খবরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বহু মানুষের কাছে বিবেচিত হলেও খুব অনাদর-অবহেলায় ঠিকানার ৩০ জুলাই সংখ্যার শেষের পাতায় নিচের দিকে এক কলামে প্রকাশিত হয়েছে। খবরটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি-এটা স্পষ্ট। তার কারণও প্রায় সকল বাঙালিরই জানা। যার কথা থেকে শিরোনামটি গ্রহণ করা হয়েছে, তিনি খুব কিঞ্চিৎকর’ ব্যক্তি নন। নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত এবং কোন দেশে স্থায়ী ঠাঁই পাননি।
অথচ যে কারণে তিনি বাস্তুচ্যুত, সে কারণের পক্ষেই আমরা গরিষ্ঠ মানুষ। অহর্নিশ তার জন্য আমরা আহাজারি করি, বিতর্ক করি। আমরা বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষÑ এ কথা অহর্নিশ বলে থাকি। ‘আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই।’ বিশেষ করে, বাংলাদেশের মানুষকে সেটা নিয়ে ২৪ ঘণ্টা বিতর্কে মেতে থাকতে দেখা যায়। ব্যক্তিতন্ত্র, রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্রÑকোনোটি বড় কোনোটি ছোট নয়, আসলে শেষ বিচারে সবই স্বৈরাচার। এ কথা না মানার কোনো কারণ দেখা যায় না।
বাংলাদেশ বিনির্মাণে তার অবদান থাকলেও স্বাধীন রাষ্ট্রে তার প্রবেশ নিষেধ। তিনি বিশিষ্ট কবি ও কলামিস্ট তসলিমা নাসরিন। বাংলাদেশে ঢুকতে না পারলেও বাংলাদেশ ভাবনা তো তাকে ছেড়ে যায়নি। তিনি বাংলাদেশ, বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি নিয়ে ভাবেন। বিশেষ করে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিপন্ন অবস্থা নিয়ে তিনি বিশেষভাবে ভাবেন। তিনি নিষিদ্ধ হলেও তার লেখা এখনো বাংলাদেশিদের খুব প্রিয় এবং পছন্দের। তার কোনো কোনো লেখা ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের অনুভূতিতে আঘাত করলেও তার অধিকাংশ লেখার মধ্যে একটা শক্তি ও যুক্তি থাকে। সে কারণে তার লেখাগুলো মনোগ্রাহী এবং গ্রহণযোগ্য হয়। আর যুক্তিসংগত, কল্যাণদর্শী লেখা মানুষ যদি গ্রহণ না করে, তবে মানবসমাজই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তসলিমা নাসরিন গত ২৬ জুলাই নিউইয়র্কের সেন্টারে আয়োজিত এক সেমিনারে এ কথা বলেছেন।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ আয়োজিত সেই সেমিনারটিতে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র না থাকলে মানুষের নিরাপত্তা থাকে না। মুক্তচিন্তা, বাকস্বাধীনতা বিপন্ন হয়। বহু মত ও বহু পথের সমাজকে একত্রে বেঁধে রাখতে পারে গণতন্ত্র। গণতন্ত্রহীনতায় সকল মূল্যবোধ, সকল ন্যায়বিচার, সুনীতি সমাজ থেকে উঠে গেলে তার স্থলে স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ জন্ম নেয়। অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন, গণতন্ত্রহীনতায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। হানাহানি, কাটাকাটি বৃদ্ধি পায়। সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সংখ্যালঘু সমাজের নিরাপত্তা, মর্যাদা, সম্ভ্রম লুট হয়ে যায়।
আসলে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান অচল হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র সে ক্ষেত্রে কার্যকারিতা হারায় এবং অবশ্যম্ভাবীরূপে ভেঙে পড়ে। বর্তমান যুগে অগণতান্ত্রিক সমাজ অসভ্য সমাজে পরিণত হয়। সমাজ অসভ্য সমাজে রূপ নেয়। মানবিক, বিবেকবান, আলোকিত মানুষেরা সেই সমাজে বসবাস করতে পারেন না। অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সবচেয়ে নিপীড়িত হয়, পদদলিত হয় প্রকৃত গণতন্ত্র। সেখানে জনগণের কথা বলে, গণতন্ত্রের কথা বলেই গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়। সেই সমাজে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হয়, জুলুমের শিকার হয় সাধারণ মানুষ এবং শিক্ষিত, সভ্য, আধুনিক, মানবিক, সম্মানিত পদে আসীন, শিক্ষক, আইনজীবী এবং সমাজকে যারা সঠিক দিকনির্দেশনা দেন, তারা।
সেই সমাজকে ভাঙতে হলে দরকার লোভহীন, স্বার্থহীন, জুলুমের শিকার মানুষের ঐক্য। আর জরুরি একজন গণনিষ্ঠ নেতা।