Thikana News
০৮ জুন ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা রবিবার, ০৮ জুন ২০২৫

শুভর কোরবানি ঈদ

শুভর কোরবানি ঈদ



 
রিকশা থেকে নেমে শুভ দেখে, ফার্মগেটের ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের সামনে বেশ লম্বা জট লেগে আছে। এ জট নিত্যদিনের চেয়ে আলাদা। বলা যায়, আরও মারাত্মক! তা অনেকক্ষণই তাকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। যাত্রীবোঝাই বাস যাচ্ছে। রাস্তায় তিল ধারণের জায়গা নেই। মানুষে রিকশায় বাসে প্রাইভেটে পুরো এলাকা গিজগিজ করছে! এই অবস্থায় প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে সে কোনো বাসের ধারেকাছেও যেতে পারছে না। সে এক কঠিন অবস্থা! বাসে ওঠা তো পরের বিষয়। মানুষ আর মানুষ! শিশু। নারী। পুরুষ। বৃদ্ধ। বৃদ্ধা। কেউ আর বাদ নেই! এত মানুষ! এরই সাথে ভিক্ষার কারবারিদের উৎপাতও চরমে! শুভ আগ্রহ নিয়ে দেখছে, হাতে-পায়ে ছালার চট পেঁচিয়ে ট্রলিতে শায়িত লম্বা চুল-দাড়িতে আবৃত এক শক্ত-সুঠাম পুরুষ, গলা ছেড়ে ‘দ্বীনের নবী মোস্তফায়, রাস্তা দিয়া হাইটা যায়’ সুর করে গাইছে। মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার এ এক অভিনব কৌশল তার। তারই পেছনে অপুষ্ট মেয়েশিশু কোলে ময়লা শাড়ি গায়ে রুগ্ণ মহিলা, চার চাকার ট্রলি ঠেলে; আনন্দ-ছন্দ সিনেমার দিক থেকে এগিয়ে আসছে।

প্রতিদিন ঢাকা শহরের নানা জায়গায় যাতায়াত করতে এ রকম দৃশ্য নিত্যই দেখে সে। বড় বোন শিউলি এবং দুলাভাই পলাশের সাথে মণিপুরি পাড়ার ভাড়া বাসায় থাকে শুভ। নটর ডেমে মানবিকে স্নাতক করছে সে। এবার দ্বিতীয় বর্ষে আছে। পড়াশোনার পাশাপাশি প্রাইভেট টিউটর হিসেবে মাধ্যমিক স্তরের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পড়ায় সে।

হ্যাঁ। সামনে কোরবানি ঈদ বলেই কথা। মানুষ ছুটছে দম বন্ধ করে। সকলেরই সেই রকম ব্যস্ততা! দেখতে দেখতে দুদিনের মধ্যেই ঢাকা একেবারেই ফাঁকা হয়ে যাবে। ঠিক ঈদের এক দিন আগে ঢাকার রাস্তায় গাড়ির চাকা একেবারেই ঘুরতে দেখা যাবে না। তখন চূড়ান্ত ফাঁকা দেখা যাবে, এই ঢাকার চিত্র!
