১.
রাত সাড়ে দশটা। জমজম টাওয়ারের বারান্দাগুলোতে নরম হলুদ আলো জ্বলছে। কারও কারও ঘর থেকে টেলিভিশনের শব্দ আসছে, আবার কোথাও শুধু নিস্তব্ধতা। সুমাইয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচের ব্যস্ত রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ১৬ তলার ওপর থেকে শহরটাকে ছোট মনে হয়, যেন একটা অদৃশ্য দেয়ালের ভেতর সবাই বন্দী। সে এখানে থাকে চার বছর ধরে, কিন্তু পাশের ফ্ল্যাটের লোকজনের নাম পর্যন্ত জানে না। কদাচিৎ লিফটে দেখা হলে শুধু মাথা নেড়ে সৌজন্য দেখায়, তার বেশি কিছু নয়।
আজ লিফটে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হলো, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। তিনি একমনে ফোন দেখছিলেন, সুমাইয়া একবার হেসে তাকালেও তিনি খেয়ালই করলেন না। এটা নতুন কিছু নয়, জমজম টাওয়ারের জীবনই এমন। এখানে সবাই একসঙ্গে থেকেও যেন একা। বাড়ির নিচে একটা চায়ের দোকান আছে, যেখানে কখনো কখনো কিছু তরুণ জড়ো হয়। তারা আড্ডা দেয়, হাসে, তর্ক করে। কিন্তু সে আড্ডায় বয়স্ক কেউ নেই, পরিবারের কেউ নেই। বাসার লোকেরা ব্যস্ত অফিস, ব্যবসা, স্কুল অথবা নিছক নিজের একাকিত্বে ডুবে।
হঠাৎ বিকট শব্দে একটা গাড়ি ব্রেক কষল। দূর থেকে কারও চিৎকার শোনা গেল। সুমাইয়া নিচে তাকাল, কিন্তু ঠিক কী ঘটেছে বোঝা গেল না। সে একটু দাঁড়িয়ে রইল। ভাবল, হয়তো কেউ নিচে গিয়ে দেখবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কেউ কিছু দেখার প্রয়োজনই বোধ করল না। এই শহরের মানুষগুলো কি এতটাই উদাসীন?
২.
রাত গভীর হচ্ছে। জমজম টাওয়ারের প্রতিটি ফ্ল্যাটের ভেতর আলাদা আলাদা গল্প। আলাদা শূন্যতা। কেউ নিঃসঙ্গতায় ডুবে আছে। কেউ ব্যস্ততার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। সোহেল সাহেব এই ফ্ল্যাটে আছেন সাত বছর ধরে। বয়স পঞ্চান্ন ছুঁই-ছুঁই। একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। কিন্তু অফিসের বাইরের জীবন যেন শূন্য। স্ত্রী আমেরিকায় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকেন। আর তিনি এখানে একা।
প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে খাবার টেবিলে বসেন একা। ডাইনিং টেবিলের পাশে রাখা পরিবারের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকেন। একসময় স্ত্রীর সঙ্গে রাত জেগে কত গল্প হতো। এখন ফোনের ওপাশ থেকে শুধু ফরমাল কথাবার্তা : ‘কেমন আছ?’, ‘বাচ্চারা ভালো তো?’ সেই দিনগুলো কই গেল?
তানভীর আর রুবিনা নতুন দম্পতি, বিয়ে হয়েছে মাত্র এক বছর। অথচ তাদের মধ্যে যেন শীতল দূরত্ব। তানভীর সকালে বের হয়, ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। রুবিনা সারা দিন একা কাটায়, ইচ্ছে করলেই কোথাও বের হতে পারে না, কারণ ফ্ল্যাটের কারও সঙ্গে তার পরিচয়ই হয়নি।
আজ সন্ধ্যায় পাশের ফ্ল্যাটের দরজায় ধাক্কা দিল একটু গল্প করার জন্য। দরজা খুললেন এক মধ্যবয়সী মহিলা। ফ্ল্যাট নম্বর ১৩০৪। ‘আমি রুবিনা, এই ফ্ল্যাটে নতুন এসেছি। ভাবলাম আপনার সাথে একটু কথা বলি।’ মহিলা কেবল ভদ্রতাসূচক হাসলেন। ‘ওহ, ভালো। আপনি তো নববধূ! ব্যস্ত থাকেন নিশ্চয়?’
‘না তো। সারা দিন একাই থাকি।
আপনার সাথে যদি একটু গল্প করতে পারতাম...!’ মহিলা হালকা অস্বস্তি নিয়ে বললেন, ‘আসলে আমি একটু ব্যস্ত আছি, কখনো সময় হলে ডাকব...’ রুবিনা বুঝতে পারল, এখানে বন্ধুত্ব হওয়ার জায়গা নেই।
রাতে সুমাইয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। পাশের ফ্ল্যাটের জানালায় আলো জ্বলছে। ছায়া পড়ছে পর্দার ওপর। জানালার ওপাশে একজন হয়তো বসে একা চা খাচ্ছে অথবা ফোনের স্ক্রিনে ডুবে আছে। এই টাওয়ারে সবাই থাকে কিন্তু একসঙ্গে থাকে না। একবার মনে হলো, কিছু বদলানো দরকার। এই দেয়ালের ওপাশের মানুষগুলো কি চিরকালই অপরিচিত থেকে যাবে?
৩.
রাতের জমজম টাওয়ার যেন একটা বিশাল নীরব গম্বুজ। যার ভেতরে থাকা মানুষগুলো নিঃসঙ্গতা আর আত্মকেন্দ্রিকতায় বন্দী। কিন্তু আজ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলÑরাত দশটা। লিফটের দরজা খুলতেই তানভীর দেখল, এক বৃদ্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন।
‘বাবা, একটু সাহায্য করবা? শরীরটা ভালো লাগছে না, আমার ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেবে?’
তানভীর এক মুহূর্ত ইতস্তত করল। তারপর বলল, ‘আপনার ফ্ল্যাট কোনটা?’
‘দশম তলায়, ১০০৩ নম্বর ফ্ল্যাট।’
তানভীর ভদ্রলোককে ধরে লিফটে তুলল। লিফট উঠে যেতে লাগল আর বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বললেন, ‘আমি মতিউর রহমান। থাকি একাই। ছেলেমেয়ে বিদেশে। অসুস্থ হলে ডাকাডাকি করারও কেউ থাকে না!’
ফ্ল্যাটে পৌঁছে দরজা খুলতেই বোঝা গেল। এখানে বহুদিন কেউ আসেনি। ধুলো জমে আছে টেবিলে। সোফায়। তানভীর বৃদ্ধকে খাটে বসতে সাহায্য করল।
‘আপনার জন্য ডাক্তার ডাকব?’
‘না বাবা, তেমন কিছু না। একটু দুর্বল লেগেছিল। তুমি এসেছ, এই অনেক।’
তানভীর হালকা অবাক হলো। একটা মানুষ কতটা একা হলে শুধু কারও উপস্থিতিতেই স্বস্তি পায়!
সুমাইয়া নিচের গলিটা দেখছিল। চায়ের দোকানে কিছু তরুণ বসে আছে। হাসাহাসি করছে। অথচ এই টাওয়ারের কেউ নিচে নেমে আড্ডা দেয় না। বাড়ির ভেতরে সবার নিজস্ব ঘেরাটোপ। যার বাইওে কেউ যেতে চায় না। ঠিক তখনই পাশের ফ্ল্যাটের জানালায় আলো জ্বলে উঠল। ফ্ল্যাট নম্বর ১৪০৫। জানালার ওপাশে একজন তরুণ বসে ফোন স্ক্রল করছে। সুমাইয়া মনে মনে হাসল : ‘এই তো, সবাই একই রকম। আমরা জানি না, কিন্তু একাকিত্ব আমাদের সবাইকেই গ্রাস করেছে।’
পরের দিন সকাল। একটা নতুন কাণ্ড ঘটল। লিফটের সামনে একটা নোটিশ ঝুলছে, ‘সবাইকে আমন্ত্রণ : শনিবার বিকেলে ছাদে একত্রিত হবার আয়োজন করা হচ্ছে। নতুন প্রতিবেশীদের সাথে পরিচিত হই। কিছুটা গল্প করি। আয়োজক : মতিউর রহমান।’ সুমাইয়া দাঁড়িয়ে পড়ল। এ ধরনের কিছু আগে কখনো হয়নি।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেউ কি আদৌ যাবে?
৪. সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। জমজম টাওয়ারের ছাদ আজ অন্যদিনের মতো ফাঁকা নয়। এখানে-সেখানে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। কারও হাতে চা। কেউ চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে। সুমাইয়া প্রথমে ভাবছিল যাবে কি যাবে না। এমন আয়োজন আগে কখনো হয়নি। শেষ পর্যন্ত কৌতূহল সামলাতে না পেরে উঠে এল ছাদে। দেখল, মতিউর রহমান এক পাশে চেয়ার নিয়ে বসে আছেন। মুখে অল্প হাসি। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তানভীর। আরও দু-একজন এসেছে, তবে সংখ্যাটা খুব বেশি নয়। সুমাইয়া এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘ভালো উদ্যোগ, চাচা।’
মতিউর রহমান হেসে বললেন, ‘জীবনে অনেক কিছু দেখলাম। কিন্তু শেষ বয়সে বুঝলাম, এই ইট-কাঠের মধ্যে আসলে আমরা সবাই একা। এই একাকিত্বটা যদি একটু ভাঙা যেত!’
এদিকে রুবিনা বারান্দা থেকে দেখছিল। তানভীর ছাদে গেছে। কিন্তু তার যেতে ইচ্ছে করছে না। আসলে কী বলবে গিয়ে? কিন্তু একসময় মনে হলো, এভাবেই তো দিন যাচ্ছেÑচুপচাপ, একা, কিছু না বলে। এই চুপ থাকার কোনো শেষ নেই। একটা শাল গায়ে দিয়ে সে ছাদে উঠে এল। তানভীর তাকে দেখে অবাক হলো, ‘তুমিও এলে?’
রুবিনা ছোট্ট করে হাসল, ‘হুম, ভালোই লাগছে তো!’
আরেক কোনায় সোহেল সাহেব এসে দাঁড়িয়েছেন। প্রথমে ভাবছিলেন, এসব জমায়েত তার জন্য নয়। কিন্তু মতিউর রহমানের আমন্ত্রণে শেষ পর্যন্ত চলে এসেছেন।
‘আপনাকে দেখে ভালো লাগছে, সোহেল সাহেব!’
‘ধন্যবাদ, মতি ভাই। আসলে কিছুদিন ধরেই বুঝতে পারছিলাম, এভাবে একা থাকা যায় না।’
মতিউর রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘ঠিক বলেছ। আমরা সবাই ব্যস্ত ছিলাম নিজেদের জীবন নিয়ে, কখনো ভাবিনি যে পাশের ফ্ল্যাটের লোকটা হয়তো সারা দিন কারও একটা কথা শোনার অপেক্ষায় থাকে।’
ছাদের বাতাসে আজ একধরনের অদ্ভুত উষ্ণতা। অল্প কয়েকজন মানুষ। কিন্তু তারা আজ কথা বলছে। একে অপরের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে নিচ্ছে। সুমাইয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছেলেটাকে খুঁজল। ১৪০৫ নম্বর ফ্ল্যাটের তরুণ। যে সব সময় ফোনে ডুবে থাকত।
সে কি এসেছে?
ঠিক তখনই চোখ পড়ল ছাদের এক কোনায় ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে। আড়াল থেকে তাকিয়ে দেখছে। সুমাইয়া মনে মনে হাসল। একটা ছোট উদ্যোগ, কিন্তু হয়তো কিছুটা বদল আসছে।
৫. সন্ধ্যার আড্ডা শেষ হয়েছে। কিন্তু ছাদ থেকে নামার সময় সবার মনে যেন একটা অদৃশ্য পরিবর্তন শুরু হয়েছে। এই টাওয়ারে এত দিন ধরে তারা শুধু একসঙ্গে থেকেছে, কিন্তু কখনো একসঙ্গে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেনি। পরের দিন সকালে তানভীর অফিসে যাওয়ার সময় দেখল, লিফটে রুবিনাও আছে। আগে হলে দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকলেও কথার প্রয়োজন হতো না। কিন্তু আজ তানভীর নিজেই বলল, ‘কাল কেমন লাগল?’
রুবিনা হাসল, ‘ভালো। এমন হওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই।’
তানভীর মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। সম্পর্কের এই বরফ গলার শুরুটা কি কাল সন্ধ্যাতেই হয়েছিল?
সোহেল সাহেব সকালে অফিসের জন্য বের হচ্ছিলেন। তখনই পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে একজন ভদ্রমহিলা বের হলেন। সোহেল সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন। এটা সেই মহিলা, যার সঙ্গে এত দিন কেবল লিফটে দেখা হতো। কিন্তু পরিচয় হয়নি। ভদ্রমহিলা একটু হেসে বললেন, ‘কাল আপনাকে ছাদে দেখেছিলাম। আমি ফারিহা, ১৪০৬ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকি।’
সোহেল সাহেব মৃদু হেসে বললেন, ‘আমি সোহেল। এখানে আছি সাত বছর। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আসলে বাস করতে শুরু করেছি কাল থেকেই।’
ফারিহা হেসে বললেন, ‘আমিও তা-ই ভাবছি!’
মতিউর রহমান আজ খুব খুশি। তার ছোট্ট উদ্যোগ হয়তো জমজম টাওয়ারের কঠিন দেয়ালগুলোতে ফাটল ধরিয়েছে। সন্ধ্যায় সুমাইয়া যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, তখনই পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে গেল।
সেই ১৪০৫ নম্বর ফ্ল্যাটের ছেলেটি বের হলো, নাম রুদ্র।
সুমাইয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘আমি রুদ্র। আমরা একই বিল্ডিংয়ে থাকি, অথচ কোনো দিন কথা হয়নি। কাল ছাদে গিয়ে বুঝলাম, আসলে আমরা সবাই নিজেদের একা বানিয়ে ফেলেছি।’
সুমাইয়াও হাসল, ‘এখন মনে হচ্ছে, বদল আসতে শুরু করেছে।’
এক সপ্তাহ পর জমজম টাওয়ারের নোটিশ বোর্ডে আরেকটা পোস্টার ঝুলল : ‘প্রতি মাসে একবার ছাদে ছোট একটা আড্ডা হবে। সবার উপস্থিতি কাম্য। Ñআয়োজক : জমজম টাওয়ারবাসী।’ এবার কোনো একক ব্যক্তি নয়, পুরো টাওয়ারের মানুষই এই আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এই টাওয়ার বদলে যাচ্ছে। মানুষগুলো আর আগের মতো বিচ্ছিন্ন থাকছে না। একসঙ্গে থাকলেই কি সত্যিকারের একসঙ্গে থাকা হয়? জমজম টাওয়ারের বাসিন্দারা এবার সেটার উত্তর খুঁজে পেয়েছে।