যা ছিল না, তা-ই বুঝি ফিরে এল। অনেক দিন থেকে জনশ্রুতি চালু ছিল, যুক্তরাষ্ট্র তার গণতন্ত্রের মন্ত্রে মুগ্ধ হয়ে সেনা শাসন বা সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নিজেদের অনুগত শাসক বসিয়ে কোনো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দিত তাদের হাতে। অন্তত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের আর ওই ভূমিকায় দেখা যায়নি দীর্ঘদিন থেকে। কিন্তু ওই যে প্রবাদে প্রচলিত : ‘যে বাঘ একবার মানুষের রক্তের স্বাদ পেয়েছে, সে মানুষের রক্ত না পান করে থাকতে পারে না।’ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাও অনেকটা সে রকমই। একটি গানের একটি পঙ্ক্তির সঙ্গেও বিষয়টি তুলনা করা যায়। হেমাঙ্গ বিশ্বাস উপমহাদেশের বিখ্যাত গণসংগীতশিল্পী। তিনি একবার তার গণসংগীতের দল নিয়ে ঢাকা সফরে আসেন। সেটাও প্রায় চার দশক আগে। ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের আমন্ত্রণে আসেন এবং একটি গান গেয়েছিলেন : ‘বিড়াল বলে মাছ খাব না খাসি খাব।’ সম্প্রতি বিদেশি শক্তি, বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকা এবং স্বদেশি কোনো কোনো গোষ্ঠী স্বৈরতন্ত্রের গন্ধ দূর করতে মুখ মুছে কণ্ঠে নতুন সুর ভাঁজছে। তারা বিড়ালের মতো মাছ না খাওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে খাসির পথে হাঁটছে।
সম্প্রতি টকশোর একটি আলোচনায় শোনা গেল, ‘আমেরিকা নাকি মুসলমান কোনো দেশে গণতন্ত্র দেখতে চায় না।’ তার গন্ধ পাওয়া যায় গত সপ্তাহে গত ২ অক্টোবর ঠিকানার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত দুটি খবরে। সূত্রটির শিরোনাম : ‘ইমরান-হাসিনার পর এবার টার্গেট কি মোদি?’ পাকিস্তানে ইমরানের শাসন কেবল নয়, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, অনেক দুর্বলতা নিয়ে সূচনা যখন হয়, তখনই সে দেশের সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিক সূচনাকে গলাটিপে হত্যা করে নিজেদের সেনা শাসন কায়েম করছে। কাউকে হটিয়ে, কাউকে হত্যা করে সেনানায়কেরা সিংহাসনে বসে পড়েছেন। বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারকেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে হটিয়ে দিয়ে অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। আসলে বিশ্বে বুর্জোয়া শাসকদের মূল কথা গণতান্ত্রিক বা স্বৈরতান্ত্রিক শাসক নয়। তাদের চাই নিজেদের পছন্দমতো তাঁবেদার বা নতজানু শাসক। যেখানেই বিশ্ব বুর্জোয়াদের শাসন কায়েম হয়েছে, সেখানকার ইতিহাস ঘাঁটলে সেই সত্যই উঠে আসে।
দ্বিতীয় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকেও যে নামেই ডাকা হোক, সংস্কারের নামে সেনাতুষ্টিকে তারা প্রাধান্য দিয়ে চলেছে। তাই তো বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে সেনাতুষ্টির প্রতি অধিক নজর দেওয়ায় সেনাপ্রধান আগ বাড়িয়ে বলতে পারেন, ‘১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব।’ তাই রাজনৈতিক দলগুলোও আর দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার দাবি তুলছে না। ‘যৌক্তিক সময়’ দিয়ে প্রতীক্ষায় থাকতে চাচ্ছে। অর্থাৎ সেনাপ্রধানের বক্তব্যের বাইরে জোর দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছে না। অবশ্য পাকিস্তান, বাংলাদেশের শাসকেরা নিজেদের দিক থেকেই সেনাশাসনকে তোয়াজ করে চলার চেষ্টায় রত। সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধাও দিয়েছেন বাহিনীর কর্মকর্তা ও জোয়ানদের। তবু শেষ রক্ষা হয় না। রাজনীতিবিদেরা প্রজ্ঞাবান, পড়াশোনা করা পণ্ডিতজন হলেও ক্ষমতায় থাকার লোভে ইতিহাস ভুলে যান। সেনাবাহিনীর তুষ্টি প্রাপ্তির জন্য তারা বাড়ির সদরমহল, অন্দরমহলসহ সব দরজা খুলে দেন। একটিই উদ্দেশ্য, সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ নিয়ে ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ বৃদ্ধি করা।