এই সময় বাসস্টেশনে গরু। রেলস্টেশনে গরু। লঞ্চঘাটে গরু। এমনকি বিমানবন্দরেও গরু। গরু কোথায় নেই? গরুতে সয়লাব হয়ে গেছে পুরো ঢাকা! মণিপুরি পাড়ার বাসা থেকে বেরিয়ে ফার্মগেটে যাওয়ার জন্য রিকশা নিতে হলো তাকে। অথচ টঙ্গী-জয়দেবপুরগামী বাসগুলো তার বাসার একেবারে কাছ দিয়েই দেদার যাওয়া-আসা করছে। হ্যাঁ, এখানে বৈধ কোনো স্টপেজ নেই। তবে আওলাদ হোসেন মার্কেটের সামনে এসেই হরদম থেমে যায় টঙ্গী-জয়দেবপুরের বাসগুলো। বিপরীত গন্তব্যের অর্থাৎ গুলিস্তানগামী বাসগুলোও তা-ই করে। টঙ্গী যাওয়ার জন্য এখান থেকেই বাসের ডান্ডা ধরে উঠে পড়া যায়। তো আজকের কথা একেবারেই আলাদা। শুভর সাথে রয়েছে মাঝারি আকারের একটা ভারী ব্যাগ। তাই এখান থেকে বাসে চড়া হয়নি তার। এবারের কোরবানি ঈদে বেশ লম্বা ছুটি আছে। গ্রামের বাড়িতে এই ছুটিটা বেশ হইচই করেই কাটানো যাবে।
বাড়ির জন্য অনেক কিছুই নিয়ে যাচ্ছে সে। নিডোর গুঁড়ো দুধের বড় টিন একটা। ছোট দুটো ভাইবোনের জন্য নতুন জামাকাপড়, জুতা। মায়ের জন্য নতুন শাড়ি। বাবার জন্য একটি শার্ট ও লুঙ্গি। সাথে কিছু ফল ইত্যাদি। তো, শুভ আন্দাজ করছে, ওদের বাড়িতে এবারের ঈদে হয়তো বকরি কেনা হবে। গতবার মা অসুস্থ ছিলেন বলে কোরবানি দেওয়া সম্ভব হয়নি। সে সময় মাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল তাকে। সে সময় অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল তাদের সবার।

অনেকক্ষণ হন্যে হয়ে ঘোরাফেরা করার পর মহাখালী পর্যন্ত একটি টেম্পোতে ওঠার সুযোগ পেল শুভ। কোনোমতে ঠেলেঠুলে ভারী ব্যাগসমেত উঠতে পারল। এ সময় নিজের ভেতর প্রশান্তির আমেজ অনুভব করে সে। দেখা যাক। মহাখালী গেলে টঙ্গী পর্যন্ত একটা উপায় হবেই। গুলিস্তান টু জয়দেবপুর বাসের আনাগোনা লেগেই থাকে সেখানে। ভারী ব্যাগটা তার দুই হাঁটুর ওপরই রাখতে হলো তাকে। টেম্পোতে ১০ জনের আসনে ১৪ জন বসিয়েছে। আবার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কতজন! ভেতরে বেশ গাদাগাদি করেই বসতে হলো তাকে। এই অবস্থায় টেম্পো উল্টে না গেলেই হয়! এ রকম তো অহরহ ঘটছে। তার বেলায়ও হয়েছিল একবার! আয়ু থাকায় সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিল সে! তাই এ যাত্রায়ও একমাত্র আল্লাহ‌ ভরসা!

এদিক-ওদিক ঘাড় বাঁকা করে, বারবার মাথা ঘুরিয়ে ডানে-বাঁয়ে দেখার চেষ্টা করে সে। ফার্মগেট ছাড়িয়ে আওলাদ হোসেন মার্কেট, পুরাতন এয়ারপোর্ট, তারপর জাহাঙ্গীর গেট মোড়, শাহীন কলেজ এলাকা এবং মহাখালী রাস্তার দুই পাশে মানুষে আর গরুতে সয়লাব হয়ে গিয়েছে! সামনে-পেছনে যতদূর চোখ যায়, শুধু গরু আর মানুষ! গরুতে এবং মানুষে এ এক অকল্পনীয় মিলনমেলা! হ্যাঁ। কোরবানি ঈদ বলেই কথা। চিত্রটা দেখতে বেশ উপভোগ্যই মনে হচ্ছে তার কাছে। বছরের প্রতিদিন তো আর এমন দেখা যায় না। আহা! উৎসবের দারুণ এক আবহের সৃষ্টি হয়েছে! হবেই তো!

