প্রতিবছর উত্তর আমেরিকায় যতগুলো ফোবানা সম্মেলন হয়, সেসব সম্মেলন আয়োজনে ব্যয় হয় কয়েক মিলিয়ন ডলার। এসব অর্থের সিংহভাগ ব্যয় হয় অভিজাত ভেন্যু, বিশেষ করে ফাইভ স্টার হোটেলে শত শত রুম ও হলরুম ভাড়া, অতিথিদের বিমান ভাড়া ও নামী-দামী শিল্পীদের সম্মানি দিতে গিয়ে। নামী-দামী শিল্পীদের গান শুনতে এসে কানায় কানায় ভরে যায় হলরুম।
এতকিছুর পরও বিগত ৩৯ বছরে ফোবানার কী অর্জন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। আয়োজকরা দাবি করেন, ফোবানায় বাংলাদেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়। ফোবানা মানেই বাংলাদেশিদের মিলনমেলা। অথচ বাংলাদেশি কমিউনিটি বিনির্মাণ ও ঐক্যবদ্ধ রাখতে উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশি সংগঠনগুলোর ফেডারেশন হিসাবে ১৯৮৭ সালে যাত্রা শুরু করে ফেডারেশন অব বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশনস ইন নর্থ আমেরিকা (ফোবানা)। ফোবানা সম্মেলন উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের আনন্দ অভিযাত্রার তিলক হয়ে ওঠে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বরা এই সম্মেলনে অংশ নিতে উন্মুখ হয়ে থাকতেন। আমেরিকা ও কানাডার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিরা যেমন ছুটে আসতেন, তেমনি ইউরোপ থেকে অতিথিরা এসে যোগ দিতেন এই সম্মেলনে। কিন্তু যাদের উদ্দেশ্য ঐক্য ধরে রাখা, তারাই বিভক্ত করছে বাংলাদেশি কমিউনিটিকে। বরং এই ভাঙনে তারা জেদের বশে নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ চোখ বুজে ফোবানার পেছনে ব্যয় করছেন। কেউ অর্থ খরচ করছেন সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতেও।
গত ২৯-৩১ আগস্ট লেবার ডে উইকেন্ডে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া ও নিউইয়র্কে এবং কানাডার মন্ট্রিয়লে ৩৯তম ফোবানা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই তিনটি ফোবানার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা একটা সময় এক ছাতার নিচে একটি ফোবানায় ছিলেন। নানান বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় ১৯৯০ সালে ফোবানায় প্রথম ভাঙন ধরে। এরপর ফোবানা একটি থেকে দুটি হয়েছে। এরপর ভেঙে এক, দুই, তিন করে চার- পাঁচটি ফোবানা সম্মেলন হয়েছে। চলতি বছর ফোবানা কমে চারটির পরিবর্ততে তিনটি হয়েছে। মন্ট্রিয়ল ফোবানায় ভাঙনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে নতুন এক্সিকিউটিভ কমিটি গঠন নিয়ে। অভিযোগ উঠেছে, ফোবানা এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান পদটি ক্যু করা হয়েছে। যিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন তার নাম ঘোষণা না করে আরেকজনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন- যে কোনো সময় মন্ট্রিয়ল ফোবানা দুইভাগ হতে পারে। এমনটি হলে ৪০তম ফোবানা চারটি হতে পারে। তবে কোনো সম্মেলনেই শোনা যায়নি ঐক্যবদ্ধ ফোবানার আহ্বান।
