Thikana News
১৬ অক্টোবর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫

স্মৃতির আলপনায় আঁকা

মানুষের অনেক অভ্যাসই বদলে যায়। কোনো একটা জায়গায় কিছুই স্থির থাকে না। পরিবেশ, অবস্থান মানুষকে বদলে দেয়। পরিস্থিতির কারণেও মানুষ বদলায়। খাওয়া নিয়ে বায়নাক্কা আমার আগে ছিল না। টেবিলভরা খাবার দেখতে আমার ভালো লাগে। 
স্মৃতির আলপনায় আঁকা



 
বরিশালে আমাদের বাড়িটা খুব বৈচিত্র্যময় ছিল সব সময়। বিশাল বড় ফ্যামিলি আমাদের, আগেই বলেছি। এতটাই বড় যে চারটা ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। অনেক গাছগাছালি, ফলফলাদির গাছ, ঘন সবুজ বন-জঙ্গল, বাঁশঝাড়। রাতে শেয়াল ডাকে, জোনাকি পোকারা টিপটিপ আলো ফেলে, নিঝুম দুপরে যখন বাড়ির মহিলারা ভাতঘুম দেয়, তখন ঝিঁঝি পোকারা একটানা ডেকে যায়, ঘুঘুর মন কেমন করা ডাক শোনা যায়। পুকুর আছে দশ বারোটা, তাতে ভরভরন্ত পানি আর মাছেরা সাঁতার কাটে। অনেক মানুষ বাড়িতে। গোনাগুনতি নেই। আমিও তার মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকি। জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই একলা, কালোজাম কুড়াই, ঢেকির শাক খুঁজি। কাটা ঘুড়ির পেছনে দৌড়াই। নানা অনুষ্ঠান হতো আমাদের বাড়িকে কেন্দ্র করে। আমরা কয়েকজন নেতৃত্ব দিতাম। আমার বড়রা বার্ষিক নাটক করতেন মঞ্চ করে। সেটা ছিল একটা উৎসবের মতো। শহরজুড়ে লোকজন ছুটে আসত নাটক দেখতে। আমরা রাতের পর রাত রিহার্সাল দেখতাম। মল্লিকবাড়ির পুল ছিল বিখ্যাত। শহরের যেকোনো প্রান্ত থেকে রিকশাওয়ালাকে বললেই নিয়ে আসত। নাটক ছাড়াও আমরা ফুটবল, হাডুডু, হকি টুর্নামেন্টের আয়োজন করতাম। শীতের বিকেলে আমাদের মাঠে নেট টাঙিয়ে ভলিবল খেলা হতো এবং রাতে লাইট জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা করতাম। ইকবাল পাঠাগার অ্যান্ড ক্লাব ছিল আমাদের। রেজিস্টার্ড ক্লাব। ক্লাবের উদ্যোগেই এসব করতাম আমরা। এলাকার সব বয়সী শিশু-কিশোরদের এনগেজ রাখতাম খেলাধুলায়। ক্যারম প্রতিযোগিতা হতো, বইপড়ার প্রতিযোগিতা করতাম। বার্ষিক নৌকাবাইচ, সাঁতার, ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা পর্যন্ত হতো আমাদের পরিবারের উদ্যোগে। যাত্রাপালা হতো। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসত যাত্রাপালা দেখতে। অনেক বড় বড় জামগাছ ছিল আমাদের বাড়িতে। অত্র অঞ্চলের লোকজন জাম পেড়ে নিয়ে যেত। ছিল লিচু, কুল, আমলকী, জলপাই, কামরাঙা, ডেউয়া, গাব, জাম্বুরা, সফেদা, নইলসহ নানা ফলের গাছ। আম-কাঁঠাল তো ছিলই।

এখন সেসব আর নেই তেমন। মানুষগুলোই শুধু আছে কিন্তু সেই সুন্দর দিনগুলো আর নেই। এখন সবাই বৈষয়িক। টাকা-পয়সা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত সবাই। মানসিক বিকাশের কোনো সুযোগ আর নেই। নেতৃত্বের অভাবে সব বন্ধ হয়ে গেছে। খালে-বিলে ঝাঁপ দেওয়া নেই, পুলের গোড়ায় ছোট্ট টং রেস্টুরেন্টে সকালে পরোটা আর ভাজি খাওয়া নেই, দুপুরে ডোবাতেলে ভাজা গুলগুল্লা খাওয়া নেই। সেই জামগাছ নেই। পুকুরে সাঁতার কাটা নেই, শেওলা জমে গেছে পুকুরে। খালগুলো মরে গেছে। সেই জোয়ারের ঘোলা পানির স্রোত নেই, খেলার মাঠে কেউ খেলতে নামে না, পাঠাগার বন্ধ হয়ে গেছে কবেই। এখন কেউ চিঠিও লেখে না। পত্রমিতালি নেই। ডাকপিয়নের সাইকেলের ঘণ্টি বাজিয়ে চিঠি নিয়ে আসা নেই। নাটক নেই, ভলিবল খেলা নেই, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা নেই, যাত্রাপালা নেই, নৌকাবাইচ নেই। কারও হাতে বই নেই কিন্তু সবার হাতে আছে মোবাইল। এসবের মধ্যেই আমি বেড়ে উঠেছিলাম। আমার শৈশব আর কৈশোর কেটেছিল। বরিশালের অপরূপ নৈসর্গ, সবুজ প্রকৃতির মধ্যে আমার বেড়ে ওঠা। আমি রাস্তার ছেলেদের সঙ্গে চারা খেলতাম, মার্বেল খেলতাম, স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতাম, গাছে চড়তাম, সাইকেল চালিয়ে শহর দাপরে বেড়াতাম। মেডিক্যাল কলেজ কলোনিতে ডাক্তারদের সুন্দরী কন্যাদের দেখতে যেতাম।

আমি ছিলাম প্রথাবিরোধী এক কিশোর। আমাদের পরিবারটি ছিল একটু সামন্তবাদী ধারার। আমি ওসবের তোয়াক্কা করতাম না। তাই একটু বড় হয়ে যখন আমার তেরো-চৌদ্দ বছর বয়স, আমি আকস্মিক দলছুট হয়ে গিয়েছিলাম। প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য গড়ে তুললাম। গাছেদের সঙ্গে, পোকামাকড়ের সঙ্গে, কীটপতঙ্গের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হলো। আমার ভেতরে এক অন্য আমির আবির্ভাব ঘটেছিল। আমার মা, আমার খেলার সাথিরা অবাক হয়েছিল। তখন আমি বইয়ের জগতে নিজেকে খুঁজতে শুরু করি। সেই খোঁজা আজও শেষ হয়নি। স্বপ্ন না থাকলে বাঁচব কীভাবে! আমার তো স্বপ্ন ছাড়া কিছু নেই। প্রকৃত স্বপ্নবাজ যদি কেউ থাকে, সেটা হচ্ছি আমি। আমি স্বপ্ন দেখি, কারণ স্বপ্ন দেখতে পয়সা লাগে না, কারও অনুমতি লাগে না, কেউ জানতেও পারে না। আমি একলা একলা স্বপ্ন দেখি। শিশুকাল থেকেই আমি স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছি। আমার যখন কিছুই ছিল না, তখন স্বপ্ন আমার সঙ্গী ছিল। স্বপ্ন আমাকে উদ্দীপ্ত রাখত, স্বপ্ন আমাকে প্রেরণা জোগাত, স্বপ্ন আমাকে বাঁচতে শেখাত। কিন্তু কোভিড আসায় স্বপ্নগুলো কেমন লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। কিন্তু তার পরও কি আমি স্বপ্ন দেখি না! দেখি। স্বপ্ন দেখি, একদিন পৃথিবী আবার আগের মতো হবে। আবার তুমুল আড্ডা হবে, বেড়ানো হবে, পরস্পরের মুখ দেখতে পাব, বুকের স্পন্দন শুনতে পাব, গায়ের ঘ্রাণ পাব, ভ্যালেন্টাইন পালন করব, বৈশাখ হবে, একুশের শীতের রাতে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাব।

