১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জন্য এক গভীর ক্রন্দনের মাস। গভীর শোকের মাস। এ শোক আজও বাঙালি জাতির জীবনে বহমান। এই শোক যদিও বলা হয়, বাঙালি জাতির জন্য শক্তিতে পরিণত হয়েছে, তবু ১৫ আগস্ট এলে শোকের মাতম ওঠে জাতীয় জীবনে। বাঙালি জাতির পক্ষে এ শোক কখনো ভুলে থাকা সম্ভব নয় কোনোভাবেই। ১৫ আগস্টের ঘটনা বাঙালি জাতিকে ধারাপাতের হিসাবে ২১ বছর পিছিয়ে দিলেও চেতনাগতভাবে পিছিয়ে দিয়েছে এতটাই যে, আজও আমরা ১৫ আগস্টের সেই অভিঘাত বয়ে বেড়াচ্ছি এবং হয়তো অনাদিকাল বয়ে বেড়াতে হবে। কেননা এ শোক সান্ত্বনাহীন।
১৯৭৫ সালের ওই রাতে যে ঘটনা ঘটে গেছে, তা কেউ কখনো ভাবতে পারেনি। তবু কেন অবিশ্বাস্য এই ঘটনা ঘটে গেল? এ প্রশ্নের উত্তর আজও বাঙালিরা খুঁজে পায়নি। কোনো অঙ্কই এ প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারে না আজও। মুক্তি দিতে পারে না জাতিকে তার জনক হারানোর কষ্ট থেকে উদ্গত বেদনাকেও। দেশ স্বাধীন হয়েছে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মতো। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত দেশ। একদিকে সেই ক্ষতের চিহ্ন। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ পুনর্নির্মাণের আরেক কঠিন লড়াইয়ে নিমজ্জিত বঙ্গবন্ধু। ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা দেশের অবকাঠামো এবং অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে বিরামহীন কর্মে নিয়োজিত। চিন্তার অবসর নেই। পরিশ্রমেরও কোনো শেষ নেই। তখন পর্যন্ত সব দেশের স্বীকৃতি মেলেনি। সব দেশ বাংলাদেশ পুনর্নির্মাণে তখন পর্যন্ত তাঁর পাশে নেই। সে পরিস্থিতিতেও স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। সেটাও আরেকটি রণক্ষেত্র। শত্রু নির্মূল হলেও লেজ নাড়াচ্ছে। সুযোগ খুঁজছে অনুকূল সময়ের। চারদিকে অসন্তোষ। আত্মকলহ। অপপ্রচার। বৈরী বিদেশিরাও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ওত পেতে আছে সবাই।
সেই সুযোগ তারা পেয়ে গেল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ভোর হয় হয়। সুবেহ সাদেক। কেউ ঘুমে অচেতন। কেউবা ফজরের নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। মসজিদ থেকে আহ্বান জানানো হচ্ছে, ‘নামাজের দিকে আসো।’ কিন্তু ঘাতকেরা আল্লাহর আমন্ত্রণে নামাজের পথে না গিয়ে জাতির জনককে খুনের নেশায় মেতে ওঠে। দেশি ও বিদেশি মিলিত চক্রান্তে খুনিরা হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করল।
যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রকৃত মিত্র ছিলেন, তাদের কেউ কেউ এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর লিখলেন, ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো।’ কিন্তু বাঙালিরা আর কত জীবন দেবে। কত রক্ত দেখবে। কত অশ্রু ঝরাবে। বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে রক্ত দিল। প্রিয়জন হারানোর বেদনায়, স্বজনের কান্নায় বাংলার পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল।
এখনো ১৫ আগস্টের দুঃস্বপ্ন সামনে এসে দাঁড়ালে বুকের কষ্টটা চেপে বসে। ১৫ আগস্টকে ভুলে থাকা বাঙালি জাতির পক্ষে কখনোই সম্ভব হবে না। যত দিন বাংলাদেশ এবং বাঙলি থাকবে, তত দিন বাঙালির বুকে ১৫ আগস্টের শোক চেপে থাকবে। বাঙালিকে শোক বয়ে বেড়াতে হবে। তবে ১৫ আগস্টের হত্যা, ষড়যন্ত্রই প্রথম বা শেষ নয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। সেই ষড়যন্ত্র একটা রূপ নেয় ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। এরপর প্রায় ৪৮ বছর কেটে গেল, সেই ষড়যন্ত্র শেষ হলো না। এখনো চলছে। এখন সময় পাল্টেছে, টার্গেট এবং পরিস্থিতিও পাল্টেছে।
আসলে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ পাল্টে যায়। কেননা ১৫ আগস্টের পর স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস পাল্টে যায়। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতাÑসৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানকে মীর জাফর মোশতাকের নির্দেশে জেলখানার মধ্যে বন্দী অবস্থায় হত্যা করে ওই একই ঘাতক দল।
শাসনক্ষমতা চলে যায় সম্পূর্ণভাবে মুক্তিযুদ্ধের শত্রুপক্ষের হাতে। তারাই নানা রঙে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় বসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার আদর্শ, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন সব বিসর্জন দিয়ে প্রাক ’৭১-এর আদর্শে ফিরে যাওয়ার অনুশীলন চালাতে থাকে। ২১ বছর বাংলাদেশ স্বাধীনতার উল্টো স্রোতে চলতে থাকে। ইতিমধ্যে এই সময়ে একটা নতুন প্রজন্ম বেড়ে ওঠে তাদের দেখানো পাকিস্তানি আদর্শের হাওয়ায়। তাদের মন ও মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস।
প্রকৃত ইতিহাসকে নাকি কোনো কিছু দিয়েই ঢেকে রাখা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ফিরে আসতে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা বিদেশের নির্বাসন থেকে ফিরে আসার পর থেকে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ফিরে আসে জয় বাংলা। ফিরে আসে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার কথা বলার পরিবেশ। তবে সেটাও স্বল্পকালের জন্য। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত। এরপর আবার বাংলাদেশের ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়ে যায়।
তবে ২০০৮ সাল থেকে আজ অবধি এক নাগাড়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার ফলে দেশ অকল্পনীয় উন্নয়ন অর্জন করতে পেরেছে। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর খুনি এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে অনেকের ফাঁসি কার্যকর করেছে। দেশ যখন শনৈঃ শনৈঃ উন্নতির পথে এগিয়ে চলেছে, সেই সময় নতুন করে আবার ষড়যন্ত্রের কথা শোনা যাচ্ছে। এই ষড়যন্ত্র কার বা কাদের বিরুদ্ধে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এও শোনা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেই অনেক ষড়যন্ত্রকারী ঘাপটি মেরে রয়েছে। অনুকূল সময় পেলেই ছোবল মারবে।
তাই দেশপ্রেমিক সব শক্তিকে এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সদা সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। স্বাধীনতার শত্রুরা যেন আর কোনো সুযোগ না পায়। বাঙালি জাতি আর যেন কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার না হয়।