Thikana News
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

একজন প্রবাসীর চোখে ‘বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা’

একজন প্রবাসীর চোখে ‘বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা’


(গত সপ্তাহের পর)
ওই মেয়েটির ভিডিও ক্লিপ মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। আমিও সেটি দেখেছি। সাংবাদিক সাহেব যখন প্রশ্ন করল, আন্দোলনে যোগ দেওয়া স্কুলছাত্রীটি বলল, ‘অনেক সুযোগ ছিল পেছনে ফিরে যাওয়ার। এখন আর পেছনে ফেরার রাস্তাই নেই। পেছনে পুলিশ আর সামনে স্বাধীনতা। অবশ্যই আমরা সম্মানের সাথে মৃত্যু গ্রহণ করতে রাজি আছি।’ ক্লিপটি দেখে শিউরে উঠেছিলাম। কতটা সাহসী আর বদ্ধপরিকর হলে অল্পবয়সী একটা মেয়ে তার সম্ভাবনাময় জীবনের হাতছানি ছেড়ে মৃত্যুর দরজায় দাঁড়াতে প্রস্তুত থাকে।
আগস্ট ২০২৪
প্রবাসজীবনে একটা খবর প্রায়ই চোখে পড়ে। কোনো জঙ্গলে বা ফরেস্টে আগুন লেগেছে আর সেই আগুন নেভাতে বা দমন করতে দমকল বাহিনীর দারুণ বেগ পেতে হচ্ছে। এটাকে বলা হয় ওয়াইল্ড ফায়ার। অতিরিক্ত গরমে এবং শুষ্ক আবহাওয়ায় ঘন অরণ্যের মাঝখানে কোনো বজ্রপাত বা বৈদ্যুতিক লাইনের শর্ট সার্কিটের কারণে একটি ছোট অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয়। তারপর সেখান থেকেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছে এবং বনের পর বন উজাড় করে দেয় সেই ওয়াইল্ড ফায়ার, যা দিনের পর দিন চলতে থাকে।
ওয়াইল্ড ফায়ারের দাবানলের মতোই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল রাস্তায়, মহল্লায়, শহরে, মফস্বলে, জেলায়, উপজেলায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যোগ হলো স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে যোগ হলো শিক্ষক-শিক্ষিকা, অভিভাবক, আইনজীবী, ব্যারিস্টার, সমাজকর্মী, শিল্পীসমাজ, চিকিৎসক-সমাজ। নেমে এল রিকশাওয়ালা, দোকানদার, শ্রমিক, খেটে খাওয়া দিনমজুর। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পরিণত হলো ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। ওদের নয় দফা নেমে এল এক দফায়, ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন।
আগস্ট মাসের শুরুতেই অসংখ্য ছাত্র-জনতা শাহাদাত বরণ করল। আহত অবস্থায় বিপুল সংখ্যক আন্দোলনকারী হাসপাতালে ভর্তি হলো, হাত-পা হারিয়ে চিরজীবনের জন্য পঙ্গু হলো, দৃষ্টিশক্তি হারাল। অনেক আন্দোলনকারী জেলহাজত ও কারাগারে অমানবিক অবস্থা ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হলো। প্রতিনিয়ত বিশ্ববাসী বাঙালিরা খবর পাচ্ছিলাম বিভিন্ন জায়গায় ঘটে চলা বিক্ষোভ, সংঘাত, ভাঙচুর, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগের। আরও খবর পাচ্ছিলাম হামলা, গণহত্যা, গণগ্রেপ্তার, রিমান্ড ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের।
গণ-অভ্যুত্থানের ফলাফল কী হবে, এ ব্যাপারে বিশ্ববাসী অধীর উত্তেজনায় অপেক্ষা করছিল। আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের সময়ের ব্যবধানের কারণে দেশে যখন দিন হয়, আমেরিকায় তখন রাত। ৫ আগস্টের কর্মসূচি লং মার্চ টু ঢাকা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার রাতের ঘুম হারাম হলো। রাত জেগে অনবরত নিউজ আপডেট চেক করতে করতে একসময় খবর দেখলাম, দেশের সেনাপ্রধানের ভাষণ এবং স্বৈরাচারীর দেশত্যাগ। অবশেষে ২৩ দিনের দেশকাঁপানো আন্দোলনের শুভ পরিণতি লাভ এবং সারা দেশে ব্যাপক বিজয় উল্লাস, বিজয় মিছিল।