মহাখালী আসতে না আসতেই শুভ দেখে, সেই রকম বেগতিক অবস্থা! টেম্পোর পেছনে লোকজন দৌড়াচ্ছে। শুধু টেম্পো কেন? উত্তর-দক্ষিণ দুদিক থেকে বাস-সিএনজি সব জঞ্জালের মতো যা আসছে, ঠেলাঠেলি করে লোকজন উঠতে কসরত করছে! উঠতে কেউ পারছে। আবার অনেকেই পারছে না! সমস্যা হলো, কোনো যানবাহন দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয় না। বোধ হয়, সেই সময় ওদের নেই। কে চাকার নিচে চলে যাবে, কে পিষে মরবে, তা দেখার ফুরসত নেই! মহাব্যস্ত তারা সবাই! এবং এত কিছু নিয়ন্ত্রণ করার যারা আছে, তারা ব্যস্ত অন্য ধান্দায়। বিশেষ পোশাকধারী, মাথায় হেলমেট, হাতে বেত কিছু মানুষ যানবাহনের চালকদের সাথে ভাব বিনিময়ে ব্যস্ত। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তৎপরতা নেই তাদের মাঝে। সংগত কারণে শুভর কাছে এখন এটাই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।

হ্যাঁ! গরু আর গরু! গরুতে গরুময় হয়ে উঠেছে পুরো রাজধানী ঢাকা নগরী! ভারী ব্যাগটা মাটিতে রেখে শুভ তাকিয়ে দেখছে মহাখালীর চিত্র।
-ভাইজান, আপনি কি গরু কিনেছেন? নাকি কিনবেন? আমার নাম রসু খাঁ।
শুভ লক্ষ করল, আগাগোড়া সুমালিয়ানদের মতো দেখতে রসু খাঁ লোকটা তার ব্যাগের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মাথার চুল, গায়ের রং এবং ঠোঁট দুটো মাশাল্লা! মুখভর্তি পান। যত্রতত্র ঘন ঘন পিক ফেলছে। আবার অনবরত নড়াচড়া করছে। তার হাত-পা, সারা শরীর অস্থির হয়ে আছে। তাকে দেখেই শুভর ষষ্ঠেন্দ্রিয় সজাগ হয়ে যায়। শুভ বলে, ‘এই ঢাকা থেকে আমি গরু কিনব কেন? আমি যাচ্ছি, আমার গ্রামের বাড়িতে।’ লোকটাকে সুবিধার মনে হচ্ছে না।
-কেন? কোরবানি দেবেন না? আপনার নাম?
-হ্যাঁ দেব। শুভ আমি।
-তাইতো জিজ্ঞেস করছি। কেমন আছেন শুভ সাহেব?
-আমি কি গরুর হাটের দালাল? আমাকে দেখলে কি তা-ই মনে হয়? আমি ভালো আছি।
-ধুর। কী যে বলেন!
-কী আর বলব। যা দিনকাল পড়েছে!
-দেখেন না, দেশের চিত্রটা কী দাঁড়ায় শেষে!
-হ্যাঁ, কিছুই হবে না।
-তাও ঠিক। এটাই বাংলাদেশ। আচ্ছা। এত গরু! কোথা থেকে আসে ওরা?
-না। এখন ওরকম না। আপনি যা ভাবছেন, অবস্থা আসলে তা নয়।
-তা নয় মানে? বুঝলাম না।
-মানে বুঝলেন না? ওই যে বর্ডার দিয়ে গরুরা এখন সেই আগের মতো আর পাচার হতে পারসে না। দিন পাল্টে গেসে!
আরেকজন প্রবীণ এগিয়ে এসে বলেন, ‘আপনি কি সীমান্তে গিয়ে দেখেছেন মিয়া?’
-সীমান্তে? না। দেখেন, আমাদের সীমান্ত তো অনেক লম্বা।
রসু খাঁ নামের লোকটা খয়েরি দাঁত দেখিয়ে কেলিয়ে হাসে। সে বলে, ‘কোনখান দিয়া গরু ঢুইকা পড়তেসে, তা কেউ বুঝতেই পারসে না।’
-আরে নাহ্। বাইরের গরু দেখলেই আন্দাজ করা যায়। এখন দেশেই অনেক গরু হচ্ছে।
প্রবীণ বলেন, ‘বাইরের গরুর ইয়া লম্বা লম্বা ঠ্যাং। গায়ে-গতরেও... ওরে বাপস!’
