কী দিয়ে শুরু করব, ভেবে পাচ্ছি না। চারদিকে কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর গুমোট গুমোট ভাব। ভাঙনের শব্দ। প্রবাসে এবং দেশেও বাঙালি কমিউনিটিতে অস্থিরতা। বাঙালিদের কেউ ভিতু বলে অপবাদ দিতে পারবে না। লড়াই করে, জীবন দিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে কাটিয়ে দিলাম ২৪ বছর। কত লড়াই-সংগ্রাম, রক্তপাত, জীবনদান। শতভাগ ন্যায্য দাবি আদায় করতে গিয়েও জীবন দিতে হয়েছে বাঙালিদের। পাকিস্তান স্বাধীন হলো বাঙালিদের জীবন, মেধা, প্রজ্ঞা এবং দেশপ্রেমের জোরে, ত্যাগে। এর পর থেকে ১৯৫১ থেকে মুক্তিযুদ্ধ-কোনো আন্দোলন-সংগ্রামেই সফল হয়নি বাঙালি আত্মত্যাগ ছাড়া।
সেই বীর বাঙালিরা কেন চোখের সামনে এত অন্যায়, এত অবিচার হতে দেখেও নীরব, বোবা হয়ে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে! না, রাজনীতির কথা বলা হচ্ছে না। রাজনীতির বাইরে কি জনতার আর কোনো দিকে চোখ ফেরানোর প্রয়োজন নেই। সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক দিকে তো কত কিছুই ঘটে যাচ্ছে। সেসব চোখের সামনে ঘটতে দেখেও কি কিছু বলার নেই! বাংলাদেশের কথা যদি এই মুহূর্তে বলতে হয়, তবে কয়েক দিন আগেই ঘটে গেল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলোয়াড় তামিম ইকবালের ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণের ঘোষণা। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে তার সমাধান ঘটলেও বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যে ছন্দ ফিরে পেয়েছিল, সেই ছন্দের পতন ঘটে গেছে বলে মনে হচ্ছে। কিছুদিন আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গোপন কোড চুরি করে হ্যাকাররা প্রায় ৮০০ কোটি টাকা লোপাট করে ফেলল। সামান্য কিছু টাকা উদ্ধার করা গেলেও বেশির ভাগ টাকাই আর উদ্ধার করা গেল না। এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। কিন্তু কেউ জানতে পারল না, আর কেউ জড়িত ছিল কি না? তাদের পরিচয় কী? তারা বাংলাদেশি, না বিদেশি? তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল, কিন্তু অন্যান্য তদন্ত কমিটির মতোই আলোর মুখ দেখেনি।
এদিকে প্রবাসেও ঘটনার ঘনঘটা। ভাঙন, ভাঙন আর ভাঙন! এক ভেঙে দুই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই ভেঙে চার। সম্প্রতি ভাঙন সম্পন্ন হয়েছে প্রবাসে একসময়ে ঐক্যের প্রতীক এবং মর্যাদাপূর্ণ সংগঠন জালালাবাদ সমিতি অব ইউএসএর। অনেক তিক্ততার মধ্য দিয়ে অনেকের জোড়া লাগানোর আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত এক হতে পারেনি। আর উত্তর আমেরিকায় একসময় সবচেয়ে বড়, সবার আগ্রহের সংগঠন ফোবানা (ফেডারেশন অব বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশন ইন নর্থ আমেরিকা) নিয়ে এখন অনেকে কথাই বলতে চায় না। মানুষ সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এক থেকে এখন চার। আগামীতে আর কত টুকরা হয়, সেটাই দেখার বিষয়।
তবে সম্প্রতি বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষের তথ্য ফাঁস হওয়ার যে ঘটনা ঘটে গেল, তা নিয়ে নতুন করে শুরু হয়েছে তোলপাড়। লাখ লাখ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু অতীতের মতোই মানুষের কোনো আস্থা দেখা যাচ্ছে না। উপরে উল্লেখিত ঘটনাগুলোর মধ্যেই বাংলাদেশ সোসাইটি নিউইয়র্কে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা যাচ্ছে। গত ২ জুলাই কার্যকরী কমিটির সভায় যে ঘটনা ঘটে গেল, তা থেকেই সাধারণ সদস্যদের মনে আশঙ্কা, সোসাইটিতেও তেমন ঘটনা ঘটে কি না। সেই মিটিংয়ে যা ঘটেছে, তা থেকে ভালো কিছু ভাবা যায় না, দুশ্চিন্তা এবং আশঙ্কা করা ছাড়া। ঘটনাটিকে বলা হয়েছে ‘বস্তি স্টাইল’র হট্টগোল। খিস্তিখেউড়, পুলিশ ডাকাডাকি, চেয়ার ছোড়াছুড়ি-সব হয়েছে।
সাধারণ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত সোসাইটির কর্মকর্তাদের যা খুশি তা-ই করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি। সদস্যদের যারা নেতা, তাদের এমন আচরণ কেউ আশাও করে না। বাংলাদেশিদের আমব্রেলা সংগঠন সোসাইটির নেতা মানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সবারই নেতা। সোসাইটি সেই বাংলাদেশিদের কল্যাণে নিয়োজিত না করে নেতৃত্বের জন্য বস্তি স্টাইলে খিস্তিখেউড়ে মাতবেনÑএটা মোটেও প্রত্যাশিত নয়। এবং এর পরিণতিতে যদি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে যায়, তবে তা হবে চরম দুঃখজনক। সোসাইটির সদস্যদের যেন শুভবুদ্ধির উদয় হয়, এটাই আমাদের প্রার্থনা।
এই সঙ্গে আরও একটি কথা বলেই এ সম্পাদকীয় শেষ হবে। ইদানীং এ রকম অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার রিপোর্ট করতে গিয়ে কোনো কোনো সাংবাদিক কারও কারও ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হন, এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। সাংবাদিকদের দায়িত্ব সবার সামনে সত্যটা তুলে ধরা। কেউ খিস্তিখেউড় করবেন, অন্যায় কিংবা অপ্রত্যাশিত আচরণ করবেন, আর কমিউনিটির সবার সামনে সেই সত্যটা তুলে ধরলে সাংবাদিকেরা আক্রোশের শিকার হবেনÑএই সভ্য সমাজে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো রিপোর্ট অসংগত বা অসত্য মনে হলে পত্রিকা কর্তৃপক্ষের বরাবর প্রতিবাদ জানাতে পারেন বা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। আমরা সাংবাদিক হলেও এই কমিউনিটিরই সদস্য। সবার কাছ থেকে এ সৌজন্যটুকু সাংবাদিকেরা আশা করতেই পারেন।