Thikana News
১৭ অক্টোবর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি এবং রাজনৈতিক কৌশল

বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি এবং রাজনৈতিক কৌশল



 
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কমবেশি সবার ধারণা থাকলেও রাজনীতির বাইরে সুশীল সমাজ খুব একটা মুখ খুলতে চায় না। কিন্তু তাদের এই নীরবতার লক্ষণ যে আমাদের আগেকার গণমানুষের অধিকার আদায়ের রাজনীতির বর্ণময় ইতিহাসের সবগুলো অধ্যায়কে বিস্মৃত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে! সেদিকে কারও কোনো খেয়াল নেই। আমাদের এই জাতির এত শৌর্য-বীর্যের বীরত্বগাথা ইতিহাস আছে, তা আমরা ভুলতে বসেছি।

যার ফলে বিরাজমান পরিস্থিতিতে দেশের সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে যেসব হতাশা দেখতে পান, তাদের শোধরানোর কোনো পথ দেখাতে এগিয়ে আসেন না! দুয়েকজন বহু বিতর্কিত ব্যক্তিবর্গ হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলেন। কিন্তু প্রতিকারে কেউ এগিয়ে আসেন না।

ধরা যেতে পারে, এই যে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানের কথা। কী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে একটি কঠিনতম ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটিয়ে আরেকটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পদযাত্রায় সমর্থন জানানো হয়েছে। সেই অভ্যুত্থানে কী পরিমাণ ছাত্র-জনতার প্রাণহানি ঘটেছে এবং হাজার হাজার আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। জুলাইযোদ্ধা পরিচয়দানকারীরা আগেকার ঘটনাবলির কথা মনে হয় ভুলে গেছেন। বরং তখনকার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের (জুলাই যোদ্ধা) অংশীজনদের মধ্যকার হানাহানির পথ খুলে দেওয়া হয়েছে! বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত আবদুল কাদের অত্যন্ত গ্লানিকরভাবে ডাকসু নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। অথচ জুলাই যোদ্ধা হিসেবে শিক্ষার্থীদের উচিত ছিল আবদুল কাদের অথবা উমামা ফাতেমাকে ভোট দেওয়া। বরং আমরা কী দেখলাম, এনসিপি নেতা ও জুলাই যোদ্ধা হাসনাত ও সারজিস সরাসরি শিবিরের নির্বাচিতদেরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং বিএনপিপন্থীদের চরম সমালোচনা করেছেন।
কিন্তু কেউ চিন্তা করল না, ধুরন্দর ছেলেটি (সাদিক কায়েম) ছাত্রলীগের নেতা ছিল, সে ৫ আগস্টের পর যেকোনোভাবে জুলাই যোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত হয়ে জামায়াত-শিবিরের রুটি-রুজি ভোগ করে এখন ডাকসু নির্বাচনে ভিপি হয়ে গেল! মজার ব্যাপার হলো, পতিত সরকারপ্রধান শেখ হাসিনাও নাকি সাদিক কায়েমকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এই খবরটি জনমনে আরও বেশি কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। এখানে শিবিরের আরও কৌশলগত দিক হচ্ছে, শিবির নিজেদের দলীয় পরিচয় গোপন করেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ঐক্য প্যানেল নামে নির্বাচন করেছে।
এর কারণ কী বোঝা গেল (?), শিবির নিজেদের সম্পর্কে সন্দিহান। স্বনামে নির্বাচন করলে ভোট না পাওয়ার আশঙ্কা থেকেই তারা এখানেও আরেকটি কৌশল নিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটাও একটি জঘন্যতম মোনাফেকি ও অনৈতিক পন্থা। নিজের দুর্বলতা প্রকাশ হওয়ার ভয়ে তারা এসব কৌশল করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে থাকে। হয়তো আগামী জাতীয় নির্বাচনেও জামায়াত একই কৌশল নিয়ে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করবে! অনেকে মনে করেন, এভাবেই সুবিধাভোগী একটি শ্রেণির কারসাজির ফলে এমন ফলাফল হতে পেরেছে। জামায়াত ছাড়া অন্য দলগুলোর নিকট থেকে এ ধরনের অভিযোগ আসছে।

গত বছর মৃত্যুর মুখোমুখি যে ছেলেমেয়েরা জীবনের তোয়াক্কা না করে এত রক্ত ঝরালো ও জীবন উৎসর্গ করল, তাদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে সবাই যে যার মনমতো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যে যোদ্ধারা এখন মাঠে আছে, তাদের মধ্যে ঐক্য নেই। তারা নিজেদের ঐক্যকে ধরে রাখতে পারেনি। এটা লজ্জাজনক ও দুঃখজনক।

বাংলাদেশের মানুষ এভাবেই অতীতের কথা ভুলে যায়? কী ভয়ংকর ছিল তখনকার ফ্যাসিস্ট সরকার ও তার পেটোয়া বাহিনী। প্রতিদিনের গন্ডগোল ও গুলিতে যে পরিমাণ ছাত্র ও সাধারণ মানুষ প্রাণ হারাতেন, যারা আহত হতেন, তাদের হাসপাতালে ভর্তি করাও নিষিদ্ধ ছিল। তবু রিকশাওয়ালা, সিএনজি কিংবা যেকোনোভাবে গুলিবিদ্ধ মারাত্মক আহত ও তাদের স্বজনদের আর্তনাদ দেখেও সরকার ও পুলিশ বাহিনীর লোকেরা ছিল নির্বিকার। অনেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় যথাসময়ে হাসপাতালে না নিতে পারায় রাস্তায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
শিক্ষার্থীরা সবাই কীভাবে যেন ভুলে গেল, কী বীভৎসতা নেমে এসেছিল তাদের জীবনে। হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে শত শত আহতের ওপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের আক্রমণ এবং বাইরে পুলিশের সরাসরি গুলির কথাও অনেকে ভুলতে বসেছেন।
একই অবস্থা রাজনৈতিক দলগুলোর। তারা বিগত সরকারের সময় কী পরিমাণ গুম, হত্যা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তারা এখন আর জুলাই যোদ্ধাদের মনে রাখতে চান না। বরং একদল আরেকদলের মধ্যে কাদা-ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত হয়ে গেছেন। স্বার্থের জন্য একদল আরেকদল মারমুখী অবস্থানে। এই মাঠের প্রধান দল বিএনপিও নির্বাচনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। যে কারণে একশ্রেণির লোক তাদেরকেও নানান তকমায় ট্যাগিং করছে।

আসলে সবাই একযোগে শয়তান তাড়ালেও নিজেদের মধ্যকার শয়তানিকে বহাল রেখেছেন। লোভ ও ক্ষমতার স্পর্শকাতর প্রতিযোগিতায় তারা ভুলে গেছেন কিছুদিন আগেকার ঐক্যের কথা। ফলে কেউ সমন্বয়ক নামে, কেউবা রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে চাঁদাবাজি করে বেড়াচ্ছেন। মাঠে-ময়দানের রাজনৈতিক দলসমূহের কার্যকলাপ দেখে তা-ই মনে হচ্ছে। একে অপরের মধ্যে কাদা-ছোড়াছুড়ি এমনকি মারামারি, হানাহানি ও খুনোখুনির মতো ঘটনা পর্যন্ত হচ্ছে!

এরই মধ্যে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য হলেও এসব ভোটাভুটির রেজাল্ট অনেকের মনে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিরাজনৈতিকীকরণের অজুহাতে একসময়ের গুপ্ত সংগঠনের লোকদের বিজয়ী হওয়ার পথকে সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু এই বিরাজনৈতিকীকরণের দাবিদার নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ যে একসময় তৎকালীন স্বৈরশাসকের লেজুড়ভিত্তিক ছাত্রসংগঠনের ভেতরে থেকে কাজ করে নিজেদের ফায়দা লুটেছেন, সেই কথাও সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভুলে গিয়েছেন। অথবা সেটিকে আমলেই দিচ্ছেন না। যারা ফ্যাসিবাদের জঠরে লালিত হয়েছেন, তারাই আবার ফ্যাসিবাদের লালিত ছাত্রদের নিজেদের দলে ভিড়িয়ে বুকে টেনে নিয়েছেন।
ছাত্রলীগের চিহ্নিত ছাত্ররা মিলে তাদের অনেকেই এখন শিক্ষাঙ্গনের নেতৃত্বের অংশীদার হতে পেরেছেন। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর নৈতিক অবস্থান কোথা থেকে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, তা এসব নির্বাচনের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। এরই মধ্যে টিভি ও গণমাধ্যমে এই স্পর্শকাতর সুযোগসন্ধানীদের নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। বিশেষ করে, যারা ইসলামের নামে রাজনীতি করছেন, তাদের কৌশলগত অবস্থানকে মোনাফেকি হিসেবে অনেকে মনে করেছেন। অর্থাৎ যখন যেমন অন্য কেউ প্রদর্শন করলেও ইসলামের নামে জামায়াত সেটি কোনো অবস্থাতেই করতে পারে না।

