বাথ ইংল্যান্ডের সমারসেট কাউন্টির বৃহত্তম শহর, যা রোমান নির্মিত বাথের জন্য পরিচিত। বাথ অ্যাভন নদীর উপত্যকায়, লন্ডনের ৯৭ মাইল পশ্চিমে এবং ব্রিস্টলের ১১ মাইল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো শহরটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে ঘোষণা করে।
বাথের আয়তন ১১ বর্গমাইল। চুনাপাথরের পাহাড়ের একটি সারি বহিরাগত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে অঞ্চল হিসাবে আখ্যায়িত। শহরটির জনসংখ্যা ১,৭৬,০০০ জন। জেলাটি মূলত খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকায়, যেখানে তারা মোট জনসংখ্যার ৬৬.৫%। বাথের বাসিন্দারা বাথোনীয় নামে পরিচিত।
ছোট্ট একটি শহর। সবারই কৌতূহল এত ট্যুরিস্ট হয় কি জন্য? আসলে গ্রেট বৃটেনের খুবই সুন্দর একটি শহর এবং অপরাধ নেই বললেই চলে। রাতে ট্যুরিস্টরা নির্ভয়ে ঘুরতে পারে।
সমারসেট অপরাধমুক্ত একটি শহর। ট্যুরিস্টদের এত আনাগোনা দেখে মনে হতে পারেÑ হয়তোবা এখানে বসবাস সহজ ও সস্তা। আসলে এখানকার জীবনযাপন তেমন সস্তা নয়। লন্ডন থেকে মাত্র ৮% কম খরচ। তবুও শহরটির সৌন্দর্য্য,ে রোমান বাথ ও মিউজিয়াম, সর্বোপরি অপরাধমুক্ত শহর হওয়াতে বাথ একটি ট্যুরিস্ট অধ্যুষিত শহর।
এই শহরের মধ্যদিয়ে অতিবাহিত অ্যাভন নদী। অ্যাভন নদী পেরিয়ে একটু এগোতেই ক্যাথিভ্রিলের চূঁড়া দেখা গেলো। সেই চূঁড়া বরাবর শহরের একেবারে কেন্দ্রে এই রোমান বাথ অবস্থিত। বস্তুত রোমান বাথকে কেন্দ্র করে এই শহর গড়ে উঠেছে। বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের আনাগোনায় সারা বছরই ব্যস্ত থাকে বাথ।
বাথ শহরের নামকরণের পেছনে রয়েছে রোমানদের তৈরি বাথের কারণে। ইংল্যান্ডের সবচেয়ে ট্যুরিস্ট অধ্যুষিত শহর হলো এই ঐতিহাসিক বাথ। পর্যটকরা রোমান বাথ ট্যুর করতে পারবে তবে, পানিতে নামতে পারবে না। এটি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট, সংরক্ষিত প্রাক-ঐতিহাসিক ধর্মীয় স্পা।
রোমান বাথ : রোমানদের প্রযুক্তিবিদ্যার পারদর্শিতা এই স্নানাগারের প্রতিটি কোণে স্পষ্ট। উষ্ণ প্রস্রবণের চারদিক দস্তাপাত দিয়ে ঘিরে সেই জল সুচারুভাবে ছোট ছোট নালা দিয়ে স্নানাগারের বিভিন্ন ঘরে পাঠানো হতো তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ভৌগলিকভাবে এটি একটি জিওথার্মাল প্রস্রবণ। রোমানদের সামাজিক জীবনে এই স্নানাগারের একটা বড় ভূমিকা ছিল। কারণ সেই সময়ে স্নান করা ছিল রীতিমতো বিলাসিতা। এই বাথটিতে একটি ঘর ছিল স্টিম নেয়ার জন্য, এখনকার সাওনা বাথের আদলে, যেখানে দাস-দাসী থাকতো গায়ে সুগন্ধি তেল মাখিয়ে দেয়ার জন্য।
এই গ্রেট বাথটিতে গরম জল আসতো সরাসরি প্রস্রবণ থেকে। হাজার বছর আগে গ্রেট বাথটি ছিল মূলত শহরের সামাজিক মিলন কেন্দ্র।
রোমান বাথে ঢুকে গা শিহরিত হয়ে ওঠে। চারদিকে মূর্তি, মাঝখানে পানি। ঝর্নাধারার মতো মিনারেল পানি এসে পড়ছে। তবে পানিতে এখন আর নামা যায় না। সবাই ছবি তোলাতুলি করছে। বাথ শহরে এই রোমান ঐতিহ্যবাহী বাথে টিকিট করে ভেতরে যেতে হয়। এদের চারটি স্থানে যাওয়ার পারমিশন থাকে- রোমান চার্চ, রোমান বাথ হাউস, মিউজিয়াম ও Sacred sparing.