বিজয় উদ্্যাপনের পাশাপাশি আরও কিছু নির্মম বাস্তবতা আমাদের চোখের সামনে এল। এই গণ-অভ্যুত্থানে যারা শহীদ হলো তারা আর কোনো দিন জানতে পারল না আমাদের বিজয় অর্জনের কথা। বাড়িতে চিঠি লিখে আন্দোলনে চলে যাওয়া কিশোর, তরুণ, শিক্ষার্থী আর স্বাধীনতার আনন্দ মিছিলে যোগ দিতে পারল না, তাদের হারিয়ে বাবা-মায়ের বুক খালি করা আর্তনাদ দেশের আকাশে-বাতাসে প্রকম্পিত হলো। আয়নাঘর, ডিবি হাজতে আটকে থাকা মানুষগুলোর মুক্তির পরে তাদের ওপর সংঘটিত বর্বরতা ও অত্যাচারের যেসব বিবরণ গণমাধ্যমে আসতে লাগল, তা দেখে জাতি শিহরিত হলো। বহু পরিবারের হারিয়ে যাওয়া বাবা, ভাই, সন্তানের খোঁজে পাগলপ্রায় সদস্যরা কোনো না কোনোভাবে নিজেদের বুঝ দিল যে তারা আর ঘরে ফেরার নয়। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষার্থী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ট্রমায়, আতঙ্কে রাত কাটাতে, দিন কাটাতে থাকল। চোখের সামনে দেখা তাদের বন্ধু, সহপাঠী বা বড় ভাইয়ের বুলেটবিদ্ধ হয়ে, কুপিয়ে, আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণের দৃশ্য তারা কোনো দিন ভুলতে পারল না।
এত কিছুর পরও ছাত্রসমাজের দায়িত্ব কিন্তু শেষ হলো না। এরপর তারা দেশ সংস্কারের অভিযানে নামল। রাস্তাঘাট পরিষ্কার, ট্রাফিক কন্ট্রোল, লুট করা টাকা-পয়সা ও অস্ত্র পুনরুদ্ধার চলতে থাকল। চলতে থাকল পাড়ায়-মহল্লায় চুরি-ডাকাতি রোধে রাতভর টহল ও প্রতিরক্ষা। চলল মন্দির, গির্জায় সংখ্যালঘুদের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা। বিদেশি শক্তি দ্বারা প্ররোচিত পাল্টা অভ্যুত্থানের কয়েকটি প্রচেষ্টাও তারা শক্ত হাতে নস্যাৎ করল। করল দুর্নীতি দমন পরিকল্পনা ও ঘুষের বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যাপের উদ্ভাবন। এরপর ছাত্ররা এগিয়ে এল বন্যাকবলিত মানুষের সাহাযার্থ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও পুনর্বাসনে। কাজের যেন আর শেষ নেই।
খবরগুলো যতই পড়তাম, ততই বিস্ময়ে অভিভূত হতাম। মনে হতো, ছেলেমেয়েগুলোর বুঝি আর ঘরে ফেরার সময়ই হবে না। এখনো একজনের ডাকে সবাই ছুটে আসে, জনসাধারণের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কী তাদের দেশপ্রেম, দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা। কী দারুণ সুচিন্তা ও আদর্শের ভিত্তিতে একটি সুন্দর বাংলাদেশের ছবি তারা তাদের মানসপটে এঁকে চলেছে। বাংলাদেশের নব্যপ্রাপ্ত দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনে এই ছাত্রসমাজের ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না। এই ছাত্রসমাজের একেকজন যেন স্বর্ণসন্তান। এমন সূর্যসন্তান গর্ভে ধারণ করতে পেরে আমার দেশের মায়েরা ধন্য। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের এই দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের প্রতীক হয়ে জ্বলছে।
