Thikana News
০১ অগাস্ট ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ০১ অগাস্ট ২০২৫

অগ্নিপরীক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকার

অগ্নিপরীক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকার
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে আগামী ৫ আগস্ট। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের বর্ষপূর্তি আগামী ৮ আগস্ট। ৫ আগস্টের আগেই জুলাই সনদ ঘোষণার চাপ রয়েছে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। যদিও ইতিমধ্যে জুলাই জাতীয় সনদের খসড়া প্রকাশ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। খসড়া সনদ পাঠানো হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। ঐকমত্য কমিশন থেকে সরবরাহ করা সনদের খসড়া নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছে কয়েকটি দল। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপির পক্ষ থেকে খসড়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। এনসিপি জানিয়েছে, সনদের যে খসড়া দেওয়া হয়েছে, তা তারা গ্রহণ করতে পারছে না। দলটি চায় জুলাই সনদ ঘোষণার পদ্ধতি আগে জানাতে। জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়, সনদের খসড়াটি অসম্পূর্ণ প্রস্তাবনা। দলটির পক্ষ থেকে জুলাই সনদ চূড়ান্তে দুটি ভিত্তির কথা বলা হয়েছে। ওদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে চলমান আলোচনা শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে। ওই সময়ের মধ্যেই একমত, দ্বিমত ও ভিন্নমতগুলো একত্রিত করে তৈরি হবে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ। এতে ঐকমত্যের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে, আর দ্বিমতের অংশগুলো ‘নোট অব দ্য ডিসেন্ট’ হিসেবে সন্নিবেশিত হবে। রাজনৈতিক দলের নেতারা স্বাক্ষর করবেন এই সনদে। ৫ আগস্টের মধ্যে যেকোনো একদিন স্বাক্ষরের জন্য দিন ধার্য করা হতে পারে। 
এদিকে কমিশনের দ্বিতীয় দফার বৈঠকে একের পর এক ইস্যুতে নিয়ে আলোচনা চললেও এখনো অনেক বিষয়েই দ্বিমত অব্যাহত রয়েছে। জুলাই সনদের নতুন বন্দোবস্তের কথা উল্লেখ থাকলেও তার বাস্তবায়ন ভবিষ্যৎ জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, গণঅধিকার পরিষদ, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ একাধিক দল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে সব দল একমত হলেও এর গঠন-কাঠামো নিয়ে এখনো চূড়ান্ত ঐক্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। জামায়াতে ইসলামী বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে ৫ সদস্যের বাছাই কমিটি গঠন করা হবে।  সেখানে সরকারি দল, বিরোধী দল, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) ও দ্বিতীয় বৃহত্তম দলের নেতা থাকবেন। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা গঠন করবেন। যদি তা না হয়, তাহলে সরকারি দল, বিরোধী দল ও দ্বিতীয় বৃহত্তম দল প্রত্যেকে ৫ জন করে নাম প্রস্তাব করবেন। যদি কোনো একজন প্রার্থীর নাম সকলে প্রস্তাব করেন, তাহলে উনিই প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ হবেন। তা না হলে কমিটির ৪ জন সদস্য যদি একজন প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করেন, তাহলে তিনিই প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হবেন। আর যদি তাও না হয়, তাহলে র‌্যাংক চয়েস ভোটের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা হবে। তবে সে ক্ষেত্রে বাছাই কমিটিতে সুপ্রিম কোর্ট থেকে একজন ও হাইকোর্ট থেকে একজন বিচারপতি যুক্ত হবেন। তাদের ভোটের ভিত্তিতে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ হবেন। এ বিষয়ে বিএনপি ছাড়া সবাই একমত।
অন্যদিকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহেই প্রধান উপদেষ্টা আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে পারেন বলে আলোচনা রয়েছে। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো বিভক্ত। একদিকে বিএনপির সুরে কয়েকটি দল বলছে ডিসেম্বরের মধ্যে না হলে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। অন্যদিকে জামায়াত-এনসিপির সুরে কয়েকটি দল বলছে, আগে জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যাকারীদের বিচার ও জুলাই সনদ ঘোষণা এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করতে হবে। তারপর সংসদ নির্বাচন।
রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাইরে দেশের অর্থনীতিতেও অশনিসংকেত। যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে নতুন করে অনাকাক্সিক্ষত সংকটের মধ্যে ফেলেছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক অর্ডারের পরিমাণ আগের চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। ফলে ঘাটতি পূরণে রপ্তানিকারকেরা ইউরোপীয় বাজারের দিকে ঝুঁকলেও সেখানে দাম কমানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফের চাপে ভারসাম্য রক্ষা ও বাংলাদেশকে অনুকূল অবস্থানে আনার লক্ষ্যে শুল্ক নিয়ে দর-কষাকষির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজ কোম্পানি বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি গম, এলএনজি, তুলা, ওষুধ, মূলধনি যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক কাঁচামাল, কৃষিজ পণ্য আমদানির ঘোষণা-সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় ইতিবাচক আবহ তৈরির চেষ্টায় নেমেছে ঢাকা। কিন্তু এসব উদ্যোগ কতটা ফলদায়ক হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হতে যাচ্ছে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহটি। এই সময়টি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্যও অগ্নিপরীক্ষার। মূলত জুলাই সনদ, নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসে, সেটি হবে একটি সত্যিকারের বিকল্প পথের সূচনা। তবে দীর্ঘদিনের সংলাপেও অনৈক্য থেকে গেলে রাজনৈতিক বিভাজন, মানবাধিকার সংকট ও আন্তর্জাতিক অসমর্থনের ঝুঁকিও বেড়ে যাবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক সংকটময় পরিস্থিতির দ্বারপ্রান্তে। যতই দিন যাচ্ছে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রবল দ্বন্দ্ব, সামাজিক অসন্তোষ এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও ‘প্রশাসনিক অচলাবস্থা’ দেখা দিচ্ছে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ না হওয়া, সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে মতানৈক্য, জুলাই সনদ প্রণয়ন ও আসন্ন নির্বাচন ঘিরে দলগুলোর টানাপোড়েনসহ বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক বিষয় সামনে আসছে। এ অবস্থায় আগস্ট মাসের প্রথমার্ধই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ পেছনে ফিরবে নাকি সামনের দিকে অগ্রসর হবে। আর চতুর্মুখী এই সংকট কতটা দক্ষতার সঙ্গে সরকার মোকাবিলা করতে পারে, তার ওপর নির্ভর করছে অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পতন হলে ৮ আগস্ট রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয় শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর বিভিন্ন মহল থেকে রাষ্ট্রের অতিপ্রয়োজনীয় খাতে সংস্কারের দাবি ওঠে। তা ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শুরু থেকেই বলে আসছিলেন, সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ের মধ্যেই তারা জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করবেন। একপর্যায়ে তিনি ঘোষণা করেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যেই নির্বাচন হবে। তবে অনেক দল সরকারের সেই ঘোষণায় আস্থা রাখতে পারেনি। পরে গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। একই সঙ্গে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই মাসেই ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুত করে জাতির সামনে উপস্থাপনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। তবে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। এমন সময়ে অর্থাৎ গত ৯ জুন চার দিনের সফরে যুক্তরাজ্য যান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে ১৩ জুন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন তিনি। পরে যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে। এ ঘোষণা নিয়েও বিভিন্ন দলের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে। কারণ, নির্দিষ্টভাবে নির্বাচনের দিনক্ষণ উল্লেখ করা হয়নি। তা ছাড়া বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদলগুলো বাদে অন্য দলগুলো জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি তুলেছে। তার সঙ্গে নতুন বিতর্ক যুক্ত করেছে আনুপাতিক হারে বা পিআর পদ্ধতির নির্বাচন ইস্যু। এটিও এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সময়। এ সময়ে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ আপামর জনসাধারণকে নিয়ে রাজপথে লাগাতার আন্দোলনের মাধ্যমে গত ১৫ বছর জনগণের ঘাড়ে চেপে বসা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়েছে। গত এক বছর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ঘটনাবহুল বছর। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হলো ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে এবং কীভাবে হবে। তবে শেষ মুহূর্তে জুলাই সনদ নিয়ে টানাপোড়েন রাজনৈতিক দল ও অন্তর্বর্তী সরকারকে চরম অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। গুঞ্জন উঠেছে, বিষয়টির সুরাহা না হলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অভিমানে পদত্যাগ করার মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আর সেটা যদি হয়, তাহলে তা হবে বাংলাদেশের জন্য বিরাট অশনিসংকেত।
 

কমেন্ট বক্স