গ্রীষ্মের অলস দুপুর। এমন অলস দুপুরে চোখ জড়িয়ে ঘুম আসে। সূর্যের প্রখর তাপ এই সময় চারদিকে আগুনের হলকা ছড়ায়। তাই এমন দুপুরে ঘর থেকে বাইরে যেতে মন চায় না। মন চায় আম-দুধ-ভাত খেয়ে শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘরের হিমেল হাওয়ায় একটা লম্বা ঘুম দিতে। কিন্তু ইচ্ছে হলেই তো আর হবে না। মোবারক রহমানকে এই ভরদুপুরে প্রচণ্ড তাপদাহের মধ্যেই হেঁটে হেঁটে যেতে হবে স্কুলে নাতিকে পিকআপ করতে। ছেলের বউ মোনা যদিও এই সময়ে বাসায়ই থাকে, তবু রুটিনমাফিক নাতিকে স্কুলে আনা-নেওয়া তাকেই করতে হয়। শরীর না চললেও শরীরটাকে টেনে টেনে নিয়ে যেতে হয় স্কুলে। কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় নাতি বের না হওয়া পর্যন্ত। তারপর হেঁটে হেঁটে আবার বাসায় ফেরা। আজ আবার নাতিকে বাসায় রেখেই যেতে হবে স্টারলিংয়ে। খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহের জন্য লাইনে দাঁড়াতে হবে। একটি ভলান্টারি সংগঠন স্টারলিংয়ে ফ্রিতে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছে। বউমার আদেশÑবাচ্চা বাসায় দিয়ে যেন খাদ্যসামগ্রী নিয়ে আসেন।
প্রচণ্ড তাপদাহ, সূর্য যেন আজ অগ্নিরূপ ধারণ করেছে। নাতিকে বাসায় নিয়ে এসে মোবারক রহমান কাহিল হয়ে পড়েন। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে ঢকঢক করে পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করেন। তারপর বউমাকে বলেন, ‘মা রে, আমার শরীরটা খুব অসুস্থ লাগছে, তুমি একটু খেয়ে খাবারগুলো নিয়ে আসো।’ বিস্মিত কণ্ঠে বউমা বলল, ‘কী বললেন! আমি যাব?’ মোবারক বলেন, ‘তুমি না যেতে পারলে মনসুরকে বলো। ও একটু পরেই বাসায় আসবে। আসার পথে না হয় খাদ্যসামগ্রীগুলো নিয়ে আসবে।’ এবার রাগত কণ্ঠে উচ্চস্বরে বউমা বলে, ‘আপনার ছেলে লাইনে দাঁড়িয়ে খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করবে, এই পাড়ায় আমাদের মান-ইজ্জত কিছু থাকবে?’
বউ-ছেলে লাইন ধরে খাবার আনতে গেলে মানসম্মান চলে যাবে, আর অসুস্থ বাবা এই শরীরে প্রচণ্ড তাপদাহে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার বয়ে আনলে মান-সম্মান যাবে না। কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করে মোবারক রহমান শপিং ট্রলিটা হাতে নিয়ে বের হচ্ছেন। বউমার তাড়া, ‘তাড়াতাড়ি চলে আসবেন, ৫টা থেকে আপনার হোম কেয়ারের আওয়ার শুরু হবে। কাজেই ৫টার মধ্যেই চলে আসবেন, কোথাও আবার আড্ডা পেটাবেন না যেন।’