বর্তমানে দেশে-বিদেশে বাঙালিরা অনেকেই খুব সন্দিহান বাংলাদেশের একটি সুন্দর ভবিষ্যতের ব্যাপারে। সামাজিক মাধ্যম খুললেই যার অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। অনেক অনেক নেতিবাচক কমেন্ট, উপহাস, পরিহাস, ব্যঙ্গ, অপমানকর জবাব, অবমাননাকর মন্তব্য প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ দিয়েই চলেছে। এটা খুবই দুঃখজনক। এ বিষয়ে আমি কয়েকটি কথা বলতে চাই।
বিগত ১৫ বছর আমরা তো সবাই চুপ ছিলাম। আমাদের মুখ বন্ধ ছিল অথবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি বিদেশে বসে সহজে কিছু বলতে পারলেও দেশে গেলে আমরা একদম বোবা বনে যেতাম। বেড়াতে গিয়ে অকালে প্রাণ হারানোর ভয় আমাদের সবারই ছিল। তা এখন যখন আর সেই ভয় নেই, তখন বাকস্বাধীনতার চর্চা আমরা কি একটু গঠনমূলক উপায়ে করতে পারি না? কেন প্রতিটি বিষয়ের কঠোর সমালোচনা করতে হবে? কেন প্রতিটি বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকে শুরু করে কাউকে না কাউকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে? অনলাইনে বসে কমেন্ট লেখা অনেক সহজ, টকশো বা ইন্টারভিউতে বসে কাউকে নিচু দেখানোও সহজ। কিন্তু প্রকৃত দেশ পরিচালনার দায়িত্ব অনেক কঠিন। সেই যোগ্যতা, মেধা বা দূরদৃষ্টি সবার থাকে না। অনলাইন কমিউনিটির কাছে আমার অনুরোধ, এত বেশি কট্টর সমালোচনা করা থেকে আপাতত বিরত থাকুন।
দ্বিতীয় কথা যেটা বলতে চাই, একটু ধৈর্য ধরুন। সময় গেলে অনেক কিছু বোঝা যায়, উপলব্ধি করা যায়। ঘরের কোণে একটা ময়লার ঝুড়ি যখন আবর্জনায় ভরে উপচে পড়ে, তখন তা দ্রুত অপসারণ করা যায় বা ঝুড়িটা বদলে ফেলা যায়। কিন্তু ঝুড়িটা যেই ঘরে আছে, সেই ঘরসহ পুরো বাড়িটা যখন ভেঙে পড়ে, নোনা ধরে, স্তূপীকৃত পচা আবর্জনার দুর্গন্ধে, পোকামাকড় কীটপতঙ্গের আস্তানায় পরিণত হয়, তখন সেই বাড়িটাকে পরিষ্কার করতে, পরিশোধন করতে অনেক সময় লাগে। তখন সেটা আর ছোট একটি কাজ নয়, বরং একটি বড়সড় কার্যক্রমে পরিণত হয়। বাংলাদেশের সামগ্রিক সংস্কার সাধন ওই কার্যক্রমের চাইতেও বড় এবং জটিল একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এখানে শুধু দেশ নয়, বাঙালিদের মানসিকতারও সংস্কারের প্রয়োজন। আর আমরা বাঙালিরা চাইলে অবশ্যই সেটা করতে পারি।
কথা শেষ করছি জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বক্তব্য দিয়ে। প্রবাসীদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘এই গণ-অভ্যুত্থানে বিদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশিরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। জাতি তাদের অবদান বিশেষভাবে স্মরণ করবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে আমরা তাদের অংশগ্রহণ চাইব।’
আসুন, আমরা প্রবাসী বাঙালিরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই। যে যেই দেশে আছি, যেই অবস্থানেই থাকি না কেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে একবার বিপ্লবী হয়েছি, এবার নাহয় দেশ পুনর্গঠনে উদ্যোগী ও উদ্যমী হই। আবারও প্রমাণ করি বাঙালিরা কতটা একত্রিত জাতিÑদেশের ভেতরে দেশের বাইরে।
লেখক : ব্লগার ও কলামিস্ট, টেক্সাস।

কমেন্ট বক্স