শুভ বলে, ‘কিন্তু জানেন কি, মাংস অনেক কম। সলিড মাংস একেবারেই কম!’
-হ্যাঁ, তা হোক। সমস্যা নাই। গরু হলেই হয়। হ্যাঁ কোরবানির গরু!
প্রবীণ বলেন, ‘মাংস কম হলেও চামড়াটা কিন্তু বেশ!
-আরে দেখেন না। গরু কীভাবে ঢুকে পড়সে!
রসু খাঁর মন্তব্য।
-ঢুকে পড়ছে মানে? বললাম তো, আগের মতো তেমন আসছে না।
শুভর কথা শুনে পাশ থেকে আরেকজন উঠতি বয়সী যুবক বলে ওঠে, ‘ও। সেটা বলেন। আগের মতো তেমন না। এবার সত্য বলে স্বীকার করেছেন, হাহ্!’
-না। আমি বলেছি, ঢাকায় বেশুমার গরু ঢুকে পড়ছে।
রসু খাঁর কথা শুনে যুবক বলে, ‘তা তো পড়বেই। ঢাকায় মানুষ বেশি। তাই গরুরাও বেশি। উপায় নাই!’
-কিন্তু ঢাকা যে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।
শুভ মন্তব্য করে।
প্রবীণ বলেন, ‘তা তো যাচ্ছেই। আরও যাবে।’
-তবে? তবে এত গরু! তারা যাবে কোথায়?
শুভ প্রশ্ন করে।
-ঠিক বলেছেন। একেবারেই লজিক্যাল প্রশ্ন।
যুবক বলে, ‘আগে তো এত কিছু চিন্তা করিনি!’
-ওই যে দেখেন না, গরুর পায়ের গতি কী রকম!
-হ্যাঁ, মালিকদের চেয়ে গরুরাই চলছে বেশি। দেখে মনে হচ্ছে, ওদের তাড়া বেশি! এক হাট থেকে অন্য হাটে, দেখেন কেমন ছুটে চলছে। মনে করেন, আপনার সেই সদরঘাট থেকেই গরুদের যাত্রা শুরু। এই যেমন বুড়িগঙ্গার ঘাটে, নৌকা-ইস্টিমার থেকে সদরঘাটে নেমে পড়ছে। আশপাশে অনেক হাট বসেছে। ধূপখোলা। তাঁতিবাজার। আলুবাজার। রায়সাহেব বাজার। ধূপখোলা ময়দান। যাত্রাবাড়ী। সায়েদাবাদ। শনির আখড়া...। আরও কত হাট!
শুভ বলে যায়, ক্রমে ক্রমে উত্তর দিকে গরুরা হাঁটলে ওরা দেখে, আশপাশে হাট আর হাট দেখবেন! শুধুই হাট! খালি গরুর হাট! সবদিক রংবেরঙের ব্যানারে ছেয়ে গেছে। ‘বিরাট গরুর হাট!’ ‘ঐতিহাসিক গরুর হাট।’ তা গরুরা খোঁজে, কোথায় গেলে তাদের দাম বেশি হাঁকা যাবে এবং বেশি দাম-প্রাপ্তির সম্ভাবনাও বেশি! তো আপনার এই ‘বিরাট গরুর’ এবং ‘ঐতিহাসিক গরুর’ হাটের তো অভাব নেই।
-ঠিক বলেছেন।
শুভর কথার পৃষ্ঠে মন্তব্য ছুড়ে দেন প্রবীণ। শুভ আবার লম্বা ফিরিস্তি দেয়, ‘তাই এক হাট থেকে অন্য হাটে ছুটে চলাই লাভ। এ সময় ওদের পায়ে লক্ষ্মী! যত হাঁটো তত লাভের সম্ভাবনা। পুরান ঢাকার ঘোর কাটিয়ে উত্তর দিকে গুলিস্তান, পল্টন ছেড়ে এগোলেই কাওরানবাজার। এখানে গরুদের বিরাট আখড়া। আরও সামনে, ওদিকে সংসদ ভবনের সামনে, গরুদের পার্লামেন্ট জমে উঠেছে! সামনেই মোহাম্মদপুর টাউন হল এলাকা। অবস্থা তথৈবচ! হা হা। এগিয়ে যান। দেখবেন ওদিকে গাবতলী থেকেও গরুর বাঁধভাঙা স্রোত আসছে! কোথাও আর তিল ধারণের জায়গা নাই! এদিকে মহাখালী তো পুরোটাই গরু দিয়ে দখল হয়ে গেছে! গরুরা এখন ওই যে, ইউরোপ-আমেরিকার মতো...। বিশ্বাস হয় না?’
-হাঃ হাঃ হাঃ! আপনার ইউরোপ-আমেরিকা মানে?
রসু খাঁর প্রশ্ন।
-আপনি বাঙালিদের দেখেন না। অভিবাসী হয়ে কেমন জানবাজি রেখে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে, ঢুকে পড়ছে ইউরোপে!
শুভ যোগ করে, ‘আমাজন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে, মেক্সিকোর বর্ডার দিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছে কেমন!’
-হ্যাঁ। তো আপনার ওখানে গরু কোথায়?
রসু খাঁ আবার প্রশ্ন করে। তার উত্তরে যুবক বলে, ‘তো ওখানে গরু নাই। গরু তো আমাদের দেশে! তারাও অভিবাসী হইয়া, জানবাজি রাইখা এক হাট থেইকা অন্য হাটে পাড়ি দিতাছে।’
-হাঃ হাঃ হাঃ!
রসু খাঁ হাসে। সে শুভকে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার বাসের খবর কী?’
-বাস নাই! নাই মানে সিট খালি নাই। এমনকি রডও খালি নাই! ওই যে দেখেন না। ফার্মগেট থেকে মহাখালী কোনোমতে আমি এসেছি টেম্পোতে! ও মা! কী অবস্থা! তাকিয়ে দেখেন। লাইনের ওপর দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে। ট্রেনের চেহারা দেখা যাচ্ছে না! একদম পিঁপড়ার মতো মানুষ জেঁকে ফেলেছে গোটা ট্রেনটা! কী অবস্থা!
শুভ যোগ করে বলে, ‘শুধু মানুষ আর মানুষ। দরজায় মানুষ। জানালায় মানুষ। ছাদের ওপর তার চাইতে বেশি মানুষ! মানুষে গিজগিজ করছে। মনে হয় বিশ্ব ইজতেমা লেগেছে!’
-হ্যাঁ, তা-ই তো দেখছি।
পাশেই দাঁড়িয়ে কোট-টাই পরিহিত এক ভদ্রলোক। তিনি এগিয়ে আসেন। হাতে কালো ব্রিফকেস। তিনি মন্তব্য করেন, ‘কী আর করবেন?’
রসু খাঁর প্রশ্নের উত্তরে শুভ বলে, ‘কী করব, তা-ই ভাবছি। মনে হচ্ছে, এ যাত্রায় পায়ের ওপর ভর করেই যেতে হবে। যাব টঙ্গী। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাকিটা রাস্তা হেঁটেই যেতে হবে। সাংঘাতিক কঠিন অবস্থা!’
-ওই যে দেখেন।
যুবক বলে, ‘উত্তর দিকে মানুষ কেমন হন্তদন্ত হয়ে দৌড়াচ্ছে! দেখেন! দেখেন! ঘটনা কী?’
-আরে! আরে! ওদের পেছনে সমন্বয়ক লেগেছে নাকি? হাঃ হাঃ হাঃ!
