পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেন বিশ্বনবী ও শ্রেষ্ঠ নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত এবং নবীকুল শিরোমণি হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন ছিল রহমতস্বরূপ। মহানবীর সমগ্র জীবন অতিবাহিত হয়েছে মানুষের মুক্তি সাধন, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা, ঐক্য বিধান ও সুসভ্য করে গড়ে তোলার জন্য। মহানবীর পুণ্যময় সত্ত্বা ছিল অনুপম চরিত্র-মাধুরী, মহত্তম গুণাবলি ও সার্বিক সৌন্দর্যে সুষমামণ্ডিত ও শ্রেষ্ঠ।
হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর মাধ্যমে বিশ্বের জাতিসমূহ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অনুগ্রহপ্রাপ্ত হয়েছে। কারণ পূর্বে কখনো মানবজাতির ওপর আল্লাহ তায়ালার রহমত এরূপ ব্যাপক আকারে বর্ষিত হয়নি। হজরত নবী করিম (সা.) নিজেও একই বক্তব্য বিভিন্ন হাদিসে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি (সা.) বলেছেন, ‘আমাকে সাদা-কালো নির্বিশেষে সকলের জন্য পাঠানো হয়েছে।’ (মুসনাদে আহমদ)। তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝে ক্ষমার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
হাদিসে এসেছে হজরত সাঈদ বিন আবি সাঈদ (রা.) বর্ণনা করেন, তিনি হজরত আবু হুরায়রাকে (রা.) এ কথা বলতে শুনেছেন, মহানবী (সা.) নজদ অভিমুখে যুদ্ধ অভিযান প্রেরণ করেন আর তারা বনু হানিফার এক ব্যক্তি সুমামাহ বিন আসালকে বন্দী করে নিয়ে আসেন। সাহাবিরা তাকে মসজিদে নববীর খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখেন। মহানবী (সা.) তার কাছে এসে বলেন, ‘হে সুমামাহ! তোমার কাছে কী অজুহাত আছে বা তোমার সঙ্গে কী ব্যবহার করা হবে বলে তুমি মনে করো।’ তিনি বললেন, ‘আমার সুধারণা রয়েছে। যদি আপনি (সা.) আমাকে হত্যা করেন, তাহলে আপনি একজন খুনিকে হত্যা করবেন। আর যদি আপনি আমাকে ক্ষমা করেন, তাহলে আপনি এমন এক ব্যক্তিকে ক্ষমা করবেন যে এর মূল্যায়ন করতে জানে। কিন্তু যদি আপনি (সা.) সম্পদ চান, তাহলে যত ইচ্ছে নিয়ে নিন।’ এভাবেই পরের দিবস উদয় হয়। তিনি (সা.) আবারও আসেন এবং সুমামাহকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার সংকল্প কী?’ সুমামাহ বলেন, ‘আমি তো গতকালই আপনার সমীপে নিবদেন করেছি, যদি আপনি আমাকে ক্ষমা করেন, তাহলে আপনি এমন এক ব্যক্তিকে ক্ষমা করবেন যে এ অনুগ্রহের মূল্যায়ন করতে জানে।’ তিনি এখানেই কথা বন্ধ করেন আর পরের দিন সূর্য উদয়ের পর পুনরায় বলেন, ‘হে সুমামাহ, তোমার নিয়ত কী?’ তিনি বললেন, ‘আমার যা কিছু বলার ছিল, তা বলেছি।’
তিনি (সা.) বলেন, ‘একে মুক্ত করে দাও।’ সুমামাহ মসজিদের কাছে খেজুর বাগানে যান, গোসল করে মসজিদে প্রবেশ করে কলেমা শাহাদত পাঠ করে বলেন, ‘হে মোহাম্মদ (সা.)! আল্লাহর কসম, পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে বেশি অপছন্দ ছিল আপনার চেহারা আর বর্তমান অবস্থা এমন যে, আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় হচ্ছে আপনার চেহারা। আল্লাহর কসম, পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে বেশি অপছন্দ ছিল আপনার ধর্ম আর বর্তমান অবস্থায় আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় হচ্ছে আপনার আনীত ধর্ম। আল্লাহর কসম! পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করতাম আপনার শহরকে আর এখন এ শহরই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়। আপনার (সা.) ঘোড়সওয়ারীরা তখন আমাকে ধরেছে, যখন আমি উমরাহ করতে চাচ্ছিলাম। এ ব্যাপারে আপনার নির্দেশনা কী?