Thikana News
০২ নভেম্বর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা রবিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৫





 

আমি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে নিউইয়র্কবাসীর প্রতিনিধিত্ব করব

আমি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে নিউইয়র্কবাসীর প্রতিনিধিত্ব করব





 
আমি নিউইয়র্কের মেয়র পদপ্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই এক মুসলিম চাচা সৎ উদ্দেশ্যে আমাকে একপাশে টেনে নিলেন। তিনি মৃদু হেসে আমার দিকে আন্তরিকতার সঙ্গে তাকালেন। শান্ত স্বরে বললেন, আমাকে এখন কাউকে বলতে হবে নাÑ আমি মুসলিম। তাঁর চোখ দুটো সদয়, দাড়ি আছে; আর চেহারা রাশভারী, যেখানে তাৎর্যপূর্ণ অকথিত কিছু রয়েছে বলে মনে হয়। তাঁকে বারবার যে কঠিন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, আমার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি।  

আজ এই বার্তা দিতে চাই- একমাত্র আমাদের শহরে নিরাপত্তা পাওয়া যায়। কেবল সেই ছায়াতেই মুসলমানরা তাদের পূর্ণ পরিচয় গ্রহণ করতে পারে। আর যদি আমাদের সেই ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে হয়, তাহলে সেই ছায়াতে আমাদের বিশ্বাসও রেখে আসতে হবে। অনেক মুসলিম নিউইয়র্কবাসীকে এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে জীবনযাপন করতে হয়েছে। 
গত কয়েকদিন ধরে এসব অভিজ্ঞতায় অ্যান্ড্রু কৌমো, কার্টিস লিওয়া ও এরিক অ্যাডামস শেষ পেরেক মেরে দিয়েছেন। গত ২৬ অক্টোবর একজন রেডিও হোস্ট যখন বলেছিলেন, আমি আরেকটা ৯/১১ উদযাপন করতে চাই; এ কথা শুনে অ্যান্ড্রু কৌমো তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে তাঁর সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেন। গত ২৬ অক্টোবর এরক অ্যাডামস বলেছিলেন, আমরা আমাদের শহরকে ইউরোপ হতে দিতে পারি না। তিনি আমাকে হিংস্র চরমপন্থিদের সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং বারবার এই মিথ্যা বলেছিলেন, আমাদের আন্দোলন গির্জা পুড়িয়ে দিতে এবং সম্প্রদায়গুলোকে ধ্বংস করতে চায়। এর আগের দিন কার্টিস লিওয়া এক বিতর্ক মঞ্চ থেকে আমার ব্যাপারে অপবাদ দিয়েছিলেন। তখন তিনি দাবি করেছিলেন, আমি বিশ্বব্যাপী জিহাদকে সমর্থন করি। 

প্রতিদিন সুপারপ্যাক বা রাজনৈতিক কর্মসূচি-সংক্রান্ত কমিটিগুলো ইঙ্গিত দেয়, আমি একজন সন্ত্রাসী অথবা আমার খাবার নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করে। বিশেষ উদ্দেশ্যে পরিচালিত জরিপের মধ্য দিয়ে নিউইয়র্কবাসীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, তারা কি হালাল খাবার বাধ্যতামূলক করার জন্য উদ্ভাবিত প্রস্তাবগুলোকে সমর্থন করে, নাকি তাদের অবস্থান আমার প্রার্থিতার রাজনৈতিক কার্টুনের পক্ষে- যা বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের দিকে বিমানের আঘাতকে তুলে ধরে। আমি এই মুহূর্ত আর তাদের ব্যাপারে কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাই না।

