দেশে একটা অভ্যুত্থান ঘটে গেছে। ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একমাত্র বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। আমেরিকা বা ইউরোপের কোনো দেশ গ্রহণ না করলে তাকে ভারতেই থাকতে হবে। নতুন সরকার গঠিত হয়েছে, যার নেতৃত্বে আছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছাত্র আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে দুজনসহ একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়েছে। তারা রাষ্ট্র মেরামত শুরু করে দিয়েছেন। তারা শুরু করেছেন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে রদবদলের মধ্য দিয়ে। প্রতিদিনই মিডিয়ার মাধ্যমে এই পদায়ন, রদবদলের খবর পাওয়া যাচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদের সংখ্যা ১৭ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এখন ২১ ছুঁয়েছে। বাসসের ব্যবস্থা পরিচালনায় পরিবর্তন এরই মধ্যে সাধিত হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটের নামফলক পুরোনো শহীদদের নাম পাল্টে নতুন শহীদদের নামে শোভা পাচ্ছে। সড়কের বদল এখনো শুরু হয়নি, তবে অচিরেই সেটা শুরু হয়ে যাবে বলে শোনা যাচ্ছে। সেই রাষ্ট্র মেরামতের ফল ভোগ করার জন্য নাগরিক সমাজ অপেক্ষা করছে।
রাষ্ট্র মেরামতের আশা-প্রত্যাশা না থাকলেও বাঙালি নাগরিক সমাজের একটা গভীর আকাক্সক্ষা ছিল তারা একটা নাগরিকবান্ধব রাষ্ট্রের মালিক হতে পারবে। তাদের সেই আকাক্সক্ষা অদ্যাবধি পূরণ হয়নি। তৃতীয় দফা গণ-অভ্যুত্থানে সেই স্বপ্ন পূরণ হবে কি না জানা নেই। বাঙালিদের অবস্থা এখন ধন্য আশা কুহকিনী। মানুষ সব সময় আশাবাদ নিয়ে চলে। আশাহীন মানুষের পথচলা অর্থহীন। দেশে কত ঘটনা ঘটে গেল, সবচেয়ে বড় ঘটনা শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছেড়ে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ। কদিন আগেও বুক চিতিয়ে, আঙুল উঁচিয়ে তিনি বলতেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে। আমি কাউকে ভয় পাই না।’ বলতেন আরও অনেক কথা। সেসব কথা বললে অনেকেই অবশ্য বলবেন, বিপদে কাউকে আঘাত করতে নেই। অনেকের ক্ষোভ আছে, রাগ আছে। তাকে অর্থাৎ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নানাভাবে আঘাত করার সুযোগ আছে, বিচারে চরম দণ্ড লাভের সমূহ আশঙ্কা আছে।
আগস্ট মাসটাই বাঙালির জন্য ভীষণ শোকের। বাঙালি, বাংলাদেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি সব দিকেই বিপর্যয়ের মাস। এবারও এই আগস্ট মাসেই ছাত্র-জনতার গণবিস্ফোরণ। সব গণবিস্ফোরণেই ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণ থাকে একটি প্রত্যাশা, একটি স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্ন-প্রত্যাশা সুশাসনের, গণতন্ত্রের, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের, ঘুষ-দুর্নীতির অবসানের, স্বজনপ্রীতির অবসানের, অন্যায়ের কোনো জায়গা থাকবে না, নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে ইত্যাদির। কিন্তু বিগত সময়ে এসবের কিছুই হয়নি; হয়েছে বাঘা বাঘা প্রকল্প আর সাগরচুরি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের চাপে মানুষের জীবনটা হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। আজও সে পরিস্থিতির অবসান ঘটেনি। মানুষ রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে; কিন্তু তাদের জীবনে স্বস্তি ফিরে পায়নি।
এবার কি সেই স্বস্তি দূর হবে, সেই স্বপ্ন পূরণ হবে? তাই নতুন করে রদবদলই যেন শেষ কথা না হয়। আকাশচুম্বী উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের প্রত্যাশাও যেন পূরণ হয়। বাংলাদেশের মানুষ সকালে আকাশের দিকে তাকিয়ে নতুন সূর্য দেখে নতুন আশায় বুক বাঁধবে। পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষাই যেন শেষ রক্ষা না হয়। জীবন অনেকভাবে বাঁচিয়েও চলা যায়। সে বাঁচা মানুষের বাঁচা নয়। যারা দেশ পরিচালনা করবেন, রাষ্ট্র চালাবেন, তাদের মৃত্যু হবে বীরের মৃত্যু। বীর জীবিত বা মৃত নয়, তারা সব সময়ই বীর। মানুষ বীরকেই সম্মান করতে চায়, কাপুরুষকে নয়।
পরাজিত হয়ে কাউকে অভিযুক্ত করাও যুক্তির কোনো কাজ নয়। বীরের কাজও নয়। বীরেরা পিঠে আঘাত নিয়ে বাঁচে না। তারা বুক চিতিয়ে লড়াই করে। একসময় শত্রুর অস্ত্রাঘাতে বীরেরা মৃত্যুবরণ করে নেয়। তবু মাথা নোয়ায় না।