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে শুভসংবাদ দেন আর তাকে উমরাহ করার নির্দেশ দেন। যখন তিনি মক্কায় পৌঁছান, তখন কেউ বলল, ‘তুমি কি সাবি হয়ে গেছ?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘না, আমি মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ইমান এনেছি।’ (বুখারি)
তিনি (সা.) তিন দিন পর্যন্ত তাকে ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত করার প্রজ্ঞাপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করেন, যাতে তিনি মুসলমানদের ইবাদতের রীতি-পদ্ধতি ও নিষ্ঠা এবং আপন প্রভুর সমীপে কীভাবে অনুনয়-বিনয় করে তা দেখতে পান। এবং মুসলমানরা মহানবীর (সা.) প্রতি কীভাবে ভালোবাসা ও প্রীতি প্রকাশ করে আর তিনি (সা.) তার মান্যকারীদেরকে কী শিক্ষা প্রদান করেন। মহানবী (সা.) তাকে সরাসরি কোনো তাবলিগ করেননি। কেবল প্রতিদিন জিজ্ঞাসা করতেন, ‘তোমার সংকল্প কী?’ যাতে বুঝতে পারেন এর ওপর কোনো প্রভাব পড়েছে কি না; এবং তৃতীয় দিন তার দিব্য শক্তি বুঝতে পেরেছে, এখন এর মধ্যে কোমলতা সৃষ্টি হয়েছে। তাই কোনো অঙ্গীকার ছাড়াই তাকে মুক্ত করে দেন। তারপর যে ফলাফল সৃষ্টি হয়েছে অর্থাৎ তার ইসলাম গ্রহণ প্রমাণ করে, তার (সা.) ধারণা সঠিক ছিল।
ক্ষমা ও মহানুভবতার এমন দৃষ্টান্ত মহানবীর (সা.) জীবনে আমরা আরও উজ্জ্বলভাবে দেখতে পাই। সেকালে আরবরা মহানবীর (সা.) পবিত্র দেহকে পাথরের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করেছে, বিষ প্রয়োগ করে তাকে হত্যার চক্রান্ত করেছে, হিংসা-ক্রোধ ও পাশবিকতায় উন্নত হয়ে তার চাচার হৃৎপিণ্ড প্রকাশ্যে চর্বণ করেছে, তাড়িয়ে দিয়েছে তাকে জন্মভূমি থেকে। এমনকি যে ব্যক্তির নির্মম আঘাতের দরুন তার প্রিয়তম কন্যার মৃত্যু ঘটেছিল, মক্কা বিজয়ের পরে তিনি সেই অত্যাচারীদের অকুণ্ঠচিত্তে এবং হাসিমুখে ক্ষমা করে দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে মহত্তম নিদর্শন-ঔদার্য ও মহানুভবতার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
মক্কা বিজয়ের সময় আবু সুফিয়ানের একটি ঘটনাও ইতিহাসে সংরক্ষিত আছে। আবু সুফিয়ানকে যখন গ্রেফতার করে মহানবীর (সা.) খিদমতে উপস্থিত করা হয়, তখন তিনি (সা.) তাকে বলেন, ‘বলো কী চাও?’ তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনি কি আপনার জাতির প্রতি দয়া করবেন না। আপনি তো পরম দয়ালু ও মহানুভব। এ ছাড়া আমি আপনার আত্মীয়ও বটে, ভাই হই, তাই আমাকে সম্মান দেখানোও প্রয়োজন, কেননা এখন আমি মুসলমান হয়ে গেছি।’ তিনি (সা.) বলেন, ‘ঠিক আছে, যাও মক্কায় ঘোষণা করে দাও; যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের গৃহে আশ্রয় নেবে, তাকে নিরাপত্তা দেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার ঘরে আর কতজনের সংকুলান হবে। এত বড় শহর, তা আমার গৃহে আর কতজন আশ্রয় নিতে পারবে।’ তিনি (সা.) বলেন, ‘ঠিক আছে; যে ব্যক্তি খানা কাবায় আশ্রয় নেবে, তাকে নিরাপত্তা দেওয়া হবে।’ আবু সুফিয়ান বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! খানা কাবাও ছোট্ট একটি জায়গা, সেখানেই-বা কতজন আশ্রয় নেবে, তার পরও লোক বাকি থেকে যাবে।’