‘সংলাপে সেনাতুষ্টির উদ্গিরণ’ খবরটিতেও সেই আভাসই মেলে। খবরটির ভেতরে একটু দৃষ্টি ফেলে দেখা যেতে পারে, তাতে মূলত কী বলা হয়েছে। প্রথম খবরটিতে বলা হয়েছে, ইমরান-হাসিনার পর এবার টার্গেট কি মোদি? প্রতিবেদনটির মূলকথা : ‘ভারত আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির মুখোমুখি। মণিপুরের সহিংসতা, রাহুল গান্ধীর যুক্তরাষ্ট্র সফর ও হাসিনা সরকারের পতন। সব মিলিয়ে এক নজিরবিহীন চাপের মোকাবিলা করছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির কলকাঠির পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততাকে দায়ী করেছেন অনেকে। অবশ্য এমন অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পাকিস্তানে ইমরান খানের পদচ্যুত হওয়ার ঘটনার পর বাংলাদেশে পটপরিবর্তনের দুটো ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে মেনে নিতে নারাজ অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকায় মোহিত রায় লিখিত এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে মত প্রকাশ করে বলেছেন, পাকিস্তান, বাংলাদেশের পর যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী টার্গেট এখন ভারত।
আন্তর্জাতিক অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী টার্গেটের অর্থ ভারতের সরকার পরিবর্তন নয়। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ষড়যন্ত্রে ভারতে সরকার ফেলে দেওয়া সহজ হবে বলে তারা মনে করেন না। ভোট বিপ্লবেও মোদি সরকারকে পদচ্যুত করা সম্ভব হবে কি না যথেষ্ট সন্দেহ। ভারত মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য সরাসরি সরকার পরিবর্তন নয়, তাদের লক্ষ্য উত্তর-পূর্ব ভারতের সপ্তকন্যা, যেমন অরুণাচল, আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরার পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলনরত জনতাকে উসকে দিয়ে তাদের আন্দোলনকে সফল করার কাজে কার্যকর ইন্ধন জোগাবে। তাদের যদি মূল ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন করে দিতে পারে, তাতেই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সফল হবে। এর সঙ্গে আরও কিছু রাজ্যকে যদি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে শরিক করা যায়, তাতেই ভারত দুর্বল হয়ে পড়বে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সফল হবে। আপাতত যদি মোদি সরকারকে ফেলে দেওয়া সম্ভব নাও হয়, মোদির একক কর্তৃত্বও যদি খর্ব করা যায়, তা-ও কিছু করতে না পারার চেয়ে ভালো। দ্বিতীয় প্রতিবেদন ‘সংস্কারে সেনাতৃষ্টির উদ্গিরণ’-এ বিশেষ প্রতিনিধির সংবাদে বলা হয়েছে, যৌক্তিক সময়, প্রয়োজনীয় সময়, যথাসময়ের ফেরে আর যাচ্ছে না বিএনপি-জামায়াত। সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দল দুটির। সেনাপ্রধানের ১৮ মাস সময়ের ইদানীং সমূহ সন্দেহ তাদের। তাড়াতাড়ি নির্বাচনের কথা প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেছে বিএনপি। জামায়াতও কদিন ধরে একই পথে। দুই দলের সমীকরণ আলাদা হলেও বিলম্বে নির্বাচনে ঘোরতর আপত্তি দুই দলেরই।’
বাংলাদেশের রাজনীতি, রাষ্ট্র পরিচালনায় বারবার সেনাবাহিনীর দৃষ্টি ঘোরানোর ইতিহাস আছে। রাজনীতিকদের রাষ্ট্র শাসনের ক্ষেত্রে সেনা কর্মকর্তাদের সব সময় কেমন যেন একটা অনীহা লক্ষ করা গেছে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাত ধরে সেনা কর্মকর্তারা স্বাষ্ট্র পরিচালনায় পাদপ্রদীপের আলোয় প্রথম আসেন। জেনারেল জিয়ার পর এরশাদ, ২০০৬ সালে জেনারেল মইন উ আহমেদের আবির্ভাব ঘটে ক্ষমতার মসনদে। এবারও কি সে রকম আভাস মেঘে মেঘে ভেসে বেড়াচ্ছে? কিছু কিছু মানুষের আশঙ্কা সে রকমই। মানুষের এই আশঙ্কার ভিত্তি প্রথমে সেনাবাহিনীকে বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়ে দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে দুই মাসের জন্য। এখন ১৭ সেপ্টেম্বর একই স্মারক ও তারিখ ঠিক রেখে সংশোধিত প্রজ্ঞাপন জারি করে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীকেও একই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। জনগণের বলাবলি থেকে বুঝতে পারা যায়, ‘এই দুই আসলে কত মাস হয়।’ তবে অধিকাংশ মানুষের প্রত্যাশায় সবার সব আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণিত করে সময় যতটা দীর্ঘই হোক, নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতেই অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা দিয়ে যাবে। মনে রাখা দরকার, অন্তর্বর্তী সরকারও কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফসল। তাই তারা যা করবেন, তার মধ্যে ছাত্র-জনতার আকাক্সক্ষা, প্রত্যাশা এবং স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটবে।