নারীর ভোটাধিকারের দাবিতে লড়াই। আর্জেন্টিাইন নারীদের মধ্যে যারা প্রথম গাড়ি চালিয়েছিল তাদের অন্যতম। এমনকি পথচারীদের জন্য সংরক্ষিত ফ্লোরিডা স্ট্রিট, আইন ভেঙে সেখানেও গাড়ি চালানোর মতো দুঃসাহস দেখিয়েছে। প্রথম মাথার চুল ছেঁটে ছোট করে আর ব্যাংকের চেক নিজের নামে সই করেছিলেন যা অনেকের চোখে খামখেয়ালি আর কাণ্ডজ্ঞানহীন ছিল। অভিজাত শ্রেণির লোকেরা তার আচরণে বিচলিত হলেও তিনি তার লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল।
সৎসাহসী, প্রচলিত প্রথাবিরোধ মানবতা আর সভ্যতা বিনির্মাণে দুর্দমনীয় অবিচল এক জন্মদাত্রী। রক্ষণশীল ক্যাথলিক কলেজে পড়াশোনা করেও সদাসতর্ক দৃষ্টি অশুভ বিনাশের দিকে। নাৎসি ও ফ্যাসিবাদের ঘোরতর শত্রু। আদর্শবান আর মানবিক নানা গুণের অধিকারী। স্বাধীনচেতা আর পুরনো রীতিনীতি একদম পরোয়া করেনা। প্রচণ্ড আগ্রহ তার রাজনীতির ব্যাপারে। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম নিজস্বতা, সাহস এবং মৌলিক মতামত দেয়া তিনি কখনো গির্জায় যাননি।
অনেকের মতে খামখেয়ালি ও কাণ্ডজ্ঞানহীন বিজ্ঞ বিরলগুণের অধিকারী এমন এক মা সেলিয়ার গর্ভ থেকে সময়ের এক মাস আগেই জন্মগ্রহণ করেন অতুলনীয় অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী এক আত্মপ্রত্যয়ী ও মানবিক গুণের অধিকারী সন্তান ‘চে’। ১৯২৮ সালের ১৪ জুন রোমরিও শহরে অর্নেস্তো গুয়েভারার জন্ম। ‘তেতে’ মা-বাবার দেয়া নাম। চার বছর বয়সে তেতো পড়াশোনা শুরু করেন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ছিল মনোযোগী পড়ুয়া এই আর্নেস্তো গুয়েভারা তেতোই আমাদের চে। চে মানে বিপ্লব, চে মানে খুশি, চে মানে না, চে মানে তারুণ্য, চে মানে কবিতা, চে মানে বিপ্লবী। বিপ্লবী চে একাধারে সহজ, বুদ্ধিদীপ্ত, নিজ আদর্শের প্রতি নিবেদিত, সুস্পবাদি সুষ্ঠু মানবিকতা দৈহিক গঠনে নিষ্ঠাবান এবং সাম্য প্রতিষ্ঠার উদ্দীপ্ত এক মানসিক ধারালো অস্ত্র। সেই সমনের মানবিক বিপ্লব গড়ার, সাম্য প্রতিষ্ঠার উদ্দীপ্ত এক খোলা তলোয়ার। নিষ্ঠা, আদর্শ-প্রচলিত প্রথাবিরোধী এক মা সেলিয়ার ছেলে চে। আত্মপ্রত্যায়ী ও আশাবাদী চে সাধারণ মেধাবী ও পরোপোকারী। এই চে ১৯৪৬-১৯৫৬ সাল পর্যন্ত বুয়েন্স আয়ার্সের ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলের ছাত্র এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে ডাক্তারি ডিগ্রি অর্জন করেন।
সৎ, সাহসী চে’র বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল- সে কখনো নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকারে ভীত ছিল না। অন্যের কঠোর সমালোচনা করলেও নিজেকে ছেড়ে কথা বলত না। কঠিন আত্মসমালোচক ছিল। ছিলেন নিজের প্রতি নির্দয়। চে’র এসব আত্মপ্রত্যয়ী স্বভাবের গুণে ছিল তার মাত্রাতিরিক্ত সারল্য এবং মিথ্যাচার, প্রচলিত রীতিনীতি ও কোটি বুর্জোয়া নৈতিকতার প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা। চে প্রায়ই বলত যে ‘একজন বিপ্লবী প্রশাসককে অবশ্যই সাধুসুলভ জীবনযাপন করতে হবে। তার কথায় যুক্তি ছিল- আমাদের বেশির ভাগ শাসক, বিশেষ করে বেতনওয়ালারা, বিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়, সরকারি টাকা তছরুপ করে, ঘুষ নেয়, বিলাসবহুল ভিলায় মদ ও লাম্পট্যে নিজেদের ভাসিয়ে দেয়।’
