Thikana News
০৪ অগাস্ট ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা সোমবার, ০৪ অগাস্ট ২০২৫

ভালোবাসার স্থানান্তর

ভালোবাসার স্থানান্তর
মি. খান বাগানবিলাসী লোক। এপ্রিল মাস এলেই বাগান পরিচর্যার কাজে লেগে পড়ে। অবসরের কিছুটা সময় ভালো কাটে। মিসেস খান তার উল্টো প্রকৃতির-শুচিবাইগ্রস্ত। মাটিতে পোকামাকড়, কেঁচো থাকে। তাই মি. খান বাগানের কাজ একাই করে, গ্লাভস পরে কাজ করে, তবু গৃহিণীর শুচিতা রক্ষায় বারবার সাবান ঘষে হাত ধুতে হয়। সেদিন মি. খান বাগান প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। এক ভদ্রলোক তার সাত-আট বছরের নাতনির হাত ধরে মি. খানের পাশে এসে দাঁড়ায়। নাতনির চোখে জল গড়াচ্ছে। ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে বলে-আমি প্রবীর মিত্র, নাতনির পরিচয়ও করিয়ে দেয়-আমার নাতনি ‘জয়া’। আঙুল উঁচিয়ে দেখাল-আমি ওই কর্নারের বত্রিশ নাম্বার বাড়িটা কিনে নতুন এসেছি। আমাদের একটা বিপত্তি ঘটে গেছে। আমার নাতনির পোষা বিড়ালটা গতকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। নাতনি ওর জন্য কেঁদে কেঁদে সারা হচ্ছে। কাল থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। ছোট্ট জয়ার মিষ্টি চেহারার কান্নাভরা মুখটা ভারি ভালো লাগে। মি. খান কিছুটা সময় এই শিশুসঙ্গ চায়, তাই স্নেহভরে জয়াকে কাছে টেনে বলে-তোমার বিড়াল দেখতে কেমন?
জয়া আগ্রহী হয়। ওর নাম ‘বৃষ্টি’, ওর ধারালো নখ নেই, দিদা ওর নখ কেটে দিয়েছে। ওর নাম ধরে ডাকলে আমার কাছে ছুটে আসে। মি. খান রসিকতা করে বলে, আমার দরজাটা খোলা ছিল, লুকিয়ে আমার ঘরেও ঢুকে যেতে পারে, পেছনের গার্ডেনেও ইঁদুর শিকারে যেতে পারে, ইঁদুর তো বিড়ালের প্রিয় খাবার।

