অবশেষে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনের দৌড় থেকে সরে দাঁড়াতে হলো এরিক অ্যাডামসকে। পাঁচ বছরের মেয়াদে তিনি শহরের উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও নিরাপত্তা খাতে অনেক সাফল্য অর্জন করলেও শেষ পর্যন্ত দুর্নীতি ও প্রশাসনিক বিতর্কের ভারে রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকতে পারেননি।
এরিক অ্যাডামস ছিলেন এমন এক মেয়র, যিনি একদিকে কাজের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন, অন্যদিকে নানা বিতর্কে জড়িয়ে সমালোচিতও হয়েছেন। তার সময়েই বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে মেয়র অফিসের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। তিনি কুইন্স, ব্রুকলিন ও ব্রঙ্কসের বিভিন্ন বাংলাদেশি আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশ নেন, কমিউনিটির সাফল্যকে শহরের ‘গর্বের অংশ’ বলে বর্ণনা করেন।
মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি শহরের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর কাজ শুরু করেন। তার মেয়াদকালে নিউইয়র্কে প্রায় ৩ লাখ নতুন চাকরি সৃষ্টি হয়, যা শহরের ইতিহাসে রেকর্ড। সংখ্যালঘু ও নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক সুযোগও বেড়ে যায়। ২০২৬ সালের ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনাল নিউইয়র্কে আয়োজনের অধিকারও তার সময়েই নিশ্চিত হয়। জননিরাপত্তা বাড়াতে অ্যাডামস প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নেয়। অবৈধ অস্ত্র ও যানবাহন দমনে অভিযান চালিয়ে পাঁচ বছরে প্রায় ২০ হাজার অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। বন্দুক সহিংসতা কমাতে ৪৮৫ মিলিয়ন ডলারের কর্মসূচি চালু হয়, যার আওতায় তরুণদের প্রশিক্ষণ ও চাকরির সুযোগ দেওয়া হয়।
আবাসন খাতেও তার প্রশাসন নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রকল্প উইলেটস পয়েন্ট ট্রান্সফরমেশন-এর কাজ শুরু হয়, যেখানে ২ হাজার ৫০০টিরও বেশি সাশ্রয়ী বাসা তৈরি হবে। তার প্রস্তাবিত ‘সিটি অব ইয়েস’ পরিকল্পনা আরও ৮০ হাজার নতুন বাড়ি তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করে।
তবে সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে বিতর্কও ছিল। অভিবাসন সংকট সামলাতে ব্যর্থতার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ২০২৩ সালে তিনি এক বক্তব্যে বলেন, ‘এই সংকট নিউইয়র্ক সিটিকে ধ্বংস করে দেবে’, যা ব্যাপক সমালোচনা তৈরি করে। পরে অভিবাসন সেবা দেওয়ার জন্য ৪৩২ মিলিয়ন ডলারের এক চুক্তি ঘিরে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে।
সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসে ২০২৪ সালে, যখন তার বিরুদ্ধে ফেডারেল দুর্নীতির মামলা হয়। অভিযোগ ছিল, তুরস্কের নাগরিকদের কাছ থেকে তিনি ঘুষ ও অবৈধ অনুদান নিয়েছিলেন। পরের বছর মামলাটি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিচার বিভাগের অনুরোধে রহস্যজনকভাবে প্রত্যাহার করা হয়। আদালত মন্তব্য করেন, ‘এই ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক সমঝোতার গন্ধ আছে।’ এতে তার ভাবমূর্তি আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
এসব বিতর্কের পর প্রশাসনে একের পর এক পদত্যাগ শুরু হয়। তার উপদেষ্টা, উপ-মেয়র, এমনকি পুলিশ কমিশনার ও শিক্ষা চ্যান্সেলরও দায়িত্ব ছাড়েন। শহরজুড়ে প্রশ্ন ওঠে, ‘আসলে নিউইয়র্ক কে চালাচ্ছে?’
অ্যাডামসের জনপ্রিয়তাও দ্রুত কমতে থাকে। ২০২৫ সালের শুরুতে এক জরিপে দেখা যায়, তার অনুমোদন রেটিং মাত্র ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। সমর্থকেরা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর অবশেষে সেপ্টেম্বর মাসে তিনি মেয়র নির্বাচনের দৌড় থেকে সরে দাঁড়ান। নিজের ভাষায় বলেন, ‘মামলা খারিজ হলেও জনগণের আস্থা ফিরে পাইনি।’
এরিক অ্যাডামসের মেয়াদকাল নিউইয়র্ক সিটির ইতিহাসে এক মিশ্র অধ্যায়, যেখানে সাফল্য, বিতর্ক, অর্জন আর পতন সব একসঙ্গে জড়ানো।
বাংলাদেশি কমিউনিটির কাছে তিনি আজও এক পরিচিত মুখ, যিনি বারবার বলেছেন, ‘তোমরাই নিউইয়র্কের শক্তি।’
তবে তার বিদায়ের পর শহরের রাজনীতিতে শুরু হয়েছে নতুন এক অধ্যায়, আর অ্যাডামসের নাম এখন থেকে থাকবে নিউইয়র্কের ইতিহাসের এক রঙিন কিন্তু জটিল চরিত্র হিসেবে।





