠে ইয়াবা জোগানদাতার। আর সাধারণ মানুষ জেনেও না জানার ভান করে। মাটিকে সাক্ষ্য রেখে একটু মুচকি হাসে। প্রশস্তির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে, কে এই মানুষ? সমাজ সংস্কারের ঠিকাদার। যুবসমাজের পাহারাদার। আমল পরিবর্তন হয়েছে। পাহারাদারের পাহারার ঢং পরিবর্তন হয়েছে। আগে পাহারাদারদের অসাধুরা জানত ও চিনত। ইয়াবা নিধন অভিযানে অসাধুরা পাহারাদারকে চেনে না, আগে দেখেওনি। পাহারাদার ঠিকই অসাধুদের চিনে নেয় এবং সময়মতো উচিত শিক্ষা দেয়। বড় সাধ ছিল পাহারাদার দেখব। আগেও পাহারাদার দেখা হয়নি, এখনো পাহারাদার দেখা হলো না।
 

কমেন্ট বক্স