গোয়েন্দা পরিভাষায় গুপ্তচরবৃত্তি (Espionage), নাশকতা (Sabotage) ও অন্তর্ঘাত (Subversion) বলে তিনটি শব্দ প্রচলিত আছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রায় সকল কার্যক্রম এসব তৎপরতা প্রতিরোধে কেন্দ্রীভূত থাকে। এই তিন ধরনের তৎপরতা দেশবিরোধী দেশি-বিদেশি ব্যক্তি বা চক্রের দ্বারা সংগঠিত হয়, যে সম্পর্কে প্রকাশে ও গোপনে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষেত্র বিশেষে নিজস্ব অভিযান পরিচালনা করে এসব কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও চক্রকে গ্রেফতার করে দেশ ও রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা পণ্ড করে দেয়া হয়।
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে দীর্ঘ আওয়ামী স্বৈরশাসনের অবসানের পর সে বছরের ৮ আগস্ট দেশ পরিচালনার জন্য ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়, যার মূল কাজই হলো অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি স্বচ্ছ নিরপেক্ষ নির্বাচন করে জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তন্তর করা।
এই অভীষ্ট লক্ষ্য সম্পন্নের জন্য সম্প্রতি ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমদিকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এরইমধ্যে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রার্থী নির্বাচনসহ সীমিত পরিসরে নির্বাচনী তৎপরতা শুরু করেছে, যা আগামী দু-এক মাস পর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর ব্যাপক গতি (Momentum)) পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিগত দেড় দশকের স্বৈরশাসনের সময়কালে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও দুর্নীতির কারণে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় দলটির পক্ষে দলীয়ভাবে আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব হবে না। তা ছাড়া দলের শীর্ষ থেকে সকল পর্যায়নের বহু নেতার বিরুদ্ধে সেসব অপরাধের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচার চলছে।
দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের বহু নেতা ভারতসহ বিভিন্ন দেশে গ্রেফতারি পরোয়ানা (Warrant of arrest)) মাথায় নিয়ে পলাতক আছেন। অনেকে আবার গ্রেফাতর ও জনরোষ থেকে বাঁচতে দেশে আত্মগোপনে রয়েছেন।
মিডিয়ায় প্রাপ্ত তথ্যমতে, একমাত্র শেখ হাসিনার বিরুদ্ধই হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ২২৭টি মামলা রয়েছে, যার কয়েকটির বিচার কার্যক্রম এরইমধ্যে শুরু হয়েছে। একটি মামলায় ট্রাইব্যুনাল সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিচারক, আইনজীবী ও অন্যান্য কর্মকর্তাকে ভবিষ্যতে চরম শাস্তি প্রদানের হুমকি প্রদানের কারণে তাকে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
উপরে বর্ণিত প্রেক্ষাপটে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে অংশগ্রহণ করতে পারছে না, যদিও দলের কেউ কেউ ভোল পাল্টে অন্য দলের হয়ে বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে রাজনৈতিক মহলে জল্পনা রয়েছে। দল হিসেবে নির্বাচনের সুযোগ না থাকায় নির্বাচনে জয়ী হয়ে দলের পক্ষে সরকার গঠনের সম্ভাবনা নেই।
দীর্ঘ স্বৈরশাসনে নানা অপকর্মে সিদ্ধহস্ত এবং দুর্নীতি ও বিভিন্ন অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িত হয়ে বহুদলীয় নেতা বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে যাওয়ায়, তারা দলের বর্তমান কোণঠাসা ও বিপর্যকর অবস্থা সহজে মেনে নেবেন- সেটা ভাবার অবকাশ নেই। এ কারণে নাশকতায় লিপ্ত হয়ে নির্বাচন বানচাল ও দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেশের রাজনীতিতে তাদের যে বিকল্প নেই, সেটা দেশবাসীকে দেখাতে তারা যে সর্বাত্মক অপচেষ্টা চালাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সাম্প্রতিককালে দলের কিছু কার্যক্রম ও বক্তব্যে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। মিডিয়ায় প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আওয়ামীপন্থী একজন অফিসার মেজর সাদিক ও তার স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিনের উদ্যোগে ৮ জুলাই ঢাকার বসুন্ধরা এলাকার একটি কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত আওয়ামী নেতাকর্মীদের এক সমাবেশে (৩০০/৪০০) আগামী নির্বাচন বানচাল করার পরিকল্পনার খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এই সমাবেশে অংশগ্রহণকারী কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তাছাড়া মেজর সাদিক ও তার স্ত্রীকেও পুলিশি হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এই ঘটনা থেকে সরকারের বিভিন্ন স্তরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা আওয়ামীপন্থী অনেক কর্মকাণ্ডও যে অনুরূপ ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত নেইÑ তা হলফ করে বলা যায় না।
সম্প্রতি শেখ হাসিনার সঙ্গে গাইবান্ধার জনৈক আওয়ামী লীগ নেতার কথপোকথনের একটি অডিও ক্লিপ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে প্রকাশ করা হয়, যেখানে শেখ হাসিনা তার ও তার দলের নেতাদের বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলোতে নিয়োজিত বিচারক, আইনজীবী অন্যান্য কর্মকর্তার তালিকা তৈরির পরামর্শ দেন, যাতে পরবর্তী সময়ে সুযোগ মতো তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া যায়। অডিও ক্লিপে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, তার বিরুদ্ধে ২২৭টি হত্যা মামলা রয়েছে, একটি হত্যা মামলার যে শাস্তি ২২৭টি হত্যা মামলার শান্তিও একই। সে কারণে তিনি সাজাভোগের পূর্বে অন্তত ২২৭ জনকে খতম করতে চান বলে জানান। তিনি এটাও বলেন, যেহেতু আওয়ামী নেতাদের বাড়িঘর পোড়ানো হয়েছে, সেজন্য তার বিরোধীদের বাড়িঘরও প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য উপায়ে পুড়িয়ে দিতে হবে।
উপরে বর্ণিত ঘটনা ও বক্তব্য থেকে আগামী নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে না হতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগ ও তার বিদেশি মুরব্বিদের চেষ্টার যে ত্রুটি থাকবে না, সেটা অনুমান করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এসব অপতৎপরতা সমূলে বিনষ্ট ও ব্যর্থ করে দিতে এখন থেকেই বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাকে বিশেষভাবে সক্রিয় ও তৎপর হতে হবে, যে উদ্দেশ্যে অন্যান্যের মধ্যে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণের বিষয়ে বিবেচনা করা যেতে পারে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।
ক. আওয়ামী সমর্থক চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তদের নির্বাচনের আগে গ্রেপ্তার ও তাদের কাছ থাকা বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার, ককটেল ও পটকা জাতীয় বোমা তৈরির আস্তানা ধ্বংস ও এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে, যাতে এ জাতীয় বিস্ফোরকের ব্যবহার করে প্যানিক সৃষ্টি করা সম্ভব না হয় এবং ভোটকেন্দ্রের আশপাশে ভোটার নন এমন তরুণদের অহেতুক জটলা করতে না দেওয়া।
খ. ঋণখেলাপিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ না দেয়া, যাতে তারা তাদের বিপুল অর্থবিত্ত ব্যবহার করে তাদের পোষ্য গুণ্ডা-মাস্তানদের দিয়ে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার ও ঝামেলা সৃষ্টি করতে না পারে।
গ. সন্ত্রাস বা সহিসতা হতে পারে, এমন সব স্পর্শকাতর ভোটকেন্দ্রে পর্যাপ্ত পুলিশ, সেনা ও বিজিবি সদস্য নিয়োগ ও সেসব এলাকার দুষ্কৃতকারীদের নির্বাচনের আগে সম্িন্বত অভিযান পরিচালনা করে গ্রেপ্তার করা।
ঘ. বিদেশি, বিশেষ করে ভারতীয় হাইকমিশনে নিয়োজিত গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নির্বাচনবিরোধী বক্তব্য ও তৎপরতা মনিটর করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ ইত্যাদি। নির্বাচনকালীন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ব্যবস্থাপনায় বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো পরিস্থিতি যাতে না হয়, সেদিকে সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে সর্বতোভাবে সজাগ ও যত্নবান থাকা।
লেখক : কলামিস্ট।