ঘৃণায় জয়া নাক সিটকায়-ছিঃ ছিঃ, আমার বিড়াল ইঁদুর খায় না। ও তো ক্যান খাবার খায়।
মি. খান প্রস্তাব দেয়-চলো, আমার ঘরের আনাচ-কানাচে ও পাশের গার্ডেনে খুঁজে দেখি।
জয়া বৃষ্টি, বৃষ্টি করে ডেকে সোফার পাশে খাটের নিচে পেছনের গার্ডেনে খুঁজে বিড়ালের দেখা না পেয়ে হতাশ হলো। মি. খান এই ফাঁকে একটু চা-নাশতার আয়োজন করে। বিড়ালের সন্ধানে এসে প্রবীর আর মি. খানের কিছুটা সময় ভালো কাটল। মি. খান জয়াকে অভয় দেয়-জয়ামণি, মন খারাপ করো না। কুকুর-বিড়াল বাসা চিনে আসতে পারে। তোমার বিড়ালটা হয়তো হাঁটতে হাঁটতে দূরে চলে গেছে। তাই ফিরতে দেরি হচ্ছে। দু-চার দিনের মধ্যেই চলে আসবে। জয়া অবাক। মি. খান জোর দিয়ে বলে, সত্যি বৈ মিথ্যা বলব নাকি? আমি তোমায় মিথ্যা বলতে পারি? আর যদি না আসে, তুমি দাদুকে নিয়ে আমার কাছে চলে এসো। আমরা সবাই মিলে খুঁজে তোমার বৃষ্টিকে বের করবই। জয়া একটু আশ্বস্ত হয়ে দাদুর হাত ধরে বাড়ি ফিরল। জয়া যাওয়ার সময় আবার বলে, ‘বৃষ্টি’ না ফিরলে আমি আবার আসব, তুমি ওকে খুঁজতে আমাদের সাথে যাবে তো? মি. খান দরাজ হেসে জবাব দেয়-যাব না মানে, আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, অবশ্যই যাব। জয়া কোনো কথা না বলে শুধু হাসল। মি. খানের মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল।
প্রবীর মিত্র মি. খানের সমসাময়িক বয়সেরই হবে। নাতি-নাতনির সুখ ভোগ করছে। মি. খানের এক ছেলে ও এক মেয়ে। মনে কত শখ ছিল বৃদ্ধ বয়সে নাতি-নাতনির সঙ্গে সময় কাটাবে। বিধি বাম। ছেলেটা ফনফার্ম ব্যাচেলর হয়ে বিয়েথা করল না। মেয়ে বেশি বয়সে বিয়ে করেছে, এখনো সন্তানাদির দেখা নেই। বৃদ্ধ বয়সে একা একা দিন কাটাতে হচ্ছে। দুদিন পর জয়া দাদুকে নিয়ে এসে অনুযোগ করে-নতুন দাদু, তুমি বলেছিলে বৃষ্টি চলে আসবে, কই ও তো এল না। প্রবীর মিত্র হাসতে হাসতে মি. খানকে বলেÑদাদা, আমার নাতনি আপনাকে একটা নাম দিয়েছে ‘নতুন দাদু’। মি. খান খুশি হয়ে বলে, একদম সঠিক নাম দিয়েছে, দাদুই বটে তার ওপর নতুন পরিচয়। নামের কথায় একটা কথা মনে হলোÑজয়ামণি, তোমার বিড়ালের নামটা কে দিয়েছে? জয়া কথা বলার সুযোগ পেল-নতুন দাদু, ওর নামটা আমি দিইনি। দিদা দিয়েছে। কেন জানো? মি. খান বলে, আমি জানব কী করে, খুলে বলো। একদিন ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বৃষ্টিতে দাদু একটা বিড়ালের বাচ্চা নিয়ে ঘরে ঢুকে দিদাকে বলে, বিড়ালের বাচ্চাটা শীতে কাঁপছে, ওকে হিটারের পাশে রেখে বাঁচাও। আমি দিদার হাতে বচ্চাটা দেখে কান্না জুড়ে দিলাম। আমার কান্না দেখে দাদু বলে কী হয়েছে জয়ামণি, তুমি কাঁদছে কেন? আমার কান্না বেড়ে যায়, আমি বলি, কাঁদব না, তুমি বিড়ালটা আমাকে না দিয়ে দিদাকে দিয়ে দিলে। আমার কথা শুনে দিদা হেসে বলে, বিড়ালটা তো তোমারই, আমি শুধু তার শরীরটা মুছে হিটারের পাশে তা দিচ্ছি। দিদার কথা শুনে খুশিতে দিদাকে জড়িয়ে ধরি। সেই থেকে দিদাই ওর সব কাজ করে। খাবার দেয়, নখ কেটে দেয়। আমি ওকে নিয়ে খেলা করি। নামটাও দিদাই দিয়েছে। বৃষ্টিতে ওকে পেয়েছে, তাই ওর নাম রাখে ‘বৃষ্টি’। মি. খান বলে, তাই বলো। এবার চলো, তোমার বিড়াল খুঁজতে বেরিয়ে পড়ি। তিনজন মিলে বিড়ালের খোঁজে কিছুক্ষণ এ-গলি সে-গলি হেঁটে জয়া ক্লান্তি বোধ করে, তাই ফিরতে হলো। এভাবে বিড়াল খোঁজার অভিযান চলে বেশ কিছুদিন। মি. খানের অপরাহ্ণের সময়টা বেশ ভালো কাটে, সঙ্গে মি. খানের পোষা কুকুরটারও হাঁটা হয়ে যায়।