চে’র স্বপক্ষে একথা বলতে হয় যে তিনি আর্থিক প্রণোদনার চেয়ে নৈতিক প্রণোদনাকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। ব্যক্তিগতভাবে আমরা সবাই মূল্যহীন, একমাত্র বিপ্লবই গুরুত্বপূর্ণ চে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে কীভাবে উৎসাহ দেওয়া সম্ভব? একদিকে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও পরিকল্পনার উন্নতি এবং ছোট ছোট আলোচনার মাধ্যমে মতবিনিময় এবং বিশেষ স্কুলের ব্যবস্থা করে শ্রমিকদের দক্ষতার মান বাড়ানো।
চে সবসময় মনে করতেন বেতন বৃদ্ধি, সম্মান প্রদান, বিশেষ পুরস্কার কিংবা পদবি বণ্টন নেতাকর্মীদের কাছে থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। কবি জো সাতি এবং জেনারেল আন্তোনিও মাসিত্তর মতো দেশপ্রেমীদের আদর্শ অনুসরণে আত্মত্যাগ করেছেন।
ছোটবেলা থেকে কবিতা ভালোবাসতেন। কবিতা লিখতেন চে। কবিতা ও শিল্পকলার মতো উচ্চমার্গীয় বিষয়ের সাথে সাথে গণিত ও বিজ্ঞানের প্রতি তার ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। একজন কবি বিজ্ঞানী আর্নেস্ত গুয়েভারা চে মনে করেনÑ শুধু ভাবাবেগ বিপ্লবের জন্ম দেয় না। শোষণহীন সমাজব্যবস্থা এবং ন্যায় বিচারের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক আকাক্সক্ষাই সঠিক বিপ্লবের জন্ম দেয়।
বোদলেয়ার, ভার্লেন, গাসিয়া, লোরকা, আন্তানিও মাচাদোর কবিতার সঙ্গে যেমন তার পরিচয় ছিল, তেমনি পাবলো নেরুদার কবিতা ভালোবাসাতো চে। অনেক কবিতা মুখস্ত ছিল তার। নিজেকে সে একজন অসফল কবি হিসেবে ঘোষণা করেছিল। তার লেখা রেইনডিলার বইটি সবসময় তার কাছে থাকত।
জীবনের কষ্টকর সমাপ্তির আগ পর্যন্ত সে কখনো কবিতা ত্যাগ করে নাই। তার ব্যাকপ্যাকে পাওয়া সেই বিখ্যাত বলিভিয়ান ডায়েরিই নয়Ñ ওর প্রিয় কবিতার উদ্ধৃতিসহ একটা নোটবুক পাওয়া প্রমাণ করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কবিতা তার সঙ্গী ছিল।
পাবলো নেরুদার প্রেরণাদায়ক পঙ্ক্তিগুলো প্রায়ই আবৃত্তি করত চে : “তখন তাই আমার সামনে উদ্ভাসিত হলো করণীয়ধাস্থ যা পেরিয়ে আমি অতিক্রম করলাম গহিন অরণ্যে লুকিয়ে থাকা রহস্যময় বাঁক/এসবই করলাম, তোমার দেখা পাওয়ার জন্য মাচুপিবু।
হে পর্বত- জননী, তুমি সেই সারষ যে ভেসে বেড়াও বার্তা নিয়ে। তোমার উপরে উঠে আসা ধাপগুলোও উদয় হয়ে মানবসভ্যতার গহিন নিস্তব্ধতাকেও হারিয়ে তোমার এই সুবিশাল প্রান্তের।”
চে গুয়েভারা একজন ডাক্তার হিসেবে সুখের জীবন বেছে নিতে পারতেন; কিন্তু তিনি মানব মুক্তির সংগ্রাম করে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। আর্জেন্টিনায় জন্ম নিয়ে কিউবার বিপ্লব সাধনে নেতৃত্ব দেন ১৯৫৯ সালে। সেখানে বিপ্লবী বাহিনীর সামরিক অভিযানে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট বলিভিয়া সামরিক সরকারের রেঞ্জারদের হাতে এই মহান বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারা ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর নিহত হন। হিগুয়েরা গ্রামে রেঞ্জাররা হত্যা করে তাকে।
এই অক্টোবরে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি আত্মত্যাগী এই মহান বিপ্লবী একজন দায়িত্ববান সচেতন ও মানবমুক্তির দূত চে গুয়েভারাকে।
কবি জার্নাল সিলভার কবিতা যা চে’র কথাই স্মরণ করায়- “তোমার রয়েছে অজেয় ক্ষমতা, মানুষের হাত থেকে যে প্রাণ শক্তি প্রবাহিত হয়,
তুমিতো তাই।
আমি সুখেই থাকি আর দুঃখেই জর্জরিত হই
সারাক্ষণ তুমি আছ আমার অন্তরে। কবিতা ও বিপ্লব মানবিক বিশ্ব গড়ার প্রেরণা হোকÑ এই প্রত্যয় লালনে।
বিপ্লবী চে গুয়েভারার প্রয়াণ দিবসে
“কবিতা ও বিপ্লবের চে গুয়েভারা” স্মরণে