এখন নিউইয়র্ক শহরের মুসলিমদের ব্যাপারে কিছু বলতে চাই। আমি এই মুহূর্তে আমার খালার স্মৃতির কথা বলতে চাই, যিনি সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখের পর পাতাল রেলে যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি হিজাব পরে নিরাপদ বোধ করতেন না। আমি আমাদের শহরের জন্য কাজ করা মুসলিমদের ব্যাপারে কথা বলতে চাই। আমাদের স্কুলে যারা শিক্ষকতার ভূমিকা রাখছেন, কিংবা নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগে কাজ করছেন, কিংবা নিউইয়র্কবাসী, যারা তাদের বাড়ি বলে পরিচিত এই শহরের জন্য প্রতিদিন ত্যাগ স্বীকার করেই চলেছেন, যেখানে তাদের নেতারাই তাদের মুখে থু থু ফেলে।

আমি এখানে বেড়ে ওঠা প্রত্যেক শিশুর সঙ্গে কথা বলতে চাই, যাদেরকে অন্যদের মতোই আলাদা করে চিহ্নিত করে উপেক্ষা করা হচ্ছে। যারা মনে করে, তাদের মনে এমন একটি দাগ রয়েছে, যা কখনও পরিষ্কার করা যাবে না।
৯/১১-এর ছায়ায় বেড়ে ওঠা এই শহরে সন্দেহের এক গভীর স্রোত নিয়ে বেঁচে থাকার অর্থ কী, তা আমি জানি। আমি যে অবজ্ঞার মুখোমুখি হয়েছিলাম; কিভাবে আমার নাম তাৎক্ষণিক মুহাম্মদ হয়ে যেতে পারে এবং কিভাবে আমার শহরে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি, তা সর্বদা মনে রাখব। বিমানবন্দরে একটি আয়নাযুক্ত ঘরে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমার শহরে আক্রমণ করার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না? আর আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন এটাও দেখেছি, আমাকে এসবের জঘন্য জিনিসের মুখোমুখি হতে হয়নি। সহপাঠীর মতো আমাকে কখনও গুপ্তচর হতে কিংবা তথ্য সরবরাহ করার জন্য চাপ দেওয়া হয়নি। আমার গ্যারেজে কখনও ‘সন্ত্রাসবাদী’ শব্দটির গন্ধ লাগানো হয়নি, যদিও আমার একজন কাজের লোককে এ কঠিন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

আমার মসজিদে কখনও আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেনি। নিউইয়র্কে মুসলিম হওয়া মানে অসম্মানের আশা করা। কিন্তু এই অসম্মান কেবল আমাদের আলাদা করে না। কারণ অনেক নিউইয়র্কবাসী আছেন যারা এ ধরনের অভিজ্ঞতার শিকার হন। অসম্মানের মুখে সহনশীলতাই একমাত্র পথ। 
এক বছর আগে আমি মেয়র পদে আমার প্রার্থিতা ঘোষণা করেছিলাম, যা গত ২৬ অক্টোবর পূর্ণ হয়েছে। আমি শুধু মুসলিম ভোটারের জন্য প্রার্থী হইনি, বরং প্রত্যেক নিউইয়র্কবাসীর জন্য লড়ার উদ্দেশ্যে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই প্রতিযোগিতায় প্রতিটি মুহূর্তে আমার সঙ্গে জাতিগত এই অপমান বয়ে বেড়াচ্ছি; আমাদের শহরের ইতিহাসে প্রথম প্রধান মুসলিম প্রার্থী হিসেবে এসব করে যাচ্ছি।

আমি ভেবেছিলাম, সবার জন্য একটি প্রচারণা গড়ে তুলতে পারব। নিজেকে এমন এক নেতা হিসেবে দেখাতে পারব, যা হতে চাই। এমন নেতৃত্ব দিতে চাই, যে প্রত্যেক নিউইয়র্কবাসীর প্রতিনিধিত্ব করবে। তাদের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কিংবা তারা যেখানেই জন্মগ্রহণ করুক, আমি তাদের প্রতিনিধিত্ব করব। ভেবেছিলাম, যদি যথেষ্ট পরিশ্রম করি, তাহলে তা আমাকে সেই নেতা হতে সাহায্য করবে। আর এ-ও ভেবেছিলাম, যদি আমি বর্ণবাদী ও ভিত্তিহীন আক্রমণের মুখে আমার জিহ্বা কামড়ে ধরি, ভালো আচরণ করি তাহলে তার সব কিছুর সঙ্গে আমরাও ভালো বার্তা পাবো, যা আমাকে আমার বিশ্বাসের চেয়েও বেশি কিছু হতে সাহায্য করবে। কিন্তু এ আমার ভুল ছিল। 

