Thikana News
১৬ অক্টোবর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫

‘হানুজ ঢাকা দূর অস্ত’

‘হানুজ ঢাকা দূর অস্ত’



 
এই লেখার শিরোনামটি ফারসি বচন ‘হানুজ দিল্লি দূর অস্ত’ থেকে ধার করা, যা দিয়ে দিল্লি এখনো অনেক দূর বা হিন্দিতে বললে দিল্লি আভি বহুত দূর হ্যায় বোঝায়। সাম্প্রতিককালে নিউইয়র্ক, লন্ডনসহ বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদের সমর্থক কিছু ব্যক্তি ও গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চব্বিশের ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত গুম, খুন, গণহত্যা, দুর্নীতি ও অসংখ্য অপকর্মে জড়িত আওয়ামী লীগ নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে ক্ষমতার মসনদে আবার বসানোর লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি চক্রের নানামুখী তৎপরতা দেখে ওই ফারসি বচনটির কথা মনে পড়ে গেল। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব তৎপরতার লক্ষ্য হলো ব্যাপক সংঘাত-সহিংসতা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশে গুরুতর অস্থিতিশীল এবং নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ওই চিহ্নিত চক্রটির ষড়যন্ত্র সফল করা।

এরই মধ্যে দিল্লিতে অবস্থানরত পলাতক প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সার্বিক তত্ত্বাবধানে দিল্লির অভিজাত লুটিয়েন্স এলাকার বাংলা বাড়িতে ভারতে পলাতক আওয়ামী নেতা ও তাদের সমর্থক কিছুসংখ্যক ভারতীয় ব্যক্তির (গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাসহ) যোগসাজশে ষড়যন্ত্রের এই ব্লুপ্রিন্ট তৈরির কাজ চলছে বলে মিডিয়া রিপোর্ট সূত্রে জানা যায়। ওই ব্লুপ্রিন্টে সহসাই নানা ধরনের নাশকতাসহ আসন্ন নির্বাচনকে যেকোনো মূল্যে বানচাল করাকে Focal Point করা হয়েছে, যার কিছু আলামত এরই মধ্যে দৃশ্যমান হতে দেখা যায়।

সম্প্রতি ঢাকার একটি মিলনায়তনে ‘মঞ্চ ৭১’ নামের নবগঠিত একটি সংগঠনের ব্যানারে কথিত ইতিহাস বিকৃতি প্রতিরোধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার স্লোগান তুলে আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনা সভা থেকে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীসহ আরও একাধিক ব্যক্তির গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে এই ষড়যন্ত্রের মুখোশ কিছুটা হলেও উন্মোচিত হয়। এই সভার সঙ্গে যুক্ত গ্রেফতাকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন শেখ হাসিনার সাবেক ডেপুটি প্রেস সচিব আবু আলম শহীদ (১৯৯৬-২০০১) ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ভূঁইয়া শফিকুল ইসলাম। তা ছাড়া এনায়েত করিম চৌধুরী নামের এক ব্যক্তিকে মিন্টু রোড এলাকায় গাড়ি নিয়ে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরির সময় সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে পুলিশ ১৩ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করে। তাকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা RAW-এর একজন চর বলে সন্দেহ করা হয়েছে। ঢাকার উত্তরা থেকে সম্প্রতি গ্রেফতারকৃত ময়মনসিংহের জনৈক আওয়ামী নেতাকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের আরও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য জানতে পেরেছে বলে মিডিয়া সূত্রে জানা যায়। ওই আওয়ামী নেতা জানান, তার মতো আরও বহু নেতা ঢাকায় এসে একাধিক গোপন বৈঠকে নির্বাচনের পূর্বে ঢাকা অচলের (Dhaka Blockade) একটি কর্মসূচি নিয়ে সলাপরামর্শ করেন। তার ভাষ্যমতে, শেখ হাসিনার গ্রিন সিগন্যাল পাওয়া মাত্র সারা দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ঢাকার শাহবাগে জড়ো হয়ে ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচির সূচনা করা হবে। পুলিশ বাধা দিলে তারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, যেমন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ও তেজগাঁওস্থ কার্যালয়, ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভবনসহ আরও কিছুসংখ্যক সরকারি স্থাপনায় চড়াও হয়ে অগ্নিসংযোগসহ বিপুলসংখ্যক যানবাহন ভাঙচুরের তৎপরতায় লিপ্ত হবে।

এই পরিকল্পনা সম্পর্কে নেতাকর্মীদের এরই মধ্যে ঢাকার বসুন্ধরার একটি কনভেনশন সেন্টার ও একাধিক রেস্তোরাঁয় বৈঠক করে প্রাথমিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং সামনের দিনগুলোতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দান অব্যাহত রাখা হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আওয়ামীপন্থী জনৈক কর্মকর্তা এবং চাকরিচ্যুত কয়েকজন বেসামরিক কর্মকর্তা এই নির্দেশনাদান কর্মকাণ্ড তদারকির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘মঞ্চ ৭১’-এর মতো আরও কিছু সংগঠন (প্রজন্ম ৭১, জয় বাংলা ব্রিগেড ইত্যাদি) খুলে কট্টর আওয়ামী, মুজিব এবং হাসিনা ভক্তদের সরকার উৎখাত ষড়যন্ত্রে যুক্ত করার যাবতীয় প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হবে। হাসিনার গদিচ্যুতি এবং তার বিচার কার্যক্রমকে এসব আওয়ামী অনুসারীকে খেপিয়ে নাশকতায় লিপ্ত হতে মোটিভেট করার কাজে লাগানো হবে। তা ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের কথিত অদক্ষতা ও ব্যর্থতার খতিয়ান প্রচারের জন্য সংবাদপত্রে কলাম লিখে টেলিভিশন টকশো ও বিভিন্ন সমাজ মাধ্যমে ব্যাপক অপপ্রচার চালানোও এই ব্লুপ্রিন্টের অন্যতম অংশ। পুতুলের নেতৃত্বে খোলা যে কার্যালয়ের মাধ্যমে এসব কার্যক্রম চালানো হবে, তার নাম দেওয়া হয়েছে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন’, যার সঙ্গে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (RAW)-এর নামের মিল রয়েছে। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও বাংলাদেশকে কূটনৈতিক ও অন্যভাবে হেয় করাকেও ষড়যন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা সম্প্রতি নিউইয়র্ক ও লন্ডনে বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের সফরকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনাবলি (ধাওয়া, ডিম ও পাথর ছোড়া ইত্যাদি) থেকে কিছুটা আঁচ করা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য এবং আরও অনেক আওয়ামী নেতার বিরুদ্ধে গুম, খুন, গণহত্যা, দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মের অভিযোগে বিচার কার্যক্রম ঢাকার দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ দেশের বিভিন্ন আদালতে চলমান রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগের ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ, যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হলো ব্রিটিশ দৈনিক ‘ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস’ সংবাদপত্রে ‘Bangladesh’s missing billions stolen in plain sight’ শীর্ষক এক প্রামাণ্যচিত্র, যেখানে বিগত দেড় দশকে আওয়ামী নেতাদের লুটপাট ও কয়েক কোটি ডলার বিদেশে পাচারের তথ্য তুলে ধরা হয়। বিচারাধীন মামলায় তাদের বিরুদ্ধে অপরাধের সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকায় শেখ হাসিনাসহ তাদের অনেকের দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিভিন্ন মহলে জোর গুঞ্জন রয়েছে।

আওয়ামী নেতারা যদি অন্তর্বর্তী সরকার তথা ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে গিবত ও সরকার উৎখাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ক্ষমতার মসনদ ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে থাকেন, সেটা হবে এক অলীক স্বপ্ন এবং এ ধরনের স্বপ্নে বিভোর না হওয়াই তাদের জন্য উত্তম হবে, নতুবা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন সময় ও ভয়াবহ পরিণতি।

চব্বিশের জুলাই-আগস্টে হেলিকপ্টার, সাঁজোয়া যান এবং আধুনিক অস্ত্র দিয়ে নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে যে সাহসী জনগোষ্ঠীকে পদানত করা যায়নি, তাদেরকে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে দমন করা যাবে মনে করে থাকলে, সেটা হবে তাদের এক প্রকারের এপিক (Epic) শীর্ষ মূর্খামি।
তথ্যমতে, তৎকালীন দিল্লিতে ইসলামি সুফি সাধক পুরুষ হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার (রহ.) প্রভাব ও জনপ্রিয়তা দেখে সে সময়কার দিল্লির শাসক গিয়াসউদ্দিন তুঘলক তাকে অবিলম্বে দিল্লি ছাড়ার নির্দেশ দেন। একটি অভিযান শেষে তুঘলকের দিল্লি ফেরার আগেই তাকে দিল্লি ছাড়তে বলা হয়। এ কথা হজরতের ভক্তরা তাকে জানালে তিনি উত্তর দেন, ‘দিল্লি আভি বহুত দূর হ্যায়’। অর্থাৎ দিল্লি এখনো অনেক দূর। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, দিল্লিতে ফেরার পথে এক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে তুঘলক মঞ্চে ওঠার সময় তার ওপর মঞ্চ ভেঙে পড়লে তিনি নিহত হন।

আধিপত্যবাদী শক্তি ও ষড়যন্ত্রকারীদের সহায়তায় হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর আওয়ামী নেতারা হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার (রহ.) সেই বচনটি মনে রাখলে ভালো করবেন বলে মনে করি। গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের জন্য যেমন দিল্লি অনেক দূরের হয়ে উঠেছিল, শেখ হাসিনা ও তার অনুসারীদের জন্যও যে ঢাকা অনেক দূরের হবেÑএটা নিশ্চিত।
লেখক : কলামিস্ট

কমেন্ট বক্স