হঠাৎ করে একদিন জয়া বেঁকে বসে-দাদু, আমি আর বিড়াল খুঁজতে যাব না। নতুন দাদু মিথ্যা বলেছে, সে আমার বিড়াল খুঁজে না, তোমরা শুধু শুধু হেঁটে বেড়াও আর গল্প করো। প্রবীর মিত্র নাতনিকে বোঝায়-হাঁটতে হাঁটতেই একদিন পেয়ে যাব। জয়ার ওই একগেঁয়েমি-না দাদু, আমি আর তোমাদের সাথে বিড়াল খুঁজতে যাব না, হেঁটে হেঁটে আমার পা ব্যথা হয়ে গেছে। প্রবীর মিত্র আবারও নাতনিকে শুধায়-তাহলে তুমি আর বিড়াল খুঁজতে যাবেই না। জয়ার ওই এক কথা-না দাদু, আমি আর কোনো দিন বিড়াল খুঁজতে যাব না। বিড়াল খোঁজার অভিযান বন্ধ হয়ে যায়।

সপ্তাহ ধরে জয়াকে না দেখে মি. খান দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। সন্ধ্যায় ডগপার্ক থেকে ফেরার পথে জয়ার জন্য একটা পুতুল ও কিছু চকলেট কিনে ওদের বাসায় যায়। দরজায় ডোর বেল বাজতেই প্রবীর মিত্র দরজা খুলে অবাক হয়ে বলেÑআপনি। আসুন আসুন...। মি. খান টমকে বাইরে বসাতে চেয়েছিল। প্রবীর মিত্র বলে, ওকে নিয়েই ভেতরে আসেন। এই বলে বিড়ালের শোয়ার ম্যাটটা এগিয়ে দেয় কুকুরটাকে বসতে। উচ্চস্বরে চৈ চৈ করে জয়াকে ডাকে-জয়ামণি, দেখো কে এসেছে? জয়া ছুটে বেরিয়ে এল, ওর পিছু পিছু দেড় বছরের ছোট ভাইটাও এল। জয়া মি. খানকে ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়-এটা আমাদের নতুন দাদু। ছোট ভাইটা নতুন বলতে পারে না, শুধু আধো আধো করে বার দুই ডাডু, ডাডু বলে ডাকে। মি. খান সোফায় বসতে বসতে বলে, কদিন আপনাদের দেখা না পেয়ে খবর নিতে চলে এলাম। ততক্ষণে ছোট ছেলেটা মি. খানের পাশ ঘেঁষে এসে দাঁড়ায়। মি. খান ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে-এসে ভালোই হলো, ছোট্ট দাদুর সাথে পরিচয় হলো। জয়াকে পুতুল ও চকলেট দিয়ে বলেÑজয়ামণি, তুমি বিড়াল খুঁজতে যাও না কেন? প্রবীর মিত্র জবাব দেয়-জয়ামণির অভিমান হয়েছে। জয়া দাদুর মুখের কথা লুফে নেয়। নতুন দাদু, তুমি বলেছিলে বিড়াল খুঁজে দিবে, তোমরা শুধু শুধু হাঁটো, বিড়াল খুঁজো না, বলেই কান্না শুরু করে। মি. খান মনে মনে ভাবে, ওর জন্য কিছু একটা করতে হবে। জয়াকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে-তোমাকে যেতে হবে না, আমি খুঁজে নিয়ে আসব। পরদিন একটা বিড়াল কিনে জয়ার বাসায় যায়। দরজায় জয়াকে দেখে খুশিতে মি. খান বলে-জয়ামণি, তোমার বিড়াল নিয়ে এসেছি। জয়া আনন্দে হৈচৈ করে মা-দিদাকে ডেকে বলে-নতুন দাদু বিড়াল নিয়ে এসেছে। খুশিতে নতুন দাদুর কাছে এসে বলে-কই, বিড়াল কই? মি. খান গাড়ি থেকে বিড়ালটা নিয়ে এল। বিড়াল দেখে জয়া হতাশ হয়ে বলে-নতুন দাদু, তুমি কার বিড়াল নিয়ে এসেছ। এটা তো বাচ্চা বিড়াল। প্রবীর মিত্র বোঝাতে চায়-জয়ামণি, এত দিন পথে পথে ঘুরে না খেতে পেয়ে শুকিয়ে গেছে। বলেই প্রবীর মিত্র মি. খানের দিকে অসহায়ের মতো তাকায়। মি. খান একটা মনগড়া গল্প ফেঁদে বলে-জয়ামণি, আগে শান্ত হয়ে পুরো গল্পটা শোনো। বলো তো, তোমার বিড়ালটা কীভাবে হারাল? জয়া ছোট্ট জবাব দিল-বিড়ালটা বাইরে পুপু করে মাটি দিয়ে ঢেকে রোজ একাই চলে আসত, সেদিন আর পুপু করে ফিরে আসেনি। মি. খান একটু গম্ভীরভাবে বলে, সেদিন বাইরে বেরোতেই অসুস্থবোধ করে, তাই দৌড়ে একটা বড় দালানের পেছনে চলে যায়। কারণ বিড়ালরা নিরিবিলি জায়গা বেছে নেয় প্রসবের জন্য। সেদিন তোমার বিড়ালটা দালানের আড়ালে গিয়ে দুটো বাচ্চা প্রসব করেছে। জন্মের পর দু-তিন সপ্তাহ চোখে দেখে না, অন্ধ থাকে, তখন বাচ্চাগুলো মায়ের বুকে ঘুমায় আর মায়ের দুধ খায়, বেশি হাঁটাচলা করে না। তাই তোমার বিড়াল বাচ্চার মায়ায় তোমার কাছে ফিরে আসেনি। বিড়াল বাচ্চাদের ঘাড় কামড়ে ধরে বার কয়েক জায়গা বদলায়। চোখ ফোটার জন্য গরম জায়গায় নিয়ে যায়। তোমার বিড়ালের বড় বাচ্চাটা একটু সবল, তাই দুই সপ্তায় ওর চোখ ফুটে দেখতে পায়। ছোটটা দুর্বল, তাই চোখ ফুটতে দেরি হচ্ছে। বিড়াল জায়গা বদলের জন্য ছোট বাচ্চার ঘাড়ে কামড়ে ধরে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে বড়টাকে আনতে যায়। গিয়ে দেখে বড় বাচ্চাটা জায়গায় নেই, ওকে খুঁজতে খুঁজতে বেশ সময় লেগে যায়। এদিকে ছোট বাচ্চা ক্ষিদের জ্বালায় মাকে খুঁজে, চোখেও দেখে না, কোনোভাবে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে মাকে হারিয়ে ফেলে। এমনি করে দুদিন যাওয়ার পর ওর চোখ ফোটে। তখন খাবারের খোঁজে এদিক-ওদিক ঘুরতে থাকে। সেই সময়ই আমরা ওকে দেখে তোমার কাছে নিয়ে এলাম।