বারবার পরিকল্পনা যতই পরিমার্জনা করি না কেন, তা যথেষ্ট নয় বলে মনে হচ্ছিল। প্রচারণাকালে আমি জ্যাকসন হাইটসের সরল শিশু অথবা পার্কচেস্টারের প্রথম ভোটারকে বলেছি, আমার মতো তাদেরও একই ছায়ার তলে থাকা উচিত। অনেক দিক দিয়ে আমি সেই একই চাচা হয়ে উঠেছি, যিনি ছয় বছর আগে আমাকে একপাশে সরিয়ে রেখেছিলেন। আর তা হবে না। প্রতিটি মুসলিমের স্বপ্ন হলো নিউইয়র্কের অন্য যেকোনো বাসিন্দার মতো তিনি একই আচরণ পাবেন। কিন্তু অনেক দিন ধরেই আমাদের বলা হচ্ছে, আমরা যা পাচ্ছি তার চেয়ে কম চাইতে এবং যা কিছু পাই তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে।

আর তা মেনে নেওয়া হবে না। আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জানি, যে কেউ যা-ই বলুক না কেন, এই শহরে এখনও মেনে নেওয়া হচ্ছে, এমন ঘৃণা রয়েছে। ইসলামবিদ্বেষ অমার্জনীয় হিসেবে দেখা হয় না। আমাদের মসজিদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দেওয়া হতে পারে এবং জেনে রাখা উচিত- এ নিয়ে কোনো নিন্দা জানানো হবে না। এই শহরের নির্বাচিত কর্মকর্তারা জবাবদিহির ভয় ছাড়াই আমাকে নির্বাসনে দেওয়ার ডাক দিয়ে টি-শার্ট বিলি করতে পারেন।

এই নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে আমাদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি রয়েছে। এই শহরে ১০ লক্ষাধিক মুসলিমকে এমনভাবে বসবাস করতে হচ্ছে যেন আমরা নিজ বাড়িতেই অতিথি। আর তা মেনে নেওয়া যাবে না। আমরা নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। কিন্তু আজ এখানে এ ব্যাপারে নিয়ে কথা বলার সময় নয়। আমরা জানি, দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে একজন নির্লজ্জ গভর্নর এবং আমাদের বর্তমান অভিযুক্ত মেয়রকে বিদায় জানাব।

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, আমরা কি এ দুই ব্যক্তির চেয়েও বড় কিছুকে বিদায় জানাতে ইচ্ছুক? মুসলিমবিরোধী মনোভাবকে বিদায় জানাতে ইচ্ছুক? আমাদের শহরে এটি এতটাই সাধারণ হয়ে উঠেছে, যখন আমরা এটি শুনি, তখন জানি না যে, কথাগুলো কোনো রিপাবলিকান নাকি ডেমোক্র্যাট দ্বারা বলা হয়েছিল।

