ফেব্রুয়ারি মাসকে বিশ্বব্যাপী ক্যান্সার প্রিভেনশন বা ক্যান্সার প্রতিরোধ মাস হিসেবে পালন করা হয়। এই মাসের মূল উদ্দেশ্য হলো ক্যান্সার প্রতিরোধ এবং সঠিক সময়ে ক্যান্সার শনাক্তকরণের জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। ক্যান্সার বর্তমান বিশ্বের একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যসমস্যা, যা প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। তবে সঠিক সময়ে স্ক্রিনিং এবং সচেতনতার মাধ্যমে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব।
ক্যান্সার এবং এর প্রভাব
ক্যান্সার হলো এমন একটি রোগ, যেখানে দেহের কোষসমূহ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ক্যান্সারের প্রায় ২০০টিরও বেশি ধরন রয়েছে, যার মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সার, লাং ক্যান্সার, কোলোরেক্টাল ক্যান্সার, সার্ভিক্যাল ক্যান্সার এবং প্রোস্টেট ক্যান্সার উল্লেখযোগ্য।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে প্রায় এক কোটি মানুষ ক্যান্সারে মারা গেছেন। তবে আশার কথা হলো, সঠিক সময়ে স্ক্রিনিং এবং প্রাথমিক শনাক্তকরণের মাধ্যমে ক্যান্সারের প্রভাবকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।
ক্যান্সার প্রতিরোধে স্ক্রিনিং এবং দ্রুত শনাক্তকরণের ভূমিকা
স্ক্রিনিং (Screening) : এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কোনো লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগেই ক্যান্সার শনাক্ত করা যায়। ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের প্রধান লক্ষ্য হলো প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার ধরা, যাতে দ্রুত এবং কার্যকর চিকিৎসার মাধ্যমে রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।
প্রাথমিক শনাক্তকরণ (Early Detection) : যখন কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দেওয়ার আগেই ক্যান্সার ধরা পড়ে, সেটিকে প্রাথমিক শনাক্তকরণ বলে। এটি চিকিৎসার সাফল্যের সম্ভাবনা বাড়ায়।
ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের মূল উদ্দেশ্য
১. ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণ : ক্যান্সার যত তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে, চিকিৎসা তত সহজ হবে।
২. রোগের গতি মনিটরিং : কিছু ক্যান্সার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, স্ক্রিনিং সেই ঝুঁকি নিরূপণ করতে সাহায্য করে।
৩. চিকিৎসার খরচ কমানো : প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা তুলনামূলক কম খরচে এবং কম জটিলতায় করা যায়।
৪. মৃত্যুহার কমানো : সঠিক সময়ে শনাক্তকরণের মাধ্যমে মৃত্যুঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যায়।
বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার স্ক্রিনিং পদ্ধতি
ক্যান্সারের ধরন : ব্রেস্ট ক্যান্সার
স্ক্রিনিং পদ্ধতি : ম্যামোগ্রাফি
প্রস্তাবিত বয়স ও সময়সীমা : ৪০ বছরের উপরে, প্রতি ১-২ বছরে একবার
ক্যান্সারের ধরন : সার্ভিক্যাল ক্যান্সার
স্ক্রিনিং পদ্ধতি : প্যাপ স্মিয়ার এবং এইচপিভি টেস্ট
প্রস্তাবিত বয়স ও সময়সীমা : ২১-৬৫ বছর, প্রতি ৩-৫ বছরে একবার
ক্যান্সারের ধরন : কোলোরেক্টাল ক্যান্সার
স্ক্রিনিং পদ্ধতি : কোলনোস্কোপি, ফিট (FIT)
প্রস্তাবিত বয়স ও সময়সীমা : ৫০ বছরের উপরে, প্রতি ১০ বছরে একবার
ক্যান্সারের ধরন : লাং ক্যান্সার
স্ক্রিনিং পদ্ধতি : লো-ডোজ সিটি স্ক্যান (LDCT)
প্রস্তাবিত বয়স ও সময়সীমা : ভারী ধূমপায়ীদের জন্য, প্রতিবছর
ক্যান্সারের ধরন : প্রোস্টেট ক্যান্সার
স্ক্রিনিং পদ্ধতি : চঝঅ এবং উজঊ পরীক্ষা
প্রস্তাবিত বয়স ও সময়সীমা : ৫০ বছরের উপরে পুরুষদের জন্য
ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের বাস্তব প্রমাণ ও গবেষণা
১. ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং (ম্যামোগ্রাফি)
গবেষণা : আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির (ACS) মতে, নিয়মিত ম্যামোগ্রাফি করার ফলে ব্রেস্ট ক্যান্সারে মৃত্যুহার প্রায় ৪০% পর্যন্ত কমেছে।
উদাহরণ : ৫০-৬৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ম্যামোগ্রাফি স্ক্রিনিং করার ফলে প্রতি ১,০০০ জনে প্রায় ৬-৮ জনের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।
২. সার্ভিক্যাল ক্যান্সার স্ক্রিনিং (প্যাপ স্মিয়ার ও HPV টেস্ট)
গবেষণা : ইউরোপিয়ান ক্যান্সার জার্নালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্যাপ স্মিয়ার স্ক্রিনিং করার ফলে সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের মৃত্যুহার প্রায় ৮০% পর্যন্ত কমানো সম্ভব হয়েছে।
প্রমাণ : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে HPV টেস্টিং চালু করার পর সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের প্রকোপ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
৩. কোলোরেক্টাল ক্যান্সার স্ক্রিনিং (কোলনোস্কোপি)
গবেষণা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, কোলনোস্কোপি স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের মৃত্যুহার প্রায় ৬৮% পর্যন্ত কমানো সম্ভব হয়েছে।
উদাহরণ : কোলনোস্কোপির মাধ্যমে শুধু ক্যান্সার নয়, বরং ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা (পলিপ) অপসারণ করেও রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে।
৪. লাং ক্যান্সার স্ক্রিনিং (LDCT)
গবেষণা : জাতীয় লাং স্ক্রিনিং ট্রায়াল (NLST) অনুযায়ী, লো-ডোজ সিটি স্ক্যানের (LDCT) মাধ্যমে লাং ক্যান্সারের মৃত্যুহার প্রায় ২০% পর্যন্ত কমানো গেছে।
বিশেষ লক্ষ্য : ধূমপায়ী এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য এটি বিশেষভাবে কার্যকর।
স্ক্রিনিংয়ের বহুমুখী উপকারিতা
প্রাথমিক শনাক্তকরণ : ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে চিকিৎসা সহজ ও কম খরচে করা সম্ভব।
চিকিৎসার সাফল্যের হার বৃদ্ধি : প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার ধরা পড়লে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
মৃত্যুঝুঁকি কমানো : স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে ক্যান্সার দ্রুত শনাক্ত হলে চিকিৎসা দ্রুত শুরু করা যায়, যা মৃত্যুঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সাহায্য করে।
জটিলতা হ্রাস : ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার আগেই চিকিৎসা শুরু হলে জটিলতা কম থাকে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
কাদের জন্য স্ক্রিনিং জরুরি?