বাসার কাছেই ওভাল পার্ক। দু-একজন লোক পার্কের পানির ফোয়ারার পাশে বেষ্টিত হয়ে বসে আছে। গ্রামে এমন ভরদুপুরে কৃষকেরা কাজ ফেলে বাড়িতে এসে হাতপাখার বাতাস খায় আর রাখালেরা গাছের ছায়ায় বসে বাঁশি বাজায়। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক ম্যানেজার মোবারক রহমানের জিরানোর সময় নেই। এই তপ্ত দুপুরে তাকে এখন ছুটতে হচ্ছে লাইন ধরে খাবার আনার জন্য। মোবারক রহমানের হার্টের অসুখ সাত বছর, ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে, ডায়াবেটিসও আছে, প্রেশার তো আছেই। তাই তার কাজকর্ম করে দেবে, তাকে দেখভাল করবেÑএই দেখিয়ে বউমা ৪০ ঘণ্টার সিডিপ্যাপ সার্ভিস নেয়। বউমা নিজেই তার কেয়ার গিভারের দায়িত্ব নেয়। প্রতি সপ্তাহের পেমেন্টের টাকাটা বউমার অ্যাকাউন্টেই জমা হয়। কিন্তু মোবারক রহমানকে নিজের কাজ তো করতেই হয়, মাসে সংসারের বহু কাজেই সহায়তা করতে হয়। দেশে চলে যেতে ইচ্ছে হয় খুব কিন্তু ছেলেকে একদিন বলতেই ছেলে বলে, ‘বাবা, আপনি চলে গেলে কীভাবে হবে? মোনার হোম কেয়ারের কাজ থেকেই তো অ্যাপার্টমেন্টের লোন শোধ করা হয়। আপনি চলে গেলে যে ওর ইনকাম বন্ধ।’ কী বলবেন মোবারক রহমান? ছেলে-বউমার জন্য নয়, তবে নাতি রামিসের জন্য তার ভীষণ মায়া হয়। মায়া জিনিসটা বড়ই অদ্ভুত। একবার পড়লে আর কাটে না। একটু পরপর নাতিটা এসে তার খোঁজ নেয়, ‘দাদু, কিছু লাগবে? কিছু খাবে?’ এই বিশাল ফ্ল্যাটে নাতি রামিসকেই তার আপন মনে হয় আর আপন মনে হয় পাশের বাসার প্রতিবেশী মিঞা ভাইকে। মিঞা ভাইয়ের সঙ্গে মোবারক তার সুখ-দুঃখ ভাগ করেন কিন্তু তার ওপর ছেলে ও বউয়ের অত্যাচারের কাহিনি কখনোই বলেন না। একটা সংকোচ, দ্বিধা তার টুঁটি চেপে ধরে।
সারা দিনের ক্লান্তি ভুলে রাতের ডিনার সেরে লিভিং রুমের সোফা নামক বেডে ঘুমের জন্য শুয়ে পড়েন মোবারক। ঘুমের আগের এই সময়টুকু তার একান্তই নিজের, মি টাইম।
ব্যাংক ম্যানেজার মোবারক কত কষ্ট করেই না সন্তানকে মানুষ করেছেন। যখন রিটায়ারমেন্টে যান, তখনই ছেলে মাহফুজের ডিভি লটারি লাগে। অফিসের কলিগরা বলেন, মোবারক ভাই, আপনার সততার পুরস্কার আল্লাহ দিয়েছেন। মোবারক কি জানতেন, তার কপালে এই লেখা ছিল। সৎপথে থাকায় উপার্জনের বেশির ভাগ অর্থই ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ দিয়ে শেষ হয়ে যেত। শেষ বয়সে গ্রামে বাড়ি করে সেখানেই স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় লেখাপড়া শেষ করে সেখানেই বিয়ে করে সেটেলড। দুই ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকলেও ফোনে কথা হতো। আর গ্রামে আত্মীয়স্বজনদের