খাবারদাবার নিয়ে আমার ছোটবেলায় তেমন সমস্যা না হলেও বড় হয়ে এটা হয়েছে। এটা খেতে চাই না, ওটা খেতে চাই নাÑএ রকম ব্যাপার। অনেকে আছে, যা পায় তা-ই হাপুসহুপুস খেয়ে ফেলে। খেতে কেমন লাগল, মসলা ঠিক হয়েছে কি না, ঝাল ঠিক আছে কি না, তেলের পরিমাণ সঠিক ছিল কি না, এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল নাকি ভেজিটেবল অয়েলÑএসব নিয়ে ভাবে না। দুনিয়াতে তারাই সুখী, যারা সব খেতে পারে। মানুষ তো খাওয়ার জন্য পৃথিবীতে আসেনি, বাঁচার জন্য খেতে হয়, তাই মানুষ খায়। খাওয়া নিয়ে পেরেশানি আমার আগে ছিল না। আজকাল অনেক খুঁত ধরি আমি। নিজে কিছু করতে পারি না কিন্তু খুঁত ধরতে পারি। মনে আছে, তখন মাত্র বিয়ে করেছি। সংসার শুরু হয়েছে। জেসমিন রাঁধতে চেষ্টা করছে। কঠিন চেষ্টা। দুটো ঘটনা বলি। রান্নার গল্প। তখনো সংসার গুছিয়ে উঠতে পারিনি। আর্থিক টানাপোড়েন দূর হয়নি। আমার জন্য তা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু জেসমিনের জন্য ছিল কঠিন পরীক্ষা। আমার সঙ্গে সংসার করার পরীক্ষা। আমি হল-জীবন ছেড়ে সংসার-জীবনে প্রমোশন পেয়েছি। হল-জীবনে আমি অনেক কষ্ট করেছি খাওয়া নিয়ে। তাই খাওয়া নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। কোনো কিছু গায়ে মাখি না। কিন্তু জেসমিন বাবা-মায়ের নিশ্চিন্ত আশ্রয় থেকে এসেছে মাত্র। আমরা থাকি বনানীতে। ছায়াঘেরা সুন্দর একটা বাসা। প্রায় ফ্রিতে থাকি বলতে গেলে। চারদিকে গাছগাছালি। অনেক ফল, ফুল। পাখিরা কিচিরমিচির করে দিনভর। অনেক খ্যাতিমান সাংবাদিক তখন এ বাসায় এসেছেন। সেটা ১৯৯০ সাল। আমি বাজার করে নিয়ে এলাম। টিবি গেট বাজার থেকে চিংড়ি মাছ আর টিঅ্যান্ডটি এলাকা থেকে কলমি শাক কিনলাম। সস্তার জিনিস। জেসমিন রান্না করল। বেশ ঘ্রাণ ছুটছে। খেতে বসেছি। জেসমিন অধীর আগ্রহ নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন হয়েছে! আমি মুখে খাবার নিয়ে দুই আঙুল তুলে বললাম অসাধারণ! সেদিন অবশ্য জেসমিন তরকারিতে লবণ দিতে ভুলে গিয়েছিল, তাও খারাপ লাগেনি! তারপর প্রথম পোলাও রান্না। পোলাও রান্নার মনে হয় কিছু কায়দাকানুন আছে। প্রথম দিন পোলাও একেবারে ভর্তা হয়ে গিয়েছিল! সেই ভর্তা পোলাও খেয়ে নিয়েছি মজা করে। চিবুতে হয়নি। এখন জেসমিন একসঙ্গে তিরিশ জনের রান্না করতে পারে, অনেক পদের আইটেম করতে পারে।

