বাংলাদেশ এখন জল্পনা-কল্পনা, গুজব, সত্য-মিথ্যায় সরগরম। কত প্রকারের, কত নামের যে ইউটিউব চ্যানেল, তা হিসাবে রাখাও এক কঠিন বিষয়। মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। বর্তমান সময়ে তার অধিকাংশই অন্তর্বর্তী সরকার এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনাকে ঘিরে। ‘হাসিনা দেশে ফিরে আসছেন অচিরেই’, অন্যদিকে ‘সরকার এবং প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশ থেকে বিদায় হচ্ছেন’Ñফটোশপে তৈরি যার যার ইচ্ছামতো ছবিতে সয়লাব ইউটিউব চ্যানেলগুলো। টক শোতেও অনেক আলোচকের কথাকেই অতিরঞ্জন বলে মনে হয়। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে। সুতরাং আর রক্ষা নেই তার। এবার ধরা খাওয়া। পালাবার আর পথ নেই।
অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের গত ১০০ দিনের রোজনামচায় হযবরল অবস্থা। মানুষের আস্থা দিনে দিনে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। ক্রমাগত আয়ু কমছে। তাদের কাজকর্মে মানুষ এবং অনেকের কথায় হাসিনা-বিরোধী আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরাও ভরসা হারিয়ে ফেলছে। সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের অনেকেই ছাত্র সমন্বয়কদের পছন্দের বাইরে। অনেকের কথাতেই উষ্মা প্রকাশিত হচ্ছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তাদের কোনো ভূমিকাই ছিল না। বরং অনেকেই গত সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। উপদেষ্টা নির্বাচনেও অনেকে বৈষম্য খুঁজে পাচ্ছেন।
সরকারের দর্শন, আদর্শ এবং চিন্তার চেতনা নিয়েও মতদ্বৈধতা দেখা দিচ্ছে। কোনো রাজনৈতিক দল চায় উদার গণতান্ত্রিক আদর্শে দেশ পরিচালনা করতে। কোনো কোনো দল চায় রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মনিরপেক্ষতা। কেউবা চায় ইসলামের সঙ্গে কোনো আপস নেই, রাষ্ট্র চলবে শরিয়ামতো। কোরআন-সুন্নাহ হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি। বিভিন্ন টক শোর আলোচকদের মধ্যে দেশের রাজনীতি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত। অনেকের কথার মধ্যে এখনো আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ পেতে দেখা যায়।
উপরন্তু এ রকম পরস্পরবিরোধী মতামত তুলে ধরার অনেক দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়। এখানে একটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট বলা যাবে। বহির্বিশ্বে সর্বাধিক প্রচারিত পাঠকনন্দিত বাংলা সংবাদপত্র নিউইয়র্ক থেকে প্রচারিত ঠিকানার ইউটিউব চ্যানেল ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ এর ‘উচিত কথা’ নামে নতুন একটি অনুষ্ঠানে যে দুজন অতিথি আলোচনা করেন, তাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় কোন আদর্শ ও চেতনা অনুসরণ করা হবে, তা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা ভিন্ন মত ব্যক্ত করেন। ওই আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিম সিরাজ মাহবুব এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা শামসুল হক। মাওলানা হক ‘একটি মুসলিমপ্রধান দেশে কোনোভাবেই ধর্মনিরপেক্ষতা মেনে নিতে রাজি নন।’
অন্যদিকে তাসলিম সিরাজ মাহবুব নিজের মতামত ব্যক্ত করে বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা না থাকলে সমাজের সব ধর্মের ও সব মতের মানুষ নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারে না।’ তাসলিম সিরাজ মাহবুব বলেন, ‘ছোটবেলায় হিন্দুদের সঙ্গে মিশেছি। কোনো দিন কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়নি। যখন স্কুলে পড়ি, তখনো এটা কোনো ইস্যু ছিল না। সংবিধানে বিসমিল্লাহ বা রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের অন্তর্ভুক্তি থেকেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতি কাজ করতে শুরু করে। তবে তিনি দেশের অধিকাংশ মানুষ সহাবস্থানে বিশ্বাস করেন বলে স্বস্তি প্রকাশ করেন।
বিষয়টাতে শুধু যে এই দুজনই এমন ভিন্নমত পোষণ করেন, তা নয়। এমন ভিন্নমত আরও বহুজনের মধ্যেই পাওয়া যাবে। দেশের সংকট সেখানেই। একটি দেশ কখনোই সামনে অগ্রসর হতে পারবে না, সেই দেশে যদি সব সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐকমত্য না থাকে। সেই ঐকমত্যের সুফল সব সম্প্রদায়ের মধ্যে যদি পৌঁছাতে না পারে, তাহলেও দেশের মানুষ কোনো সুফল পাবে না। তবে দুর্ভাগ্য দেশের মানুষের, দেশ যারা শাসন করেন, তাদের কথার গতিবেগ তুফানের মতো হলেও কর্মের গতিবেগ ততটাই মন্থর।