একদিকে গুপ্ত সংগঠন তার নিজের নামে আবির্ভূত না হয়ে অন্য কোনো নতুন নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছাত্রজীবনের নানামুখী সমস্যার সমাধান করে তাদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে এবং শেষমেশ তারা ভোটে নির্বাচিতও হয়েছে। কিন্তু আসল সত্যটিকে লুকিয়ে মাঠের আরেকটি রাজনৈতিক দলের সুবিধাসমূহকে সার্থক করার পথে ভূমিকা রেখেছে। এ ধরনের অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কথা বলার লোক নেই।

এখানে উল্লেখ করার মতো আরও অনেক স্পর্শকাতর ঘটনার অবতারণা ঘটেছে। যেদিন ডাকসু নির্বাচন হলো, জামায়াত-শিবিরের কর্মতৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার পর ভোটের ফলাফলের জন্য অপেক্ষমাণ হাজারো লোক ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাইরে চতুর্দিকের বিভিন্ন পয়েন্টে জামায়াতের শত শত লোকের মহড়ার চিত্র ছিল খুবই উদ্বেগজনক! মনে হচ্ছিল, তারা পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে ঘিরে রেখেছিল। যেকোনো মুহূর্তে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারত। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, ডাকসু নির্বাচন ঘিরে তাদের কী পরিমাণ প্রস্তুতি ছিল!

অন্যদিকে যে রাজনৈতিক দলের (বিএনপি) ছাত্রসংগঠন (ছাত্রদল) বিগত সতেরো বছর অবর্ণনীয় নির্যাতনের মুখোমুখি হয়ে শিক্ষাঙ্গন এবং হল প্রবেশাধিকার পায়নি, বিগত সরকারের অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হয়ে সর্বস্ব হারিয়েছে, মনে হচ্ছে, তারা এখনো তাদের সেই দুর্ভোগের দিকেই ধাবিত হচ্ছে! আপাতত তারা প্রতিদ্বন্দ্বীদের চালে হারতে বসেছে। বিএনপির বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া শিবির যে পরিমাণ ছাত্রদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করেছে, বিএনপির ছাত্রদল সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। শিবির অনেক অর্থ ব্যয় করে সাধারণ ছাত্রদের হলে থাকার সুবিধা করে দিয়েছে। ফলে নানা ধরনের প্রলোভনের কারণে শিবিরের লোকজনই বেশি ভোট পেয়েছে, নির্বাচিত হয়েছে। আর ছাত্রদলের ভরাডুবি হয়েছে।

আবার জুলাই যোদ্ধাসহ রাজনৈতিক সংগঠন এনসিপির দুয়েকজন নেতা নির্বাচিত ডাকসু নেতৃবৃন্দের প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দের বিস্তর সমালোচনা করেছেন। বিগত এক বছর হলের অভ্যন্তরে শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার মাধ্যমে তাদের মন গলানো সম্ভব হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাঙ্গনে বিরাজনীতির ধোঁয়া তুলে ছাত্রদলকে যেকোনো কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অপরদিকে শিবির সমর্থিতদের পেছনে রাজনৈতিক দলের সবক নিয়েই সবকিছু করা হয়েছে। এই চালেও ছাত্রদল পিছিয়ে গেছে। এদিকে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা দুটো নির্বাচনে ভোটের দিনের শেষ বেলায় কারচুপির নানাবিধ অভিযোগ তুলে ভোট বর্জন করেছেন। কিন্তু তাতেই-বা কী হয়েছে? কর্তৃপক্ষের তাতে কোনো সমস্যা হয়নি। এখানে আরও কিছু মর্মান্তিক ঘটনার অবতারণা হয়েছে। ডাকসু নির্বাচনের নিউজ কভার করতে গিয়ে দায়িত্বরত অবস্থায় একটি টেলিভিশনের তরুণ সাংবাদিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে! তাতে কারও কোনো ক্ষতি হয়নি।