তিনি (সা.) বলেন, ‘যে নিজের ঘরের দ্বার বন্ধ রাখবে, তাকেও নিরাপত্তা দেওয়া হবে।’ তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! যারা রাস্তাঘাটে বসবাস করে, তারা কোথায় যাবে?’ তিনি (সা.) বলেন, ঠিক আছে। তারপর তিনি একটি পতাকা বানান এবং বলেন, ‘এটি বেলালের (রা.) পতাকা। তাকে সঙ্গে নিয়ে এ পতাকাসহ চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করো, যে এ পতাকার নিচে এসে দাঁড়াবে, পতাকার নিচে আশ্রয় নেবে তাকেও প্রাণভিক্ষা দেওয়া হবে।’ আবু সুফিয়ান বললেন, ‘ঠিক আছে, এবার যথেষ্ট হয়েছে। আমাকে গিয়ে ঘোষণা করার অনুমতি দিন।’
যেহেতু মক্কার কুরাইশ নেতারাই অস্ত্র সমর্পণ করেছিল, তাই ভয় পাওয়ার কোনোই কারণ ছিল না। তিনি মক্কায় প্রবেশ করে ঘোষণা করেন, ‘নিজ নিজ ঘরের দরজা বন্ধ রাখো আর কেউ বাইরে এসো না। খানা কাবায় চলে যাও এবং বেলালের (রা.) পতাকার নিচে যারা আশ্রয় নেবে, তাদের সবাইকে নিরাপত্তা দেওয়া হবে। তাদের সবার প্রাণভিক্ষা দেওয়া হবে এবং কিছুই বলা হবে না। কিন্তু তোমাদের অস্ত্র সমর্পণ করো।’ ফলে মানুষ তাদের অস্ত্র সমর্পণ করা আরম্ভ করে আর হজরত বেলালের (রা.) পতাকাতলে সমবেত হতে আরম্ভ করে।
এরূপ প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্ত বেলাল (রা.)-এর পতাকাতলে আশ্রয় গ্রহণকারীদেরকে এটিও জানিয়ে দিয়েছে, তিনি যাকে তোমরা দাস মনে করতে, তিনি যার কোনো গোত্র বা আত্মীয়স্বজন মক্কায় ছিল না। তিনি একেবারেই নিঃস্ব এবং পায়ে ঠেলার মতো মানুষ মনে করে তোমরা তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছ। আজ শুনো এবং দেখে নাও তোমরা শক্তিশালী নও, তোমরা সফলকামী নও, পরাক্রমশালী তোমরা নও, বরং প্রবল পরাক্রমের অধিকারী হচ্ছেন বেলালের (রা.) আল্লাহ। মহাপরাক্রমশালী হচ্ছেন মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহর (সা.) আল্লাহ, আর মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ (সা.) সেই প্রবল পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর বৈশিষ্ট্যাবলি অবলম্বন করেছেন এবং এ গুণাবলি ধারণ করেছেন। এভাবে বিজয় লাভের পর প্রতিশোধ নেন, যার মাঝে ছিল না কোনো অহংকার বা গর্ব।
ক্ষমার যে দৃষ্টান্ত মহানবী (সা.) প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তা ছিল অসাধারণ। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা এবং শ্রেষ্ঠ নবীর আদর্শ মোতাবেক জীবন পরিচালনা এবং তাঁর প্রতি অধিক হারে দরুদ পাঠ করার তওফিক দান করুন। আমিন।
‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিঁউ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন, কামা সাল্লায়তা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিঁউ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা বারাকতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ।’
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট