Thikana News
০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

শেষ মুহূর্ত

শেষ মুহূর্ত
‘হৃদয়ের স্পন্দনই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু এই স্পন্দন কোনো ঘোষণা না দিয়েই থেমে যেতে পারে। এ কথাটি আমরা বারবার ভুলে যাই। গতকাল দিনটি শুরু করার সময় কি আমি জানতাম যে আমার সঙ্গে কী হতে যাচ্ছে’-কথাগুলো বলেছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল। চলতি বছর মার্চ মাসে প্রিমিয়ার লিগ খেলার সময় তার আকস্মিক হার্ট অ্যাটাক ঘটে। হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ছাড়া পাওয়ার পর এক চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।

কিন্তু এমন যদি হয়, কারও হৃদয়ের স্পন্দন চিরতরে থেমে যায় আর সেই থেমে যাওয়ার আগমুহূর্তে সেই মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটি কী ধরনের অনুভূতি বা উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে যায়, তা সম্পর্কে আমরা একটু হলেও জানতে পারি। এটা সম্ভব হয়েছিল একজন রোগীর ব্রেন স্ক্যানের মাধ্যমে। ঘটনাটি ঘটে কানাডায়। 

মৃত্যু হলো এমন একটা বিষয়, যেটা সম্পর্কে অনেক কিছুই আমাদের অজানা। আমরা জানি, কারও মৃত্যু হলে তার দেহ বা শরীরের কী পরিণতি ঘটে। কিন্তু মৃত্যুর আগমুহূর্তে মন বা মানসিক অবস্থা কী কী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়, সেটা সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা আমাদের নেই।

মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা মানুষেরা যেসব অভিজ্ঞতার কথা বলে, তাকে বলা হয় নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স। বিভিন্ন সময় তারা যখন ইন্টারভিউ দেয়, তখন অনেক ক্ষেত্রেই তারা একটা জোরালো সাদা আলো দেখার কথা বলে। অনেকে স্মরণ করে, তারা একধরনের প্রশান্তি অনুভব করেছিল অথবা অনেকে কোনো কিছুই মনে করতে পারে না।

কিন্তু একটা ব্যাপার সমগ্র দুনিয়ার মানুষ, তা সে যেকোনো জাতি, ধর্ম, বর্ণের হোক না কেন, নির্দ্বিধায় বলে থাকে, সে সময় তাদের চোখের সামনে তাদের পুরো জীবনের একঝলক দেখতে পায়। অন্য ভাষায় আমরা যাকে বলতে পারি, জীবনের সারাংশ অথবা সংক্ষিপ্ত পুনরাবৃত্তি। চিকিৎসক বা গবেষকেরা মৃত্যুর দরজা থেকে ফেরত আসা বিভিন্ন মানুষের এই সংক্ষিপ্ত জীবনী দেখার কথা অনুধাবন করলেও এত দিন অবধি প্রমাণ করতে পারেননি।

২০২২ সালে প্রকাশিত ফ্রন্টিয়ার ম্যাগাজিনের নিউরোবিজ্ঞান শাখায় একটি স্টাডি রিপোর্ট ছাপা হয়, যা কিনা জনমনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। রিপোর্টটিতে মৃত্যুর ঠিক আগ এবং পরমুহূর্তে মানব মস্তিষ্কের স্ক্যানচিত্রের এক পরিষ্কার বিবরণ দেওয়া হয়, যেখানে জীবনের সংক্ষিপ্ত পুনরাবৃত্তি ঘটে যাওয়ার এক সুস্পষ্ট আভাস মেলে। 

অবাক ব্যাপার হলো, মৃত্যুর কথা মাথায় রেখে কিন্তু বিজ্ঞানীরা এই স্টাডি পরিচালনা করেননি। বরং ৮৭ বছর বয়সী একজন কানাডীয় অধিবাসীর এপিলেপ্সির কারণে একদল নিউরোবিজ্ঞানী রোগীটির ইইজি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছিলেন, যাতে তারা রোগীর খিঁচুনি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে পারেন। এই রেকর্ডিংয়ের সময় রোগীর হার্ট অ্যাটাক হয় বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।

যেহেতু আগের থেকে রোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে হাসপাতাল প্রশাসনকে অনুমতি দেওয়া ছিল, চিকিৎসা চলাকালীন কোনো কারণে রোগীর মৃত্যু হলে তারা কোনো ধরনের জীবনরক্ষাকারী ব্যবস্থা নেবে না, সেহেতু হার্ট অ্যাটাকের পরপরই রোগী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। কিন্তু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগমুহূর্তে রোগীর মাথার ভেতর কী কী ঘটে যায়, তার একটা পরিষ্কার চিত্র আকস্মিকভাবেই চিকিৎসকদের হাতে এসে পড়ে।

সর্বমোট ১৫ মিনিটের রেকর্ডিং সম্পন্ন হয়, যাতে মৃত্যুর আগমুহূর্তে, মৃত্যুচলাকালীন এবং মৃত্যুর ঠিক পরমুহূর্তের ব্রেনের চিত্র ধারণ করা হয়। রিপোর্টটির মতে, এটি দুনিয়ার প্রথম রেকর্ডিং, যা কিনা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি মস্তিষ্কের শেষ মুহূর্তের ছবি তুলে ধরতে সক্ষম হয়। তবে পুরো ১৫ মিনিটের মধ্যে বিশেষ নজর কাড়ে ৩০ সেকেন্ডের চিত্র, যা কিনা রোগীর হার্ট বন্ধ হওয়ার একটু আগে এবং একটু পরে ধারণ করা হয়।