একইভাবে পরবর্তীতে জাকসু নির্বাচনে অব্যবস্থাপনার মধ্যে ভোট গ্রহণ ও গণনার ব্যাপক জটিলতার মধ্যে দায়িত্বরত অবস্থায় একজন রিটার্নিং অফিসার, যিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষিকা ছিলেন, অধিক রাতে কেন্দ্রে কাজ করার পর প্রচণ্ড অসুস্থতা নিয়ে তিনি বাসায় চলে যান। কিন্তু পরবর্তীতে আবার ডাকিয়ে এনে তাকে নিয়ে ভোট গণনার কাজে আসতে বাধ্য করা হয়। তিনি শারীরিক ভীষণ অসুস্থতার মধ্যে মানসিক পীড়ার মধ্যে পুনরায় কাজে আসার পর তার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে! বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মনে দয়ার সঞ্চার করেনি।

একজন স্বনামধন্য শিক্ষকের এই মর্মান্তিক মৃত্যুতে শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনাস্বরূপ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের স্বার্থে নির্বাচন বন্ধ করে দিয়ে সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ রাখা উচিত ছিল। কিন্তু সেটির কিছুই প্রদর্শন করা হয়নি। কর্তৃপক্ষের কী পরিমাণ বেকুবি এবং নির্দয় আচরণ হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন কাণ্ড করা যায়! বরং তারা পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত মোতাবেক নির্বাচনের ৪৮ ঘণ্টার অধিক সময় পার করে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা দেন।

এবার শাসকদের কথায় ফিরে আসা যাক। রোমানিয়ার ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরশাসক ছিলেন নিকোলাই চাউসেস্কু। তিনি ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত রোমানিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং রোমানিয়ার সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৮৯ সালে রোমানিয়ার বিপ্লবের পর তাকে ক্ষমতাচ্যুত ও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। রোমানিয়ার শাসক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই তার সরকারের সময়কার লোকজনকেও পরিবর্তনের মাধ্যমে দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়।

কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। শুধু পতিত সরকারের রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতাকর্মী ছাড়া প্রশাসনিক ক্ষেত্রে খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। বাংলাদেশের অবস্থা অন্য রকম। এখানে আগেকার সরকারের ভেতরকার লোকেরা পালিয়ে গেলেও অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদী কাঠামোর সরকার-ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটলেও সরকার পরিবর্তনের পর সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বাইরে থাকা সম্ভব হয়নি। ফ্যাসিবাদের সহযোগীরা অনেকেই এখনো সরকারি চাকরিতে বহাল রয়েছেন। ইউনূস সরকার তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এখানে এক অদ্ভুত ধরনের সরকার রয়েছে। সরকার তার মন্ত্রিসভার (উপদেষ্টা পরিষদের) এমন কিছু সদস্যকে নিয়ে কাজ করছে, দুজন বাদে যাদের কারও জুলাই অভ্যুত্থানে কোনো ভূমিকা ছিল না। অপরদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই ঘোলাটে। জুলাই বিপ্লবের অংশীজন দাবিদার অনেকেই অতীতকালের অবস্থা ভুলে গিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির পথে হাঁটছেন। ফলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত ও জটিল হয়ে উঠছে।
এবার ডাকসু প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে বাইরে থেকে আনার বিষয়ে একমত ছিলেন না। সবার মাঝে প্রশ্ন উঠেছে, সরকার কি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কোনো শিক্ষককে পায়নি যে বাইরে থেকে অন্য একজনকে ভিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হলো! অনেকের মতে, এই ভিসি মহোদয় একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে এসেছেন। তিনি পূর্ব থেকেই সেই রাজনৈতিক দলটির সমর্থক।

একইভাবে ডাকসু নির্বাচনে জামায়াত সমর্থিত শিবিরের একচ্ছত্র আধিপত্যবাদ জয়ী হওয়ার পেছনেও নানা রকম অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। পতিত ফেরারি সরকারের ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের অনেকেই এখন শিবিরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে! বিএনপিপন্থী ছাত্রদল এবং গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ-সমর্থিত বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেল কোনো পদে জিততে পারেনি।

এদিকে ডাকসুর ফলাফলের পর রাজধানীর বাংলামোটরে এনসিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের নির্বাহী কাউন্সিলের সভা হয়। সেখানে নেতাদের অনেকে ডাকসুতে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের শোচনীয় পরাজয় নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। এমন পরাজয়ের পেছনে বিভিন্ন কারণও তুলে ধরেন অনেকে। তাদের বক্তব্যে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিভাজনের বিষয়টি বেশি এসেছে। এ ছাড়া অনেকের মতে, প্রার্থীদের অভিজ্ঞতার অভাব ও প্রচারের ক্ষেত্রে যথাযথ কৌশল না থাকার কারণে অনেকের নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে। কিন্তু তারা এ বিষয়টি উল্লেখ করেননি, ঠিক যেমনটা আগে শিবির ছাত্রলীগের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, শিবির যেমন করে তাদের মূল মুরব্বি সংগঠন জামায়াতের সঙ্গে থেকেও বলে থাকে, তারা কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করে না, জামায়াত-শিবিরের এই তথাকথিত কৌশলকে অনেকেই মোনাফেকি ও অনৈতিক বলে মনে করেন। ধর্মীয় রাজনীতিতে এমন অনৈতিক কর্মকাণ্ড কি করা যায়? শুধু ধর্মীয় কেন, কোনো রাজনীতিতেও এটি করা যায় না।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিবিরের ব্যাপক কার্যক্রম রয়েছে। ৫ আগস্টের পর তারা আগের মুখোশ পাল্টে আগের (প্রকাশ্যে) অবস্থায় ফিরে এসেছে। অর্থাৎ শিবির তাদের নিজেদের নামে সংগঠনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই টেকনিক কিংবা কৌশলগত কারণে সাধারণ ছাত্রদের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ এখানে পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে, আগের মতোই জামায়াত-শিবিরের সময় বুঝে অনৈতিক হয়ে যাওয়াটাকে পূর্বের মতো কৌশলগত পরিচয়ের কোনো ঘাটতি হয়নি এবং তাদের দৃষ্টিতে নৈতিক দিকের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

একইভাবে বিএনপির ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দ নির্বাচনের ভোটের ফলাফল নিয়ে ভিসির বাসায় গিয়ে অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু কোনো ফল তো হয়নি। বরং ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের বাগ্্বিতণ্ডার একপর্যায়ে ভিসি এবং অন্য শিক্ষকদের সামনে টেবিল চাপড়ে ভিসির সঙ্গে বেয়াদবি করার অভিযোগও উঠেছে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে।

অন্যদিকে জাকসু নির্বাচনে আনাড়ি ব্যবস্থাপনায় যে নির্বাচন হলো, সেখানেও শিবিরের জয়জয়কার। কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শিতা, অনিয়ম এবং অযোগ্যতার কারণে নির্বাচন কমিশন থেকে কয়েকজন শিক্ষক পদত্যাগ করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদিন সবচেয়ে বিয়োগাত্ম ও বিষাদময় ঘটনার অবতারণা হয়েছে। একজন সম্মানিত শিক্ষক শারীরিক অসুস্থতার কারণে বাসায় চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে প্রেশার করে বাসা থেকে আনিয়ে ভোট গণনার কাজে লাগানো হয়েছে। তাকে রেস্ট নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। ফলে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি। এটি এমনই হৃদয়বিদারক, করুণ ও বিষাদময় খবর, পুরো দেশবাসীকে মর্মাহত ও শোকাহত করেছে। শুধু তা-ই নয়, একজন সম্মানিত শিক্ষকের শোকাবহ পরিবেশে শোক জ্ঞাপন করে সকল শিক্ষকের উচিত ছিল পুরো নির্বাচনটি স্থগিত রাখা। এই একটি কারণেই নির্বাচন স্থগিত করা যেত। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ কর্তৃপক্ষ সেটি না করে নির্বাচনটাকেই মুখ্য হিসেবে গুরুত্ব দেন। অর্থাৎ যে ছকে নির্বাচন সাজানো হয়েছে, তারা সেটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কিসের শোক কিংবা সমবেদনা! মহান শিক্ষকের প্রতি ছিল তাদের এমন ব্যবহার!

বলাবাহুল্য, জাকসু নির্বাচনের ভোট গ্রহণ, ভোট গণনা ও ভোট গ্রহণ ব্যবস্থাপনার ব্যাপক অনিয়ম ও ত্রুটির অভিযোগে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনসহ কয়েকটি প্যানেল নির্বাচন বর্জন করেছে। তারা ত্রুটিপূর্ণ অবস্থায় ভোট স্থগিত রেখে পুনরায় নির্বাচনের দাবিও করেছে। একজন শিক্ষকের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় এবং নানাবিধ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গোটা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনেক ধোঁয়াশা তৈরি করে ভোটের ফলাফল ঘোষণা করেছে। যেখানে শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষার্থে তার প্রতি সমবেদনা জানানো স্বরূপ শোক পালনের কর্মসূচি পালন করা উচিত ছিল, সেখানে তারা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মধ্যেই জাকসু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করতে বিলম্ব করেননি। তারা কোনো ধরনের দ্বিধান্বিত ছিলেন না। এতেই বোঝা যায়, নির্বাচনের পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়াই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। কেননা, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের জীবনের চেয়ে নির্বাচন কমিশনসহ কর্তৃপক্ষ নির্বাচনকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। এমন মানবতাবিরোধী নির্দয় ঘটনা ইতিপূর্বে বাংলাদেশের কোথাও ঘটেছে বলে জানা নেই। একইভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড না থাকলেও গোপনভাবে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত থাকতে দেখা গেছে। এই কৌশলই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংসদ নির্বাচনের মেরুকরণ পাল্টে দেয়।

আসলে রাজনৈতিকভাবে সবাই একযোগে ফ্যাসিজমকে তাড়াতে পারলেও বর্তমানে সেসব রাজনৈতিক দল নিজেদের দলের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারেনি। তারা রাজনৈতিক শিষ্টাচারের কথা ভুলতে বসেছে। গণতন্ত্র কী এবং কীভাবে তাকে ব্যবহার করতে হয়, রাজনৈতিক দলগুলো সেসব মনে হয় ভুলে গেছে? কেননা বিস্মৃতিই তাদের পেয়ে বসেছে। অতীতের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কথা ভুলে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হানাহানি ও ঝগড়া-বিবাদের ফলে গণতন্ত্র তার আসল লক্ষ্যে ফিরে আসতে পারছে না।
গণতন্ত্র হলো এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যেখানে চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে এবং শাসকেরা জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। এটি একটি ‘জনগণের শাসন’, যেখানে নাগরিকদের স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা হয়। গণতন্ত্রের দুটি প্রধান রূপ হলো প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র, যেখানে জনগণ সরাসরি আইন প্রণয়ন করে এবং পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র, যেখানে প্রতিনিধিরা জনগণের হয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কাজ করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের উচিত পরস্পরের মধ্যে সমন্বয়, সহযোগিতা ও সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করে দেশ ও জনগণের কল্যাণে একযোগে কাজ করা।

গণতন্ত্রের মূলনীতি বলতে আমরা বুঝি-জনগণের সার্বভৌমত্ব : যেখানে রাষ্ট্রের ক্ষমতা জনগণের ওপর ন্যস্ত থাকে এবং জনগণই সকল ক্ষমতার মূল উৎস। যেখানে রাষ্ট্রের শাসক প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। গণতন্ত্রে জনগণের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা সুরক্ষিত থাকে। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক দেশে আইনের শাসনের মধ্যে কোনো অবিচার করা যায় না। স্বাধীন ও নিরপেক্ষতার মাধ্যমে সত্যনিষ্ঠতার ভিত্তিতে সবার জন্য সমান আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূলনীতি হচ্ছে বহুদলীয় ব্যবস্থার অধীনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। যারা জনগণের ভোটে জয়লাভ করে, তারাই সরকার পরিচালনা করে। বাংলাদেশে সেই ব্যবস্থা কখন ফিরে আসবে এবং কীভাবে তা বাস্তবায়িত হবে, সবাই সেই প্রতীক্ষায় রয়েছেন।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।
 

কমেন্ট বক্স