মায়ায় তার খারাপ লাগত না। এর মধ্যে স্ত্রী মারা গেল। মোবারক একা হয়ে যান। তবু একাকী বয়ে চলছিল জীবন। এরই মধ্যে ছেলে ও বউমার তাড়া-বাবা, এখানে চলে আসেন। দেশের বাড়িতে একা থাকেন, আপনার যদি কিছু হয়ে যায়। এ দেশে ভালো চিকিৎসা, ভালো সবকিছু, চলে আসেন, কিছুদিন থাকেন, ভালো না লাগলে আবার দেশে চলে যাবেন। বউমার যেন আরও তাড়া-বাবা, আপনার নাতি আপনাকে মিস করে, চলে আসেন, আমাদের সাথে থাকেন। আমি কি আপনার মেয়ে নই। যে বউমা মাসে এক দিনও ফোন করত না, সেই কিনা ঘন ঘন ফোন করে বলে, বাবা, চলে আসেন। মোবারকের মনে হয়েছিল, ছেলে ও বউমার সুমতি হয়েছে। হয়তো তারা বদলে গেছে আর নাতির টান তো আছেই। তখনো তিনি বুঝতে পারেননি যে তাকে টাকার মেশিন বানানো হয়েছে। তারা বলেছিল, ভালো না লাগলে দেশে চলে যান কিন্তু তখন বোঝেননি, ওয়ানওয়ে টিকিট একবার কাটলে আর ফিরে যাওয়া যায় না। বর্তমানের তিক্ততাময় দিনগুলো সরিয়ে অতীতের সুঘ্রাণ মাখানো দিনগুলোর কথা মনে করে গভীর ঘুমে তলিয়ে যান মোবারক।
শনিবার হওয়ায় নাতিকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার তাড়া নেই। তাই ফজরের নামাজ পড়ে আবারও ঘুমিয়ে যান মোবারক। মিঞা ভাইয়ের কলে ঘুম ভাঙে, ‘ভাইসাব, উঠেছেন? চলেন, একটু হাইটা আসি।’ কাপড়টা চেঞ্জ করে রেডি হন। লিভিং রুমে থাকেন বলে আয়নায় নিজেকে দেখার সুযোগ কম হয়। বাথরুমের লুকিং গ্লাসেই নিজেকে দেখতে হয়। ইদানীং আয়না দেখার প্রয়োজনও বোধ করেন না তেমন। সময় মানুষকে পুরোপুরি বদলে দেয়। আলাওল হলের সুদর্শন চৌকস মোবারকের সেই স্টাইলিশ রূপ, যা বন্ধুমহলে ঈর্ষার কারণ হতো। নিজের জীবনের সেই সব দিনগুলো কেন যেন নিজের কাছেই রূপকথার গল্পের মতো মনে হয়। বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চিরুনিটা বুলিয়ে দ্রুত বের হন মোবারক। ছেলে, বউমা ঘুম থেকে উঠেই যদি আবার কাজ ধরিয়ে দেয়।
মোবারক আর মিঞা ভাই একসঙ্গে ওভাল পার্কের বেঞ্চে বসেন। পার্কে অসংখ্য বাঙালি, তার মধ্যে মুরব্বি আর মাঝবয়সীই বেশি। মিঞা ভাই বলেন, ‘বুঝলেন ভাই, ১০ বছর আগেও এত মুরব্বি দেখি নাই। আগে দেখতাম সব ছোট ফ্যামিলি-স্বামী, স্ত্রী, বাচ্চা। হঠাৎ দেখি মুরব্বিতে ভইরা গেছে, দেশ খালি কইরা এইখানে নিয়ে আসতেছে।’
‘খারাপ কী ভাই, জয়েন্ট ফ্যামিলি আবার ফিইরা আসছে।’
‘জয়েন্ট ফ্যামিলি না ভাই, বয়স্ক মানুষদের কষ্ট দেখলে খুব খারাপ লাগে। পানিতে থাকা মাছ ডাঙায় কি থাকতে পারে? কি বউ, কি মাইয়া-সবই এক, উনিশ আর বিশ।’
‘কী কন ভাইসাব, মাইয়ারা কি আর মা-বাবার সাথে খারাপ আচরণ করে?’
‘বিশ্বাস হয় না, তাই না মোবারক ভাই?’ বলেন মিঞা ভাই, ‘ম্যালা দিন হয় এই দেশে আসছি, ম্যালা ঘটনার সাক্ষী। তাইলে একটা ঘটনা শুনাই, আপনারা যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন, সেই বাসায় থাকত নাসিমা, তার স্বামী আর দুই ছেলেমেয়ে। নাসিমা ডানফিনে কাজ করে, স্বামী রাইট এইডে, ছেলেমেয়েগুলো শিফটের স্কুলে। আদব-কায়দায় ভালো, দেশে ভালো চাকরি করত। আপনার ভাবিসাব নাসিমারে তার ছোট বোনের মতন দেখত। কয়েক বছর পর নাসিমা তার মাকে এই নিউইয়র্কে নিয়ে আসে। হাসিখুশি খালাম্মা মেয়ের বাড়িতে মহাখুশিতে আছেন। কিছুদিন পর নাসিমা তার মায়ের কেয়ার গিভারের কাজ নেয়। সকালে ডানফিনের কাজ, পাশাপাশি মায়ের হোম কেয়ার। ফলে রাতারাতি আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়। অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া বাসা ছেড়ে নাসিমারা পেলহাম বে পার্কের কাছে বাড়ি কিনে চলে যায়। বাঙালি এলাকা থেকে দূরে হওয়ায় ওইখান থেকে মসজিদ, গ্রোসারি, দোকানপাট সবই দূরে। এখানে সবাই বাঙালি ছিল, তাই খালাম্মা বাংলাদেশকে এত মিস করতেন না। কিন্তু পেলহাম বেতে খালাম্মার মন টিকে না। প্রথম প্রথম প্রায়ই আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতেন। আপনার ভাবিও তার যত্ন করত কিন্তু ধীরে ধীরে এই হাসিখুশি মানুষটি গম্ভীর হয়ে যেতে থাকে। আমাদের বাসায় আসাও কমিয়ে দেন। খালাম্মা অসুস্থ, দেখতে যাব যাব করে আমাদের যাওয়া হচ্ছে না। একদিন খবর না দিয়েই আমরা ওদের বাসায় গেলাম খালাম্মাকে দেখতে। কিন্তু বাসায় গিয়ে আমরা একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। তিন বেডরুমের বাসার কোনো রুমেই খালাম্মার ঠাঁই হয়নি। তার ঠাঁই হয়েছে লিভিং রুমের পাশে এক্সটেনশন রুমে, যেখানে হিটিং সিস্টেম কাজ করে না। আপনার ভাবি বলেই ফেলে, এই শীতে যেখানে আমরাই থাকতে পারি না, এখানে খালাম্মা এই রুমে কীভাবে থাকে? খালাম্মার তো নিউমোনিয়া হয়ে যাবে। নাসিমা মুখটা কালো করে বলে, কী যে বলেন আপা, আম্মার জন্য দুটো রুম হিটার আছে, তা ছাড়া ভারী পর্দা দেওয়া, হিটার ছাড়লেই রুম গরম হয়ে যায়। আপনার ভাবির বুঝতে অসুবিধা হয় না এই হাসি-খুশি মানুষটির এমন চুপসে যাওয়ার কারণ। নাসিমা বলে, তিনটা মাত্র রুম। একটাতে আমরা, একটায় ছেলে, আরেকটা রুম মেয়ের। মেয়ে ডর্মে থাকলেও প্রতি সপ্তাহে বাসায় আসে, ওর পড়ালেখার জন্যও তো রুম লাগে। আপনার ভাবির কাছে অনেক বিষয়ই পরিষ্কার হয়ে যায়। আমরা কথা না বাড়িয়ে খানিক পরেই চলে আসি। আপনার ভাবির তার খালাম্মার জন্য ভীষণ পেট পুড়ত। ভালোমন্দ রান্না করে খালাম্মার জন্য নিত। আপনার ভাবির এই মায়াটা তাদের জামাই-বউয়ের খুব একটা পছন্দ হতো না। একদিন খালাম্মা তাকে চুপিচুপি বলে, মারে, আমাদের একলা ফালাইয়া থুইয়া তারা দেশে যাইব। আমি যাইতে চাই, আমারে নিব না। কও তো, আমারে এই নাতির ওপর রাইখা কেমনে তারা যায়। আমার ডর লাগে মা, ভীষণ ডর লাগে। এই বুড়ো মানুষটিকে এভাবে রেখে যাবে ভেবে আপনার ভাবি নাসিমাকে বলে, তোমরা যে কদিন দেশে থাকবা, খালাম্মাকে আমার এখানে দিয়ে যাও। আমি তার দেখভাল করব। তোমাদের কোনো চিন্তাই করতে হবে না। নাসিমা বলে, কী বলেন আপা! আম্মা আপনার বাসায় কেন থাকবে? তা ছাড়া আহনাফ তো আছেই, ও-ই নানির যত্ন করবে। নাসিমার উত্তরে আপনার ভাবি আর খালাম্মাকে আনার জন্য জোর করে না। এবার খালাম্মা বলে, সবই টাকার হিসাব গো মা, টাকার হিসাব। এই এক মাস যদি আমি তোমাদের বাসায় থাকি, তবে তো এক মাসের জন্য তাদের হোম কেয়ার বন্ধ। খালাম্মা আস্তে করে বলে ওঠেন, আমার মাইয়াডা এমন হইয়া গেল কেন। সংসার, সন্তান হিসাব কইরা তারপর আমি। আমরা তো এমন ছিলাম না। খালাম্মা অদূরে বসা নাসিমার বিড়ালটা দেখিয়ে বলেন, এই বিড়ালটার জন্য যেভাবে চিন্তা করে, আমার জন্য তা-ও নয়। আমি এখন নামাজ পইড়া আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আল্লাহ যেন আমার মরণডা তাড়াতাড়ি দিয়া দেয়। আর তোমারে (আপনার ভাবি) আমি একটা কথা কই, আমার মৃত্যু হইলে তোমরা আমারে দেশে তোমার খালুর কবরের পাশে কবর দিবা। জানি, দেশে নিতে ম্যালা টাকা লাগে, তবু তোমরা আমারে দেশেই কবর দিবা।’
কথাগুলো বলতে বলতে মিঞা ভাইয়ের গলা ধরে আসে। মোবারক জিজ্ঞাসা করেন, ‘খালাম্মা কি এখনো বেঁচে আছেন?’
‘না, নাসিমারা দেশ থেকে আসার কিছুদিন পরই তিনি মারা যান।’
‘আর তার কবর?’
‘এখানেই, মুসলিম গোরস্তানে।’
মোবারক আঁতকে উঠে বলেন, ‘কী বলেন!’
‘আপনার ভাবি অনেক চেষ্টা করেছিলেন লাশটি দেশে পাঠাতে। নিজের টাকাসহ আরও দুজনের সহায়তায় কিন্তু আমরা তো খালাম্মার কেউ নই।’
মোবারক স্তম্ভিত হয়ে যান। এত দিন মনে হতো মেয়ের কাছে থাকলে বুঝি এমন হতো না তার। সে ধারণা ভুল মনে হলো। মিঞা ভাই বলেন, ‘ভাইরে, ম্যালা দিন ধইরা এখানে থাকি তো, তাই ম্যালা কিছু দেখছি, শিখছি। একটা কথা কই ভাইসাব, আমরা যে সব সময় এ দেশীয় হলেই মনে করি, এদের সংসার নাই, পরিবার নাই, আদব-কায়দা নাই, আদতে কি তা ঠিক? আমার ছেলে যখন স্প্যানিশ মেয়েরে বিয়া করে, তখন আপনার ভাবি খুবই কষ্ট পেয়েছিল। ভাষা-সংস্কৃতি-খাদ্যাভাস সবই ভিন্ন। যখন থেকে আপনার ভাবি তার মনের ভাষাটা পড়তে পারল আর অসুবিধা নাই, এখন নোরারে দেখলে কি কেউ কইব যে ও বিদেশি বউ। মেয়ে নেই বলে আপনার ভাবির যে দুঃখ ছিল, নোরা তা ঘুচিয়ে দিয়েছে। মোবারক মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতার মতন মিঞা ভাইয়ের মুখ থেকে জীবনের গল্পগাথাগুলো শুনছিলেন। তার মনে হচ্ছিল, তিনি যেন এক গল্পদাদুর কাছে বসে আছেন, যিনি তার ঝোলা থেকে আমেরিকার অন্দরমহলের নিত্যদিনের ঘটনাগুলো একে একে বের করছেন আর মোবারকের চোখকান সব খুলে দিচ্ছেন। ‘বুঝলা মিঞা, সুখ-দুঃখের কথাগুলো নিজের মধ্যে আটকাইয়া রাখবা না, যতই চারপাশের ঘটনা শুনবা, ততই নিজেরে ভাগ্যবান মনে করবা। আনন্দ যদি ভাগ করো, তয় আনন্দ আরও বাড়ব আর যদি কষ্ট ভাগ করো তবে কষ্টর ভার কমব,’ মিঞা ভাই এবার পার্কের বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়ান, ‘চলেন ভাইসাব, স্টারলিংয়ে গিয়ে দুই ভাই সকালের নাশতাটা সারি।’ স্টারলিংয়ে এখন অগণিত বাঙালি রেস্টুরেন্ট, গ্রোসারি, কাপড়ের দোকান, ফুচকা, টংঘর। স্টারলিংকে মোবারকের গাউছিয়ার মতো লাগে। ওরা একটি রেস্টুরেন্টে বসেন। মিঞা ভাই রুমালি রুটি আর আলুভাজির অর্ডার দেন, সঙ্গে গরম গরম চা। রেস্টুরেন্টের টিভি স্ক্রিনে বাংলা খবর চলছে। খবরের সঙ্গে সঙ্গে মিঞা ভাইয়ের গল্পের প্রসঙ্গ পাল্টে যায়। রাজনীতি, অর্থনীতি, সন্ত্রাস দমন, আসন্ন নির্বাচন, হাসিনা-খালেদা হয়ে ড. ইউনূস। আলোচনা যখন তুঙ্গে, তখন ভীতসন্ত্রস্ত এক মহিলা রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে, ‘আপনারা সবাই বাঙালি?’