রসু খাঁ রসিকতা করে।
-আস্তে বলেন! ওরা শুনলে খবর খারাপ করে দেবে! হ্যাঁ!
শুভর মন্তব্য শুনে হাসে রসু খাঁ।
সবার সাথে তাল মিলিয়ে সামনের দিকে পা চালায় শুভ। সমস্যা, তার কাঁধে ভারী ব্যাগটা। ওটা রাস্তায় রেখে দাঁড়ায় সে। একটু জিরিয়ে নেওয়া দরকার। দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে সে বলে, ‘দেখেন! দেখেন! দক্ষিণ দিক থেকেও কেমন ঊর্ধ্বশ্বাসে মানুষ ছুটে আসছে!’
-ও মিয়া। দৌড়ান তো! মূর্তির মতো এখনো দাঁড়াইয়া আছেন?
এক বুড়ামতো মানুষ সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা মুখভর্তি দাড়ি নিয়ে দৌড়াচ্ছেন এবং চিৎকার করে বলছেন।
-বিষয়টা কী, চাচা?
-আগে দৌড়ান তো মিয়া! পা চালান। জান বাঁচান!
বুড়া চাচার কথায় শুভ যেন এবার সংবিৎ ফিরে পায়। এ কী অবস্থা! সে দেখল, সবাই দৌড়াচ্ছে। এ সময় একমাত্র দৌড়ই সবার জন্য বিধেয় এবং নিপাতনে সিদ্ধ। সত্যিই এখন সবার জন্যই ‘জান বাঁচানো ফরজ’! হ্যাঁ, ওই রসু খাঁও মনে হয় ছুটে চলে গিয়েছে অনেকটা দূর। নাকি পেছনে পড়ে আছে? বাকিরা এখন দৌড়ের ওপর আছে! হ্যাঁ, ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা!’ তাই কেউ আর দাঁড়িয়ে নেই। শুভও এবার দ্রুত পা চালিয়ে সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে, মহাখালীর দিক থেকে সব ভেঙেচুরে তাণ্ডব তেড়ে আসছে উত্তর দিকে! এ এক মহাপ্রলয়!
দক্ষিণের মহাখালী ছেড়ে চেয়ারম্যান বাড়ি। তারপর কাকলী-বনানী। তারপর সামনের দিকে ব্যতিব্যস্ত মানুষ সকলেই যে যেমন পারছে টান টান হয়ে কেবল দৌড়াচ্ছে। কারও মুখে শব্দ নেই। কোনো ভাষা নেই। এখন দৌড়ই সকলের ভরসা!
চার হাত-পা ছড়িয়ে শুভও দিব্যি দৌড়াচ্ছে। এ সময় সুপারসনিক গতিতে দৌড় ছাড়া আর কিছু করার নেই তার। টগবগে যুবক শুভ। দৌড়ে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে সে। এবার সে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে। যদিও তার নিয়মিত দৌড়ানোর অভ্যাস আছে, তার পরও। প্রতিদিন ভোরে সে মণিপুরি পাড়া থেকে বেরিয়ে সংসদে যায়। সময় নিয়ে হাঁটে এবং দৌড়ায়। সে দেখছে, এখন ঢাকা শহরজুড়ে দৌড়। হাঁটা নেই। শুধুই দৌড়। মানুষ সকলেই দৌড়াচ্ছে। যেন তারা বলছে, ‘দৌড়াও সামনের দিকে।’ হ্যাঁ, কোরবানির ঈদ বলেই কথা।
এখন তো মানুষ সকলেই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। স্বাভাবিক দিনেও ঢাকায় হাঁটাই দায়। এখানে পথচারীদের পায়ে হাঁটার, সেই জায়গা এবং সেই সুযোগ কোথায়? ফুটপাত তো দখল হয়েই থাকে। সবজির, মাছের, ফলের, গার্মেন্টসের কাপড়ের, জুতা-চপ্পলের, মাটির এবং প্লাস্টিকের মনোহারি বাসনকোসন ইত্যাদির পসরা সাজিয়ে হকাররা ঢাকার জমিন জবরদখল করে আছে। আগ্রহী ক্রেতারাও হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সবখানে! আবার যানজট তো নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। কোনো কিছুতেই নিয়ম নেই। শৃঙ্খলা নেই। নিয়ন্ত্রণও নেই। এটাই এই জাতির জন্য ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’! এটাই সত্য, এবারের কোরবানির ঈদের ঢাকায় শুধু হাঁটাতেই নয়; দৌড়েও শামিল হয়েছে শুভ। বিষয়টি তার জন্য ‘ঐতিহাসিক’ বটে। তাই সে নিজেকে নিজেই বলে, ‘তুমি দৌড়াও শুভ! পেছনে তাকানোর সময় নেই!’ শুভ দেখে, নিজেকে হালকা করে দিব্যি দৌড়াচ্ছে সে! আমজনতার কাতারে দৌড়ের প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে!