সাধারণ প্রবাসীরা বলছেন- ফোবানায় যত আয়োজন তাতে প্রবাসীদের ঐক্য বা কমিউনিটির বন্ধন আরো সুদৃঢ় হওয়ার কথা। অথচ প্রতিবছর এর উল্টোটা ঘটছে। দিন যত যায় তত বিভক্তি বাড়ে এই কমিউনিটিতে। এতকিছুর পরও সাধারণ প্রবাসীরা এ বছর আশা করেছিলেন- কমিউনিটির বন্ধন সুদৃঢ় করতে উত্তর আমেরিকায় আগামী বছর থেকে, অর্থাৎ ৪০তম ফোবানা সম্মেলন একটিই হবে। অহেতুক অর্থ খরচ হবে না ফাইভ স্টার হোটেল ভাড়া করে শুধু বিনোদনের নামে। বিনোদনের জন্য এতকিছুর প্রয়োজন নেই। বরং ফোবানার মাধ্যমে বাংলাদেশি কমিউনিটি মূলধারার রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে এগিয়ে যাবে, এমনটি প্রত্যাশিত। কিন্তু ঘটছে তার উল্টোটা। প্রতিবছর নতুন নতুন বিভক্তির মহড়া হয়।
প্রবাসীদের ফোবানার প্রতি আগের সেই আবেদন আর নেই। তারপরও ফোবানার নাম শুনলে প্রবাসের লোকজন শিহরিত হন। স্বপ্ন দেখেন, দূর দেশে নিজেদের ঐক্য আর সংহতির।
আটলান্টা, নায়াগ্রা ফলস ও মন্ট্রিয়ল ফোবানায় মঞ্চে সাংস্কৃতিক পরিবশনা প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও যে ফোবানা অর্থবহ হতে পারে, বিশেষ করে বাস্তবভিত্তিক অনেক সেমিনার আয়োজন করা। নতুন প্রজন্মের সঙ্গে মূলধারার যোগসূত্র স্থাপনেও বিষয়ভিত্তিক সেমিনার আয়োজন করা। ফোবানায় এসব আয়োজন থাকলেও এসব সেমিনারে উপস্থিতি সবসময় দেখা যায় অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। এমনকী এসব সেমিনারে প্রবাসীদের অংশগ্রহণেরও কোনো আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না।
আটলান্টায় অনুষ্ঠিত এবারের ফোবানা সম্মেলনের আয়োজকরা দাবি করেছেন- উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন শহর থেকে এই ফোবানায় এসেছিলেন সর্বাধিক সংখ্যক অতিথি। সম্মেলনের অফিসিয়াল হোটেল ওয়েস্টিনের সকল রুম শেষ হয়ে যাবার পর কর্তৃপক্ষ ওয়েস্টিনের পাশে হলিডে ইন ও অ্যাম্বাসি সুইটস অতিথিদের জন্য বুক করতে বাধ্য হন। উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বন্ধু ও আত্মীয় স্বজনদের মিলনমেলায় পরিণত হয় এই সম্মেলন, যা ছিলো অভুতপূর্ব মিলনমেলা। তিনদিনই সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠান আনন্দ ও আন্তরিকতার সাথে সকলে মিলে উপভোগ করেছেন। অনেকের সাথে দীর্ঘ বছর পর দেখা হওয়া এবং একসাথে তিনটি দিন নানান অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কাটানোর এক অসাধারণ অনুভূতি ছিলো বর্ণনাতীত।
আয়োজকরা বলছেন, এবার বিভিন্ন শহরের প্রায় তিনশোরও অধিক নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে একসঙ্গে মিলিত হয়ে নানান কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখে নিজেদের। ফোবানা সম্মেলনের বিশেষ এই ইয়ুথ ফোরামে বিভিন্ন সেমিনার, জব ফেয়ার, জেনারেশন গ্যাপ-এর সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায়, মানসিক স্বাস্থ্য, মুল ধারায় সম্পৃক্ততা ইত্যদি নানান বিষয়ে তারা মতবিনিময় করেন একে অপরের সাথে। ইয়ুথ ফোরামে বেশ ক’জন তরুণ উদ্যোক্তা, জনপ্রিয় ইনফ্লুয়েন্সার, মুলধারার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত বেশ ক’জন নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ তরুণ তরুণীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এছাড়াও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এদেশে বেড়ে ওঠা আটলান্টার একশরও বেশী নতুন প্রজন্মের কিশোর কিশোরীর অংশগ্রহণে বাংলাদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার প্রয়াসটি ছিলো প্রশংসনীয়।
আটলান্টার ৭জন মেধাবী শিক্ষার্থীকে ফোবানা স্কলারশিপ দেয়া হয়। মুল মঞ্চে তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় স্কলারশিপের চেক। এবারের সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়েছে সায়েন্স ফেয়ার, বইমেলা, কাব্য জলসাসহ ১৪টি বিষয়ভিত্তিক সেমিনার।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন শনিবার দুপুরে অনুষ্ঠিত বিজনেস নেটওয়ার্কিং-এ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বাংলাদেশী উদ্যোক্তা এবং এদেশের মুলধারার বেশ কয়েকটি কোম্পানির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিজনেস নেটওয়ার্কিং লাঞ্চ-এর এই অনুষ্ঠানের কি-নোট স্পিকার ছিলেন বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ভেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের (বিডা) চেয়ারপারসন আশিক চৌধুরী, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রবাসীরা কেনো এগিয়ে আসবে এবং সুযোগ সুবিধাগুলো কী এই বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেন ও প্রবাসী উদ্যোক্তাদের আগ্রহী করে তুলতে কথা বলেন। এই ইভেন্টের মাধ্যমে বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা বাংলাদেশে বিনিয়োগে তাদের আগ্রহের কথা প্রকাশ করেন।
ফোবানার বিপুল খরচ প্রসঙ্গে আয়োজকরা বলছেন, ৭৪টি সংগঠন ফোবানায় রেজিস্ট্রেশন করেছেন। সেখান থেকে একটা অর্থ এসেছে। ফোবানার কর্মকর্তারা নিজেরাও অর্থ দিয়েছেন। এই অর্থের পরিমাণ মোটা, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এই ব্যয় অবশ্যই অর্থবহ।
নায়াগ্রা ফলসে অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী ফোবানায় সেমিনার ছিল। কিন্তু সেখানে উপস্থিতি ছিল হতাশাব্যঞ্জক। উপস্থিতি আশাব্যঞ্জক হলেও নতুন প্রজন্মকে টানতে পারেনি এই ফোবানা সম্মেলন। তবে আগামীতে এ বিষয়গুলোর প্রতি, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের উপস্থিতির ওপর জোর দেওয়া হবে বলে ফোবানা স্টিয়ারিং কমিটির কর্মকর্তারা দাবি করেছেন।
স্টিয়ারিং কমিটির একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা আত্মসমালোচনা করতে গিয়ে বলেন, ফোবানা স্টিয়ারিং কমিটিতে অনেক নেতা আছেন, যারা নিজেদের ‘নাম ফুটাতে’ কমিটিতে ঢুকছেন। কিন্তু তারা পকেটের অর্থ খরচ করতে চাননা। অন্যের পকেটের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এমনকী নিজেদের হোটেল রুমের ভাড়া পরিশোধের জন্য অন্য কারো মুখাপেক্ষি হন। এ ধরনের লোকজনকে ফোবানা থেকে বিতারণ করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। ওই কর্মকর্তার মতে, ফোবানায় মোটা অংকের অর্থ খরচকে অর্থবহ করা উচিত, যাতে বাংলাদেশি কমিউনিটির অগ্রগতি হয়। অথচ মোটা অংকের অর্থ খরচ হয় ফাইভ স্টার হোটেল ও হলরুম ভাড়ায়। এসব নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। কখনো কখনো অর্থ তছরুপের অভিযোগও উঠে।
কানাডার মন্ট্রিয়লে অনুষ্ঠিত ফোবানা ছিল বেশিরভাগই বিনোদননির্ভর। বলতে গেলে বাংলাদেশ থেকে শিল্পী নিয়ে কানাডায় গিয়ে লাখ লাখ ডলার খরচ করে সেখানকার প্রবাসীদের কাছে বিনোদন পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু এই বিনোদনের জন্য লাখ লাখ ডলার খরচ করার কোনো মানে হয় না। শোনা গেছে, মন্ট্রিয়ল ফোবানা থেকে সংগৃহীত অর্থ আয়োজকদের কারো কারো পকেটে ঢুকেছে। সেটা নিয়ে বেশ অসন্তোষের খবর পাওয়া যায়।