সুমনার বয়স পঞ্চাশ। দুই সন্তানের মা, একজন কর্মজীবী নারী আর সমাজে প্রতিষ্ঠিত একজন স্ত্রীর পরিচয়ে গত তিরিশ বছর কেটে গেছে। তার স্বামী রতন, একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, যিনি নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করেন, খবরের কাগজ পড়েন আর মাঝেমধ্যে পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণা করেন।
সুমনার জীবন ছিল অনেকটা পূর্বনির্ধারিত ছকে বাঁধা-দুপুরে রান্না, বিকেলে বাজার, সন্ধ্যায় সংসারের খবরদারি। কিন্তু এই স্বাভাবিক জীবনে একদিন হঠাৎ করেই ঢুকে পড়ল অপ্রত্যাশিত আলো-রবিন নামের এক ষাটোর্ধ্ব লোক।
রবিন সুমনার লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠক। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বই আর কথা বলা যার দুই ভালোবাসা। সুমনার সঙ্গে প্রথম আলাপটা হয়েছিল একটা বই নিয়ে তর্কের মধ্য দিয়েÑকাফকার ‘দ্য ট্রায়াল’ নিয়ে দুজনের ব্যাখ্যা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এর পর থেকে রবিন প্রায়ই লাইব্রেরিতে আসতে লাগলেন। আলোচনার বিষয় পাল্টে গেলÑবই থেকে শুরু করে জীবন, শূন্যতা, ইচ্ছা, কষ্ট আর ভালোবাসা। সুমনা ধীরে ধীরে টের পেল, তার মনের একটা অংশ রবিনের কথায়, চোখে, এমনকি নীরবতায় হারিয়ে যাচ্ছে।
সে কখনো এমন অনুভব করেনি-এই বয়সে, এই অবচেতনে কেউ তার ভেতরটা নাড়িয়ে দিচ্ছে। রবিনের পাশে থাকলে সে যেন নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে, এমন এক মানুষ হিসেবে যাকে ভালোবাসা মানে শুধু কর্তব্য নয়, গভীর সংযোগ, সম্মান আর বোঝাপড়া।
একদিন রবিন বললেন, ‘সুমনা, জানো, এই বয়সে এসে আবার ভালোবাসায় পড়া যেন অন্য রকম... যেন এক গোধূলির আলোয় সমস্ত জীবনটা নতুন করে দেখা।’
সুমনা কিছু বলল না, শুধু তাকিয়ে রইল, তার চোখে তখন আলো-ছায়ার খেলা, যেমনটা দেখা যায় শেষ বেলার আকাশে।
এ গল্পের কোনো নিশ্চিত শেষ নেই। সমাজ কী বলবে, পরিবার কী ভাববেÑসবই রয়ে গেল প্রশ্নচিহ্নে। কিন্তু সুমনা জানে, তার হৃদয়ে একটা নতুন ঋতু শুরু হয়েছে, যা হয়তো চিরন্তন নয়, কিন্তু অস্বীকার করার মতোও নয়।
সেদিনের পর সুমনা আর রবিনের দেখা আরও ঘন ঘন হতে লাগল। তারা একসাথে বই পড়ে, মাঝে মাঝে কফিশপে যায়, আর জীবন নিয়ে কথা বলে। সুমনার মধ্যে যেন এক নতুন রং লেগেছে, সে আবার নিজের জন্য শাড়ি কেনে, পুরোনো গানের সিডি বাজায়, আয়নার সামনে একটু বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।
কিন্তু ঘরে ঢুকলেই অন্য ছবি।
রতন বুঝতে পারছেন পরিবর্তন। তার স্ত্রী কিছু একটা লুকাচ্ছে, সেটা তিনি নিশ্চিত। এক রাতে, খাবার টেবিলে রতন জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, ‘তোমার কি কিছু বলার আছে আমাকে, সুমনা?’
সুমনা থমকে গেল। কিন্তু কিছু বলেনি। শুধু বলল, ‘সবই তো আগের মতোই চলছে, কী বলব?’
কিন্তু ভেতরে চলছিল টানাপোড়েন। এই বয়সে এসে সে কি নিজের ভালোবাসার অধিকারী? নাকি ত্যাগই তার একমাত্র দায়িত্ব?
পরদিন, রবিন তাকে বললেন, ‘আমি জানি, তুমি অনেক কিছু ভাবছ। কিন্তু একটা প্রশ্ন করি, সুমনা-তুমি কি সুখী?’
সুমনা চুপ করে রইল। তারপর খুব ধীরে মাথা নাড়ল-না। এই ‘না’ শব্দটাই যেন তার ভেতরকার চাবিকাঠি খুলে দিল।
সে প্রথমবার ভাবল-এত বছর ধরে সে কেবলই ভালো মেয়ে, ভালো মা, ভালো স্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু নিজে? নিজের চাওয়াটা কখনো গুরুত্ব পায়নি।
এদিকে ছেলেমেয়েরাও টের পাচ্ছে মায়ের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন। বড় মেয়ে তিথি একদিন বলল, ‘মা, তুমি কেমন যেন অন্য রকম হয়ে গেছ। সব ঠিক আছে তো?’
সুমনা হাসল। বলল, ‘হয়তো আমি নিজেকেই একটু খুঁজে নিচ্ছি, মা হিসেবে নয়, নারী হিসেবে।’