ওই বনানীর পরে সামনেই রেল ক্রসিং। তা পেরিয়ে গেলেই স্টাফ কোয়ার্টার রোড। ডান দিকে, মেইন রোডের পূর্ব পাশে সাবেক এরশাদ আর্মি স্টেডিয়াম এলাকা দৌড়ে এসেছে। হা, এরশাদ আর্মি স্টেডিয়াম! ইতিমধ্যেই ওটার নাম বদলে গেছে। সবকিছু রেখে দেশে এখন নামবদলের রাজনীতি চলছে! সামনে আবার কী নাম হবে, একমাত্র উপরওয়ালাই জানেন!
এখনো মানুষ দৌড়াচ্ছে! এবং শুভও! আচ্ছা, মানুষগুলো সবাই এমন দৌড়াচ্ছে কেন? এতক্ষণ পরে তার মনে এই প্রশ্ন উদয় হলো। ঠিকই তো। বেবাক মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে কেন? খুব ভালো এবং জুতসই একটা প্রশ্ন! আসলে বিষয়টা কী? সাথে শুভ নিজেও! আশপাশে অনেকেই বলছে, ‘পেছনে সমন্বয়ক লেগেছে!’ ওরে বাবা! তাহলে তো আসলেই খবর খারাপ! এবার নিজেকেই নিজে বলে শুভ, ‘আর পারছি না শুভ!’ বাস্তবিকই সে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে। বাপের জনমে এতটা পথ কখনো দৌড়ায়নি সে! একেবারেই খাঁটি সত্য কথা!
তো বনানী রেলস্টেশনের পর অনেকটা পথ ছাড়িয়ে রেল ক্রসিং পার হয়ে এবার নিজের গতি কমিয়ে দেয় শুভ। সামনে গিয়ে চূড়ান্ত একটা কিছু করবে সে। এটাই শেষ সিদ্ধান্ত। যা হয় হোক! কপালে যা লেখা আছে, তা-ই মেনে নেবে সে। হ্যাঁ! ‘কপালের লিখন যায় না খণ্ডন!’
এবার পেশাদার দৌড়বিদের মতোই দেখতে একজনকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করে শুভ, ‘কী হয়েছে, ভাই সাহেব?’ তার হাতে লম্বা এক লাঠি!
-আমার আবার কী হইব? হইসে তো আমার দুলাভাইয়ের। তার ১২ লাখ টাকার গরু...!
-বলেন কী? ১২ লাখ টাকার গরুর আবার কী হইল?
-ছুটে পালাইতেসে!
-পালাইতেসে মানে? ছিনতাইকারী লেগেছে? নাকি সমন্বয়ক?
-আরে নাহ্! দুলাভাইয়ের হাত থেকে হেঁচকা টানে...! ফাজিল গরু! ও একটা বেয়াদব!
লোকটা হাঁপাচ্ছে!
-তারপর?