জয়া অবাক হয়ে বিড়ালের গল্প শুনছিল, এবার কথা বলে-তুমি কী করে বুঝলে এটা আমার বিড়ালের বাচ্চা? মি. খান চট করে জবাব দেয়Ñআমি তো বুঝিনি। জয়া নাছোড়বান্দা, তবে যে বললে এটা আমার বিড়ালের বাচ্চা? মি. খান হেরে যাওয়ার পাত্র নয়-আমার কুকুর টম বলেছে। জয়ার প্রশ্নের শেষ নেই, টম কী করে বুঝল?

মি. খান হেসে জবাব দেয়-আমার কুকুর ‘টম’ পুলিশে কাজ করে রিটায়ার্ড করেছে। টম চোরের পোশাক শুঁকে চোর ধরত। সেদিন তোমার বিড়ালের ম্যাটে বসে তোমার বিড়ালের গায়ের ঘ্রাণ শুঁকে নিয়েছিল। টম আমাকে এই বাচ্চাটার কাছে নিয়ে গিয়েছে। বাচ্চার গায়ে ওর মায়ের গায়ের ঘ্রাণ আছে। বাচ্চাটার গায়ে ওর মায়ের মতো কালো ছোপও আছে। গল্পটা শোনার পর জয়ার অবোধ মনে ছোট্ট বিড়ালের প্রতি মায়া পড়ে যায়। উঠে গিয়ে আদরে ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিদাকে ডেকে বলে-দিদা, ওকে একটু খাবার দাও, ওর খিদে পেয়েছে। সেই সাথে ওর একটা নামও রেখে দিয়ো।
 

কমেন্ট বক্স