সব দেশেই বিশেষ কিছু খাত থাকে, যার ওপর দেশের অর্থনীতি ওঠানামা করে। যুক্তরাষ্ট্রে যেমন সমরাস্ত্র শিল্প, হাউজিং, কৃষিসহ অনেকগুলো উৎস রয়েছে; যার ওপর এ দেশের অর্থনীতির পারদ ওঠানামা করে। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের শীর্ষ দুটি উৎস হচ্ছে পোশাকশিল্প এবং জনশক্তি রপ্তানি। বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে এ দুটি খাতই সংকটে পতিত। পোশাকশিল্প খাতের দুরবস্থা নিয়ে কিছুদিন থেকেই মিডিয়ায় লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। জনশক্তি খাতেও সংকট। যেসব দেশ বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি করত, তাদের কেউ কেউ আমদানি একদম বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ সম্পূর্ণ বন্ধ না করলেও আশঙ্কাজনক হারে জনশক্তি নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে।
আজকের এ সম্পাদকীয়তে অবশ্য জনশক্তি নিয়ে কিছু বলার অভিপ্রায় নেই। অন্য কোনো সম্পাদকীয়তে লেখার ইচ্ছা রইল। আজকের সংখ্যার সম্পাদকীয়তে পোশাকশিল্পের বিপর্যয় এবং অর্থনীতিতে তার অভিঘাত নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে। ঠিকানার ৯ জুলাই সংখ্যার প্রথম পাতাতে ৩ নম্বর কলামে লেখা প্রকাশিত হয়েছে ‘গভীর অনিশ্চয়তায় দেশের পোশাকশিল্প’। আসলে পোশাকশিল্পে দুর্ভোগ যেন পিছু ছাড়ছে না বাংলাদেশের। কোভিড যেতে না যেতেই পোশাকশিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ, তারপর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকারের বিদায়, দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি। এরপর ট্রাম্প প্রশাসনের দুই দফায় ৫০ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধি, পোশাকশিল্পে দুর্যোগ মহাদুর্যোগে পরিণত হয়েছে।
‘গভীর অনিশ্চয়তায় দেশের পোশাকশিল্প’ প্রতিবেদনটি শুরু হয়েছে ট্রাম্পের নতুন শুল্কারোপ দিয়ে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাড়তি ৩৫ শতাংশ শুল্কারোপ বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকে যথার্থই সংকটে ফেলেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাড়তি শুল্কারোপ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত জুলাইয়ে একটি পত্র দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে সে কথা জানিয়ে দেন। নতুন বাণিজ্য চুক্তি যদি না হয়, তবে এই বাড়তি শুল্ক কার্যকর হবে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই কঠিন বাণিজ্য নীতি কার্যকর হলে বাংলাদেশের, বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্প গভীর অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে। কেননা, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে। যার ফলে বাংলাদেশি পণ্য প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের বৃহত্তম বাজার যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাজারেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা প্রায় অনিবার্য হয়ে দেখা দেবে।
বাংলাদেশের বিজেএমইএর (বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি) কর্মকর্তাদের শঙ্কার কথা দিয়েই সম্পাদকীয়টির উপসংহার টানতে চাই। তারা পোশাকশিল্পের সংকটকে ভয়াবহ উল্লেখ করে বলেছেন, তৈরি পোশাকশিল্পের বাড়তি শুল্কের প্রভাব হবে ভয়াবহ। তাদের কথা, এর ফলে পণ্য রপ্তানি কমে যাবে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেই সব কারখানা, যাদের তৈরি পোশাকশিল্পের বেশি রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। পোশাকশিল্প খাত অভ্যন্তরীণ বহুবিধ কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাড়তি শুল্কের কোনো সুরাহা না হলে তা হবে বোঝার ওপর শাকের আঁটি।
সকলেই মনে করেন, বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের এই অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বহির্বিশ্বে তার যে পরিচিতি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার যে বিশেষ সম্পর্ক, তিনিই বাংলাদেশের স্বার্থের কোনো ক্ষতি না করেই পোশাকশিল্পের এই সংকট সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারেন। সকলের প্রত্যাশা, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের বর্তমান এই সমস্যা সমাধানে তিনি ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসবেন।
রাজনীতি, অর্থনীতি, গোষ্ঠীস্বার্থ, ব্যক্তিস্বার্থ সবকিছু ছাড়িয়ে যদি দেশের স্বার্থ বড় হয়, তাহলে দেশের স্বার্থে সবকিছু ত্যাগ করে নিজেকে নিবেদন করাই তো পরমার্থ। এ কথা যারা রাজনীতি করেন, তারা সবার চেয়ে ভালো বোঝেন। আর সমস্যা-সংকটে দেশের স্বার্থে আত্মত্যাগ করেই তার প্রমাণ রাখতে হয়। কাজী নজরুল যেমন বলে গেছেন, ‘কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ/ এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।’