শুধু জানি, এটি এই শহরের রাজনীতির ভাষায় বলা হয়েছিল।
দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ইসলামবিদ্বেষ কয়েকটি চুক্তির মধ্যে একটি হিসেবে আবির্ভূত। আরবি ভাষায় কথা বলা, ইসলামী নাম থাকা, মুসলিম নারীদের হিজাব পরা ইত্যাদি যেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারের অজুহাত সৃষ্টির সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে। সরকার ও তাদের প্রভাবাধীন গণমাধ্যমসৃষ্ট ইসলামবিরোধী এই অপপ্রচারের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে গেছে। ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনা ওই বিদ্বেষ প্রচারকারী গোষ্ঠীকে অজুহাত সৃষ্টির চমৎকার একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। সেই সুযোগটি হলো সন্ত্রাসবাদবিরোধী সংগ্রামের স্লোগান তুলে আমেরিকার ভেতর এবং বাইরে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি করা। এখানকার চলচ্চিত্র নির্মাতারা এবং মার্কিন মিডিয়া ওই বৈষম্যমূলক নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। এই দুটি মাধ্যম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এবং বহির্বিশ্বে এ কথা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে আসছে- ইসলাম হলো সহিংসতাকামী এবং সন্ত্রাস লালনকারী একটি ধর্ম। 
পশ্চিমারা অবশ্য নিজেদের স্বাধীনতাকামী বলে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে, যেমন তারা ইসলামবিরোধী প্রচারণা চালানোকে গণমাধ্যম এবং মানুষের বাকস্বাধীনতা বলে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। মুসলমানরা যখন ইসলাম অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখাতে যায়, তখন তাকে বাকস্বাধীনতার পরিপন্থি বলে ঘোষণা দেয়। এক সময়কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি উদারনৈতিক বলে পরিচিত ছিলেন; এক বক্তৃতায় ধর্মের অবমাননা বন্ধে মুসলিম দেশগুলো যে চেষ্টা চালায়, তাকে বাকস্বাধীনতার পরিপন্থি বলেছিলেন। 
এ পরিস্থিতিতে গত কয়েকদিন ধরে যারা আমার সুরক্ষা দিতে ছুটে এসেছেন, তাদের সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমি এই শহরের সেই সব মুসলিমের কথাই ভাবি, যারা ডেমোক্র্যাটিক পার্টি মনোনীত প্রার্থী হয়ে সুবিধা পেতে চান না; যারা সংহতি জানিয়ে যোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ার চিন্তা করে না। 

যদিও এই প্রতিযোগিতায় আমার বিরোধীরা ঘৃণাকে সামনে এনেছে, এটি কেবল এই শহরজুড়ে প্রতিদিন কত মানুষকে কী কী সহ্য করতে হয় তার একটি আভাসমাত্র। আর যদিও আমাদের পক্ষে এটা বলা সহজ হবে, শহর হিসেবে আমরা আসলে এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হই না। কিন্তু আমরা সত্যটা জানি, নিজেদের আমরাই এমন পরিস্থিতির শিকার হতে দিয়েছি। আর আমাদের প্রত্যেকের সামনে রয়েছে একটি প্রশ্ন, আমরা কি নিউইয়র্কবাসী হওয়ার অর্থের একটি সংকীর্ণ সংজ্ঞা মেনে নেবো, যা প্রতিদিন মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনকারী ব্যক্তিদের সংখ্যা কমিয়ে দেয়? আমরা কি ছায়ায় থাকব, নাকি একসঙ্গে আলোতে পা রাখব?

নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে বাকি আছে আর মাত্র ১২ দিন। আমি সেই ১২ দিন এবং তার পরের প্রতিটা দিন নিউইয়র্ক শহরে একজন মুসলিম পুরুষ হিসেবে থাকব। আমি কে, আমি কিভাবে খাই, অথবা যে বিশ্বাসকে আমি গর্বের সঙ্গে নিজের বলে দাবি করি, তা আমি পরিবর্তন করব না। তবে একটা জিনিস আমি পরিবর্তন করব- আমি আর ছায়ায় নিজেকে খুঁজব না। নিজেকে আলোতে খুঁজে নেবো।
(এবিসি নিউজ থেকে ভাষান্তর)
লেখক : ডেমোক্র্যাট দল মনোনীত নিউইয়র্ক সিটি মেয়র প্রার্থী।
 
কমেন্ট বক্স