আকর্ষণীয়, চিত্তাকর্ষক এই বাথ হাউসটি এক কথায় মনোমুগ্ধকর।
বাথ নগরী : বাথ হাউস থেকে বেরিয়ে কয়েক পা এগোলেই অ্যাবি চার্চ। এই চার্চটি প্রায় হাজার বছর পুরানো। জর্জিয়ান স্টাইলে গোথিক আর্কিটেকচারের সুন্দর মনোমুগ্ধকর এই চার্চটি অতীতে বহুবার আগুন ও যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধর্মীয় প্রভাব ছাড়াও সমারসেট অঞ্চলের সামাজিক জীবনেও এই চার্চের অবদান অনস্বীকার্য। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে বাথ স্বমহীমায় মহীম। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সময়ে বাথ প্রথম শহরের মর্যাদা পায়। জর্জিয়ান যুগে বাথ শহরকে নতুন ডিজাইনে তৈরি করা হয়।
অদ্ভুত সুন্দর এই বাথ নগরী। তার রূপের ছটায় জানান দিচ্ছিল খরস্রোতা অ্যাভন নদীর তীরে প্রাচীন রোমান সম্রাটের জৌলুস, আভিজাত্য আর রুচির বাহার।
ছোট্ট সুন্দর, সাজানো গোছানো, পরিষ্কার ছিমছাম শহরে সবকিছু কাছাকাছি। একদিনের ট্যুরে মনভরে ঘুরে আসা যায়। জর্জিয়ান স্থাপত্যে তৈরি সব দালান-কোঠার কোণায় কোণায় লুকিয়ে আছে সমৃদ্ধ ইতিহাস, সংস্কৃতি, জৌলুস। চমৎকার নির্মাণ কৌশলে নির্মিত প্রাসাদে ইংল্যান্ডের ঐতিহ্য বহণ করে আছে।
পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে জর্জিয়ান স্ট্রিট, নানারকম মূর্তি সজ্জিত শপিং সেন্টার, আছে রয়েল ক্রিসেন্টে ৩০টি একই ডিজাইনের বাড়ির সারি। কিছুটা গোল আকৃতিতে তৈরি, কি যে চমৎকার লাগে, মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না! বাথ বৃটেনের অপূর্ব সুন্দর একটি শহর, যা নাকি ভিজিটরদের ভ্রমণে সাদরে আহ্বান জানিয়ে আসছে।
ট্যুরিস্টরা জর্জিয়ান স্ট্রিটে সব নামিদামি দোকান ও ক্রিসেন্টে টেরেসের ছবি তুলতে ব্যস্ত সময় পাড় করতে পারে। আমিও কিছু না কিনে ঘুরে ঘুরে এইসব পথে হেঁটে কিছুটা সময় তৃপ্ত হয়েছি।
পাবলিক বাথ আছে তাতে উষ্ণ প্রস্রবণ। স্পাতে স্থানীয় ও ট্যুরিস্টরা স্নান কতে পারে। তাদের মূল্যবান সময় কিছুটা আমোদ ও আরাম-আয়েস করতে এই গরম জলে শরীর ডুবিয়ে থাকতে পারে।
বাথ শহরে কফিশপে গরম গরম মজাদার খাওয়া ও কফিতে কিছুটা সুন্দর সময় উপভোগ করা যায়। মজার ব্যাপার হলো কফিশপগুলোর বাইরে চেয়ারপাতা আছে জনসাধারণের জন্য। কিছু কেনাকাটা না করলেও বিনা দ্বিধায় যে কেউ বসতে পারবেন। ট্যুরিস্টদের আয়ে শহর চলে, তাই ট্যুরিস্টদের এরা যথেষ্ট মূল্যায়ন করে।
পর্যটকরা এখানে ঘুরে বেশ স্বাচ্ছন্দবোধ করে। অপরাধমুক্ত এই মনোরম শহরটি অনেক রাত পর্যন্ত কোলাহলে জেগে থাকে। আমি ট্যুও বাসে গেছি। প্রায় ২ ঘণ্টার মতো সময় লেগেছে যেতে। বাসড্রাইভার বাস ছাড়ার নির্দিষ্ট সময় ও স্থান বলে দিয়েছে।
আমি দুপুরে পাস্তা খেয়েছি। খুব সুস্বাদু ছিল খাবার। দুই-তিনবার চা ও কফি হয়েছে। সারাদিন ঘুরে খুব আনন্দ পেয়েছি।
আমার কাছে বাথ শহরটিকেই মিউজিয়াম বলে মনে হচ্ছে। বাথ হাউসে উপরে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। উপর থেকে বাথ শহরটি, চার্চের চূঁড়া ও ছড়ানো-ছিটানো মূর্তিগুলো খুবই চমৎকার লাগে। বাথ শহরের সৌন্দর্য্য দেখে মুগ্ধ হননি, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর।
কিছু কিছু অনুভূতি আছে, যা বলে বোঝানো যায় না। সরেজমিনে অনুভব করতে হয়। এমনই এক প্রকাশরহিত অনুভূতি নিয়ে একসময় ট্যুর বাসের দিকে রওনা দিলাম।