অবশেষে প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দিয়েছেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রমজান শুরুর আগে জাতীয় সংসদের ত্রয়োদশ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি গত ৫ আগস্ট জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে এই ঘোষণা দেন, যা ইতিমধ্যেই দেশব্যাপী বিপুলভাবে প্রচারিত হয়েছে। এই ঘোষণা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও জ্ঞাত হয়েছে। আলোচনাও চলছে ঘোষণা নিয়ে। নির্বাচন কমিশনও প্রধান উপদেষ্টার দিকনির্দেশনা পেয়ে কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণে নির্বাচন নিয়ে এ রকম আশাও ব্যক্ত করেছেন, তিনি নির্বাচনকে ঈদের দিনের উৎসবের মতো করতে চান। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা নিয়ে অন্যতম প্রধান দুটি স্টেক হোল্ডার রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারেনি। জামায়াতে ইসলামী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছে, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় জাতির আশা-আশাক্সক্ষা প্রতিফলিত হয়নি। অন্যদিকে এনসিপি বলেছে, কার্যকর সংস্কার ও গণভোটের আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোনোভাবেই হতে পারে না। বিএনপিকে এখন পর্যন্ত বেশ ‘আনন্দচিত্ত’ দেখা যাচ্ছে। তাদের প্রধান নেতা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে গত ১৩ জুন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের মধ্যে ‘ভাঙামন জোড়া লাগানো’র যে বৈঠক হয়, তাতে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হওয়া নিয়েও কথা হয়। প্রধান উপদেষ্টার সম্মতির সুস্পষ্ট কোনো কথা না হলেও একটা ইতিবাচক ইঙ্গিত মিলেছিল। সে কারণে বিএনপি মনে করছে, ‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা সেই আলোচনার ফল।’
‘জুলাই সনদে’ প্রবাসীদের অবহেলা করলেও ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রবাসীদের প্রশংসা করেছেন এবং বলেছেন, ‘তারা আমাদের রেমিট্যান্স-যোদ্ধা। জুলাই আন্দোলনেও তাদের ভূমিকা ছিল।’ এই প্রশংসার আলোকে ধরে নেওয়া যায়, প্রবাসীদের ভোটার হওয়ায় দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিলেও নিতে পারে।
তবে শেষ কথা বলার সময় ‘নির্বাচন অনুষ্ঠান না হওয়া পর্যন্ত’ বলা যাচ্ছে না বলেই অনেক নির্বাচন বিশ্লেষকের ধারণা। তাদের বিশ্লেষণে এখনো অনেক ‘ইফ-বাট’ এর জট রয়েছে তার ভাষণে। সেসব জট খুলতে গিয়ে আবার নতুন কোনো জট বেঁধে যায় কি না, কে জানে। বলা যায়, এখনো ‘দিল্লি দুরস্ত’। প্রায় ছয় মাসের লম্বা পথ-এতটা পথের যেকোনো স্থানে একটা ‘উষ্ঠা’ যদি খায় নির্বাচনের স্টেক হোল্ডাররা, তবে যত ‘ইফ-বাট’ আছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইলেকশন যত কাক্সিক্ষতই হোক, অনিশ্চিত হয়ে পড়বে নিশ্চিতভাবে।
এ ছাড়া এখনো অনেক প্রশ্ন অনিষ্পন্ন আছে। সেসব কীভাবে নিষ্পন্ন হবে, তা নিয়েও অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। যেমন আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে পারবে কি না, পারলেও নৌকা মার্কা পাবে কি না। জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ নির্বাচনে কী হবে, সে নিয়েও কত কিছু হতে পারে। জামায়াত এবং ড. ইউনূসের মাস্টারমাইন্ডদের দল এনসিপির মান ভাঙাতে গিয়ে কী হয়, সেটাও এখনো বলা যাচ্ছে না। এখানে গ্রাম্য একটা গল্প বললে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ‘আগে প্রায়ই ঘটতে দেখা যেত। এক দরিদ্র ঘরের মেয়ের বিয়ের কথা পাকা হবে। ধনী আত্মীয়স্বজন যারা আছেন, তাদের ডাকা হয়েছে মেয়ের পক্ষে। ধনী আত্মীয়দের নিয়ে কথা পাকা হতে গিয়ে তাদের মর্যাদাবোধ এবং অহংবোধের কারণে অনেক সময় বিয়েটাই ভেঙে যেত।’ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে সে আশঙ্কাও আছে। এরই মধ্যে সে রকম আলামতও দেখা গেছে। এনসিপির ছয়জন শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতা তাদের সৃষ্ট ৫ আগস্টের বর্ষপূর্তির আয়োজন রেখে কক্সবাজারে ‘বিনোদন সফরে’ গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। তাদের অবস্থান নিয়েও নানাজনে নানা কথা বলছেন, শোনা যাচ্ছে। আর আছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। মব-সন্ত্রাস এখনো চলমান।
সব মিলিয়ে নির্বাচনী আকাশে অনেক মেঘ। সেসব মেঘ কেটে গেলে তো ভালোই। না কেটে গেলে কী হবে, কে জানে? তবে আমরা যারা দেশের জনগণ, তাদের প্রার্থনা সব মেঘ, সব শঙ্কা কেটে যাক। অবাধ, নিরপেক্ষ, নির্বিঘ্ন ত্রয়োদশ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। নতুন, পুরোনো যারা ১৬-১৭ বছর ভোট দিতে পারেনি, তারা মনের আনন্দে ভোট দিয়ে সংসদে তাদের প্রতিনিধি পাঠাক। নতুন সরকার জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে আন্তরিকভাবে কাজ করুকÑএই ধারা অব্যাহত থাকুক।