-তারপর আবার কী। যা হবার তা-ই হয়েসে! ওই গরু পালাইয়া যাইতাসে গা! তাই আমরাও দৌড়াইতেসি! গরুকেও বিশ্বাস করা যায় না! এই তো কপাল! ওরে ধরতে পারলে আগে কিছু উত্তম-মধ্যম! ওর মা-বাপের নাম ভুলাইয়া দিমু! গরুর ঘরের গরু কোথাকার!
-আরে ধুর! তাই ঢাকা শহরের বেবাক মানুষ এখন গরুটার পেছনেই দৌড়াচ্ছে! সবকিছু পেছনে ফেলে ওই ফাজিল বেয়াদব গরুটার পেছনে ছুটে চলছে! সবাই দেখি দৌড়ের ওপর! আচানক কারবার! এই তো নিয়তির পরিহাস!
-ঠিক তা-ই।
-ও খোদা! রক্ষা করো!
নিজের শরীরের লাগাম টেনে এবার দাঁড়িয়ে পড়ে শুভ। পুরো শরীর তার ঘেমেনেয়ে জবজবে! মাথা থেকে গাল, গণ্ডদেশ বেয়ে নোনা গরম ঘাম নিচের দিকে নামছে! তার জন্য এখন পানি জরুরি হয়ে পড়েছে! এতক্ষণে তার খেয়াল হলো, পেছনে কী যেন সাংঘাতিক অঘটন একটা ঘটে গেছে! তাই আন্দাজ করতে চেষ্টা করছে সে। তার গলা, বুকের ভেতরটা শুকিয়ে একেবারে সাহারা হয়ে আছে!
হঠাৎ তার মনে পড়ল, সে তো বাসা থেকে একটি ভারী ব্যাগ নিয়ে এসেছিল। ওই ব্যাগের ভেতর গুঁড়ো দুধের বড় টিন, মায়ের জন্য শাড়ি, বাবার জন্য শার্ট-লুঙ্গি, ছোট ভাইবোনের জন্য জামা-জুতো, বিভিন্ন ফল ইত্যাদি ইত্যাদি! কী সর্বনাশ! এখন কী হবে তার? সে কি আবার পেছন দিকে ফিরে যাবে? তবে তার হারিয়ে যাওয়া ব্যাগ? সে কি আর ফিরে পাবে? সে নিজেকে প্রশ্ন করে, ‘এই ঢাকা শহরে এও কি বাস্তবিক সম্ভব? ইতিহাসে এমন কি কখনো হয়েছে, এই ঢাকায় কেউ কোনো হারানো ব্যাগ ফিরে পেয়েছে?’ না! এমন কোনো দৃষ্টান্তের কথা এ সময় ঠিক তার স্মরণে আসছে না। তার কোনো ইতিহাসও লেখা নেই কোথাও! হ্যাঁ! এটা ঢাকা শহর! এবং বাংলাদেশের রাজধানী। তাহলে এখন কী হবে তার? গত রোজার ঈদে বাড়ি যাওয়া হয়নি তার। তাই এবারের কোরবানির ঈদেই যাচ্ছে সে। বাড়িতে তার মা-বাবা, ভাইবোন সবাই অপেক্ষা করছে! এলাকার বন্ধুবান্ধবও। তার স্বপ্ন ছিল এবার সবাই মিলে আনন্দ করবে। সেই স্বপ্নটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল! সে নিজেকে বলে, ‘হায় শুভ! এই কি ছিল তোমার ভাগ্যে!’
মনে প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে চলমান মানুষ এবং যানবাহন-ভর্তি চলতি রাস্তার পাশেই একটি শুষ্ক আধমরা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে পড়ে আমাদের গল্পের নায়ক ঘর্মাক্ত, অবসন্ন এবং হতাশাগ্রস্ত শুভ লস্কর! সে বিড়বিড় করে বলে, ‘হ্যাঁ! শুভ, এটাই তোমার এবারের কোরবানি ঈদ!’
 

কমেন্ট বক্স