স্ক্রিনিং মূলত ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন : পরিবারে ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে : বংশগত কারণে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকলে নিয়মিত স্ক্রিনিং করানো উচিত।
ধূমপায়ী এবং তামাক ব্যবহারকারীরা : লাং এবং ওরাল ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকায় এদের নিয়মিত স্ক্রিনিং প্রয়োজন।
দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা : ডায়াবেটিস, স্থূলতা বা উচ্চ রক্তচাপ যাদের রয়েছে, তাদের স্ক্রিনিং করানো উচিত।
৫০ বছরের উপরে সকলের জন্য : বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যান্সারের ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
স্ক্রিনিংয়ের পাশাপাশি যে অভ্যাসগুলো ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় :
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস : তাজা শাকসবজি, ফলমূল এবং আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে।
নিয়মিত ব্যায়াম : প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা, সাইক্লিং বা যোগব্যায়াম করুন।
তামাক ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন : এগুলো ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ।
সুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক বজায় রাখুন : এইচপিভি এবং অন্যান্য সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবেন।
সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে নিজেকে রক্ষা করুন : সানস্ক্রিন ব্যবহার এবং সানগ্লাস পরুন।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা : ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত চেকআপ এবং স্ক্রিনিং করানো জরুরি।
বাংলাদেশে ক্যান্সার পরিস্থিতি
বাংলাদেশে ক্যান্সার একটি ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যসমস্যা। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ১০৬ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত। প্রতিবছর নতুন করে প্রতি লাখে ৫৩ জন এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। দেশে মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশই ক্যান্সারের কারণে ঘটে। গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে, পুরুষদের মধ্যে প্রধান ক্যান্সারের ধরনগুলো হলো শ্বাসনালি, পাকস্থলী, ফুসফুস, মুখ ও খাদ্যনালির ক্যান্সার; নারীদের মধ্যে স্তন, জরায়ুমুখ, মুখ, থাইরয়েড এবং ওভারি ক্যান্সার প্রধান। এ ছাড়া পুরুষ ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ৭৫.৮ শতাংশ ধূমপায়ী এবং ৪০.৫ শতাংশ ধোঁয়াহীন তামাক সেবনকারী; নারীদের মধ্যে ৬০.৬ শতাংশ ধোঁয়াহীন তামাক সেবনকারী। গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৬ শতাংশ রোগীর ক্যান্সারের সঙ্গে তামাক সেবনের সম্পর্ক রয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ক্যান্সার পরিস্থিতি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, ২০২২ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে ২.৪ মিলিয়ন নতুন ক্যান্সার রোগী এবং ১.৫ মিলিয়ন মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে ৫৬ হাজার শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত। এ অঞ্চলে ঠোঁট ও মুখগহ্বর, জরায়ুর ক্যান্সার এবং শিশুদের ক্যান্সার সর্বাধিক ছিল। WHO আরও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে ক্যান্সারের নতুন রোগ এবং মৃত্যুর হার ৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
পরিশেষে
উপরের পরিসংখ্যানগুলো থেকে স্পষ্ট হয়, বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে ক্যান্সার একটি গুরুতর স্বাস্থ্যসমস্যা। তামাক সেবন, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ ক্যান্সারের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হযেছে। সচেতনতা বৃদ্ধি, নিয়মিত স্ক্রিনিং এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অনুসরণ করে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। ক্যান্সার একটি মরণব্যাধি হলেও সঠিক সময়ে সচেতনতা এবং স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে এর প্রভাব থেকে নিজেকে এবং পরিবারকে রক্ষা করা সম্ভব। ফেব্রুয়ারি ক্যান্সার প্রিভেনশন মাস আমাদেরকে ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতন হতে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অনুসরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। আসুন, সবাই মিলে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করি এবং সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ জীবনের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হই।
লেখক : এমপিএইচ, সিএইচইএস, জনস্বাস্থ্যবিদ (নিউইয়র্ক)