মানুষের অনেক অভ্যাসই বদলে যায়। কোনো একটা জায়গায় কিছুই স্থির থাকে না। পরিবেশ, অবস্থান মানুষকে বদলে দেয়। পরিস্থিতির কারণেও মানুষ বদলায়। খাওয়া নিয়ে বায়নাক্কা আমার আগে ছিল না। টেবিলভরা খাবার দেখতে আমার ভালো লাগে। কিন্তু সব খাবার আমি খেতে পারি না। অরিত্রি বলেছে, বাবা অনেক খাবার অপচয় করে। কানাডিয়ান প্রতি হাউসহোল্ড পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি খাবার অপচয় করে। যেদিন থেকে খাওয়া নিয়ে রেস্ট্রিকশন আরোপ শুরু হলো, সেদিন থেকে ঝামেলার শুরু। মেপে মেপে খাওয়া, ক্যালরি মেপে খাওয়ার কথা আমরা জানতাম না। পেটভরে খেতে পারলেই খুশি ছিলাম। হল-জীবনে তো অনেক দিন না খেয়েও রাতে ঘুমিয়ে থেকেছি। কারও বাসায় গেলে হাভাতের মতো হাঁড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মনে মনে ভাবতাম, কম পড়বে না তো আমার! পেট না ভরলেও চাইতে লজ্জা পেতাম। আধাপেটে খাওয়া শেষ করেছি। পেট ভরেছে কি না বুঝতাম না। এখনো আমার এমন হয়। এখনো একটু রাত জাগলেই খিদা পেয়ে যায়। মা বলতেন, আমার নাকি চোখের খিদা। জেসমিনও তা-ই বলে।