‘জি।’
‘আমি পথ আউলাইয়া ফেলছি, আমারে একটু বাসায় পৌঁছায়া দেবেন।’
‘বাসার ঠিকানা জানেন?’
‘ঠিকানা তো ভাই কইতে পারমু না। এই যে বড় দালানগুলো, এইগুলোতেই থাকি। রাস্তার ওপরেই বিল্ডিং। ভাবলাম, রাস্তার ওপরই যখন, তখন আর চিনতে অসুবিধা হইবে না। কত দিন হয় আইছি। পোলা, পোলার বউরে কই আমারে একটু বাইরে নিয়া যাও, তাগো সময় হয় না। আজ নিজেই সাহস কইরা বাইর হইলাম। আর এই বিপদে পড়লাম।’
মিঞা ভাই বলেন, ‘আপনার বিল্ডিংয়ের নিচে বা আশপাশে কোনো বড় দোকান আছে?’ মহিলা বলে ওঠেন, ‘বিল্ডিংয়ের নিচে একটা বড় লন্ড্রি আর খাবারের দোকান আছে।’ ‘চিনতে পারছি বইন, আপনি কোন বিল্ডিংয়ে থাকেন। কোনো চিন্তা কইরেন না, চা-নাশতা খান, আপনারে আমরা পৌঁছায়ে দিতেছি।’ মহিলার যে অবস্থা, তাতে চা-নাশতা যে খাবে না, সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। সে বলছিল, ‘আমি কিছু খামু না, আমার একটু বাসায় পৌঁছায়া দেন।’
মহিলাকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে মোবারক আর মিঞা ভাই তাদের গন্তব্যের দিকে নীরবে হাঁটতে থাকেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিঞা ভাই বলেন, ‘বলছিলাম না, পানি ছাড়া মাছ ডাঙায় কি বাঁচতে পারে?’ মিঞা ভাইয়ের এই কথাটি মোবারকের মনে তুমুল ঝড় তোলে। মোবারকের মনে হলো, পাথুরে এই শহরে অনেক দিন তো হলো, এবার ফেরার পালা। মোবারক গতিপথ পরিবর্তন করে স্টারলিংয়ের দিকে হাঁটা শুরু করে বলেন, ‘ভাই, ট্রাভেল এজেন্সিতে যামু, দেশে যাওয়ার টিকিটটা কনফার্ম করমু।’ মিঞা ভাই স্থির দৃষ্টিতে মোবারকের চোখের দিকে তাকিয়ে দুঃখগুলোকে যেন এক নিমেষেই পড়ে নেন। তারপর বলেন, ‘টিকিটের টাকাটা কিন্তু আমি দিমু, না করতে পারবেন না। কোনো এক ভরদুপুরে আপনার বাড়িতে হাজির হমু, সেদিন আপনি আমাদের আম-দুধ-ভাত খাওয়াইবেন। টিকিটের দাম তাতেই শোধ হইব।’ মোবারকের দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। মায়া জিনিসটা বড়ই অদ্ভুত। মোবারক বুকের গহিনে মিঞা ভাইয়ের জন্য একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করেন।