রিসার্চ গ্রুপের প্রধান ড. আজমাল যেমার ফ্রন্টিয়ার ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি রিপোর্টে দেখতে পান, রোগীর মস্তিষ্কের নিউরাল অক্সিলেশন বা স্নায়ুস্পন্দন বিদায়ের আগ ও পরমুহূর্তে কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। রোগীর মস্তিষ্কের ভেতর যেসব তরঙ্গ ওঠানামা করে, তার মধ্যে তিনি গামা তরঙ্গের একটি উচ্চমাত্রার ফ্রিকোয়েন্সি দেখতে পান। এই তরঙ্গস্ফীতি ঘটে মস্তিষ্কের স্মৃতিভান্ডার নামক প্রকোষ্ঠটিতে, যা কিনা জীবিত মানুষের ক্ষেত্রে স্মৃতি রোমন্থন, স্বপ্নচারণ এবং ধ্যান নিবেশ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। গামা তরঙ্গের সঙ্গে মস্তিষ্কের অন্যান্য তরঙ্গ আলফা, বিটা, ডেল্টা, থেটা একত্রিত হয়ে এমন একটি প্যাটার্ন সৃষ্টি করে, যা সাধারণত দেখতে পাওয়া যায়, যখন কোনো মানুষ গভীরভাবে কিছু মনে করার চেষ্টা করে বা স্বপ্ন দেখে।

ড. যেমারের মতে, এই অভাবনীয় রিপোর্ট থেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে, বিদায়ী মুহূর্তে রোগীর ব্রেন সারা জীবনের এক সংক্ষিপ্ত চিত্র তাকে দেখানোর চেষ্টা করছিল বা তার জীবনের বিশেষ মুহূর্তগুলো শেষবারের মতো মনে করিয়ে দিতে চেষ্টা করছিল।
আরও একটি আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের মস্তিষ্কের ওপর গবেষণা চালিয়েও একই রিপোর্ট পেয়েছেন, যেখানে গামা তরঙ্গের উত্থান দেখতে পাওয়া গিয়েছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন, সকল ম্যামাল বা স্তন্যপায়ী প্রাণীর জীবনের শেষ মুহূর্তে তাদের সারা জীবনের একঝলক অনুভব করার সুযোগ মেলে।

শুধু গামা তরঙ্গ নয়, মানব মস্তিষ্কে আরও একটি জিনিসের উপস্থিতি মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের অভিজ্ঞতার কথা ব্যাখ্যা করে। ডিএমটি বা ডাই মিথাইল ট্রিপ্টামিন নামক হরমোনের নিঃসরণ। এই নেশাকারক দিয়ে বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে গবেষণা চালিয়েছেন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা এটি পেয়ে একধরনের হ্যালুসিনেশনের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। শূন্যে ভাসার অনুভূতি, হালকা বোধ করা, কোনো সময় বা স্থানের পরিসীমা অনুভব না করা, জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা বা স্মৃতি পরিষ্কার চোখের সামনে দেখতে পাওয়া এমন ধরনের কিছু অপার্থিব অনুভূতি। 
আর ঠিক এসব অনুভূতির কথা বারবার বলেছে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফেরত আসা মানুষেরা। তারা প্রায়শই মনে করতে পেরেছে অপরিসীম আনন্দ, সুখ, শান্তি ও ভালোবাসার অনুভূতির কথা। সেই সঙ্গে মনে করেছে তাদের পুরো জীবনের এক প্যানোরামা দৃশ্য দেখার কথা।
এত কিছুর প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও মৃত্যু নামক বিষয়টির পুরো ব্যাখ্যা নিশ্চিত করে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ এই পৃথিবীতে একেকজন মানুষের মৃত্যু একেকভাবে ঘটে। সবাই চলে যাওয়ার আগে একই রকমের কল্পদৃশ্য বা সংক্ষিপ্ত জীবনী দেখতে পায় কি না, তা হলফ করে বলা মুশকিল।

খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছেন ড. যেমার। একজনের মৃত্যু নিঃসন্দেহে তার আপনজন ও ফেলে যাওয়া মানুষদের জন্য কষ্টকর ও হৃদয়বিদারক। জীবনের কোনো কিছুই একজন মানুষের শূন্যতা পূরণ করতে পারে না। তবে এটা ভেবে আপনজনেরা একটু হলেও শান্তি পেতে পারে যে, চলে যাওয়া মানুষটির শরীরের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার সময় তার মস্তিষ্ক তাকে শেষবারের মতো তার জীবনের একটি সুন্দর ফ্ল্যাশব্যাক দেখাতে সক্ষম হয়।

পরিশেষে একটা কথা বলতে চাই, আমরা এ জীবনে প্রতিনিয়ত ছুটে চলেছি। নানা স্তরের হাজারো ব্যস্ততা আমাদের সব সময় গ্রাস করছে। একটু থেমে ভাবার সময় পর্যন্ত নেই যে পৃথিবীটা খুব সুন্দর। পৃথিবীর বুকে ঘটে যাওয়া আমাদের জীবনের ঘটনার অনেকগুলোই স্মরণীয়, সবগুলো না হলেও। কিন্তু এগুলোর মর্ম বোঝার সময় বা ইচ্ছা আমাদের হয় না। হয় না সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জানানোর সময়, যিনি আমাদের জীবনের প্রকৃত মালিক।

তাই হয়তো জীবনপ্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে, প্রকৃতি কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে আমাদের সামনে হাজির করে দেয় সারা জীবনে আমরা কী পেয়েছিলাম। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই আমরা দেখতে পাই আমাদের জীবনের গল্প। যে ভুবনে কত শত দিনরাত্রি পার করেছি, এরপর সে ভুবনের সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে চলে যাই আরেক ভুবনে।
লেখক : ব্লগার ও কলামিস্ট, টেক্সাস।
 

কমেন্ট বক্স