আমি পত্রমিতালি করতাম। আমার নামে প্রচুর চিঠি আসত। জসিম মল্লিক, মল্লিক বাড়ি, বরিশালÑএই ঠিকানায় চিঠি চলে আসত। এমন হয়েছে, শুধু আমার নাম আর বরিশাল হলেও চিঠি চলে আসত। ‘মল্লিক বাড়ির পুল’ ছিল খুব বিখ্যাত। এই পুলের ওপর দিয়ে আমরা কত ঝাঁপাঝাঁপি করেছি পানিতে। পুলের গোড়ায় ছাপরা দেওয়া ছোট্ট টং হোটেল ছিল একটা। সকালের পরোটা আর ভাজির ঘ্রাণ এখনো নাকে লেগে আছে। দুপুরের দিকে গুলগুল্লা খেতাম, তারপর ঝাঁপ দিতাম পানিতে। তখন খাল ছিল ভরভরন্ত। জোয়ারের সময় ঘোলা জল আসত। মালবোঝাই বড় বড় নৌকা আসত। কীর্তনখোলার সঙ্গে ডাইরেক্ট সংযোগ ছিল। এখনো আছে সেই খাল কিন্তু সেই যৌবন আর নেই। সরু একটা পানির স্রোত বয়ে যায় শুধু। আমি যেখানে আমার লাইব্রেরি করব বলে স্বপ্ন দেখছিলাম, সেটা এই খালের পাশেই পড়েছে। আমাদের পুরো বাড়িটায় প্রচুর গাছগাছালি, ঘন জঙ্গল, পাখির কলকাকলি, নির্জন ভাতঘুম, দুপুরে ঘুঘুর ডাক, রাতে জোনাকির মিটিমিটি আলো, এমনকি দুর্লভ বাদুড়েরাও ঝুলে থাকে গাছের ডালে। আমাদের মল্লিক ফ্যামিলিতে অনেক শরিক বলে চারটা ভাগে ভাগ হয়েছে বাড়ি। এখন তো আমি বাড়ি গেলে নতুন জেনারেশন যারা তাদের চিনতেই পারি না। আমার সামনে দিয়েই হেঁটে যাচ্ছে, আমি চিনি না। আমাকেও চেনে না। অথচ একসময় আমরা পুরো তল্লাটের ছেলেমেয়েদের নিয়ে নানা কর্মকাণ্ড করতাম। আমাদের একটা লাইব্রেরি ছিল পাকিস্তান আমল থেকেই। রেজিস্টার্ড লাইব্রেরি। নাম ছিল ইকবাল পাঠাগার অ্যান্ড ক্লাব। সেই পাঠাগারে বই ছিল, খেলাধুলার সরঞ্জাম ছিল। এই ক্লাবের উদ্যোগে বার্ষিক ফুটবল প্রতিযোগিতা, হাডুডু, নাটক, ঘোড়ার দৌড়, নৌকাবাইচ, সাঁতার এবং ছোটদের নিয়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো। আমাদের বাড়ির হান্নান, নিজাম, মিজানুর, হাসিব, ইউনুস, মনু এদের সবাইকে নিয়ে এই আয়োজন করতাম। আমি আর হান্নান এর নেতৃত্বে ছিলাম। বাড়ির মেয়েরাও আমাদের পাশে ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আশির দশকে আমি ঢাকা চলে আসার পর সব শেষ হয়ে গেছে। সেই খেলাধুলাও নেই, ক্লাবেরও অস্তিত্ব নেই। শুধু খেলার মাঠ পরিত্যক্ত পড়ে আছে। খেলার মাঠগুলো আমাদের নিজস্ব সম্পত্তি। আমাদের বাড়িতে অনেকগুলো পুকুর ছিল। সেই সব পুকুরে মাছ ছিল, গভীরতা ছিল। আমরা সাঁতার প্রতিযোগিতা করতাম, মাছ ধরতাম। জাল ফেলা হতো। সেই জাল ভরে উঠত শোল, গজার, শিং, বাইলা, মেনি, পুঁটি মাছ। বড়শি ফেলতাম। পুঁটি, টেংরা, মেনি মাছ উঠত। স্কুল থেকে এসেই পানিতে ঝাঁপ দিতাম। চোখ লাল না হলে উঠতাম না। মাঝে মাঝে মা এসে পানি থেকে টেনে তুলত। সাবান দিতাম না বলে গায়ের চামড়া সাদা হয়ে থাকত। কাদায় মাখামাখি থাকতাম। কাপড় ধোয়ার ৫৭০ সাবান পেলেই মহাখুশি। পেস্ট, ব্রাশ ছিল না বলে দাঁত ব্রাশ করতে ভুলে যেতাম। ময়লা, নোংরা একদল রাস্তার ছেলের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম। ঘুড়ি ওড়াতাম, মার্বেল খেলতাম, চারা খেলতাম, সাইকেল দাবড়ে বেড়াতাম। আবার বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বই এনেও পড়তাম। আমার দুরন্তপনার জন্য অনেকে আমাকে দেখতে পারত না। আমাকে বাতিলের খাতায় রেখেছিল। বলাবলি করত, ছেমড়া উচ্ছন্নে গ্যাছে। ফলফলাদির জন্য আমাদের বাড়ি বিখ্যাত ছিল। আম, জাম, লিচু, গাব, কাঁঠাল, আনারস, তাল, বেল, আমলকী, ডেউয়া, জলপাই, চালতা, তেঁতুল, কাউ, পায়লা, জাম্বুরা, পেয়ারা, বরই, আতাফল, জামরুল ছিল। কী ছিল না! সবই ছিল। অনেকগুলো বিশালাকৃতির জামগাছ ছিল। সেই গাছে রসালো জাম ধরত। দু-চারটা খেলেই পেট ভরে যেত। সকালে ঘুম ভেঙে দেখতাম গাছের নিচে জাম পড়ে আছে। মাটি দেখা যায় না, শুধু জাম। আর এত সুস্বাদু ছিল। এত জাম খাওয়ার মানুষ ছিল না। শহরের মানুষেরা এসে জাম পেড়ে নিয়ে যেত ব্যাগ ভর্তি করে। আমাদের কিছু দিয়ে যেত। আমরা সেসব লবণ, তেল, শুকনো মরিচ দিয়ে মেখে ঝাঁকিয়ে খেতাম। এখন সেই গাছও নেই, ফলও নেই। কেমন করে সব নিধন হয়ে গেল। আর সেসব দিন ফিরবে না কখনো। লোভ আর নগরায়ণের নামে সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। (চলবে)
 

কমেন্ট বক্স