গেল জুলাইতে চেতনার মানচিত্রে আঁকা গেল রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থান। এই জুলাইতে এসে অনেকটা বেরং-ফ্যাকাশে। রক্তাক্ত সেই ঢেউ, মায়ের আহাজারি, বুলেটের তাণ্ডব এবং রাজপথ প্রকম্পিত মিছিলের স্পর্ধা কারও কাছে আফসোসের। কারও কাছে অন্য কোনো বার্তা। জুলাই অভ্যুত্থানের আবেদন, আদর-কদর এক বছর পূর্ণ না হতেই ফিকে হয়ে গেল কেন- মোটাদাগের প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিভেদও ঠেকানো গেল না।
নানা শঠতা, অ্যাজেন্ডা, বন্দোবস্ত, এমনকি ধান্ধা পর্যন্ত ভর করেছে তাদের ওপর। যার অনিবার্য পরিণতিতে বিভেদ-বিভাজন। তার ওপর আলোচিত-প্রশংসিত ওই সমন্বয়কদের কারও কারও বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ। অর্থ-অস্ত্র, নারীসহ নানা কেলেঙ্কারি। দেশের বৃহৎ দল বিএনপির সঙ্গে বিরোধ তুঙ্গে। জাতশত্রু আওয়ামী লীগের হুংকার। সুযোগ পেলেই জ্যান্ত খেয়ে ফেলার পয়গাম। যার যোগফলে চরম অনিরাপদে জুলাই আন্দোলনের ফ্রন্টলাইনাররা ও তাদের সংগঠন এনসিপি।
বাতাস বুঝে এ রকম সময়েই শেখ হাসিনা-পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের মেসেজ, ফেসবুক স্ট্যাটাস। বললেন, ২৪ সালে গণবিপ্লব হয়নি, হয়েছে দাঙ্গা। নাম ‘জুলাই দাঙ্গা’। তার ভাষায়, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত হওয়া ‘জুলাই দাঙ্গা’ ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণকালের সবচেয়ে কালো অধ্যায়। বিদেশি রাষ্ট্রের অর্থায়নে আর উগ্রবাদী অপশক্তির মদদে সংঘটিত সেই দাঙ্গার পেছনে অনেকেই যুক্ত হয়েছিলেনÑকেউ সচেতনভাবে, কেউবা না বুঝে বিভ্রান্ত হয়ে। পেশাজীবী সমাজের বহু সদস্য, যারা বছরের পর বছর দেশের জন্য কাজ করেছেন, সেই সময় ভুল তথ্য, গুজব ও প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে এই ষড়যন্ত্রের অংশ হয়েছিলেন।
এদিকে ক্ষমতার পাটাতন বললেও ওই শিক্ষার্থীদের মাথার ওপর থেকে সরকার, বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের হাত ক্রমশই সরে যাচ্ছে। তার অ্যাটেনশন অন্যদিকে। কখনো কখনো তা স্থানিক রাজনীতির চেয়ে বিদেশি কূটনীতির দিকে। মাঝেমধ্যে সামাজিক ব্যবসার দিকে। ইরানে মার্কিন বোমা হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে দেওয়া বিবৃতির মাঝেও ছিল সেই ছাপ। সেখানে আমেরিকার নাম উচ্চারণ করেননি। বিষয়টি সচেতন মহলের চোখে পড়েছে। এর মাঝেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ১৫ মিনিট ফোনালাপ। তা জানানো হয়েছে সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসসকে দিয়ে। এই ফোনালাপ নিয়ে বেশ ইনোসেন্ট নিউজ করেছে- দুই দেশের স্বার্থ নিয়ে তারা সৌহার্দ্যপূর্ণ কথাবার্তা বলেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের তথ্য বলছে, কথা হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তা নিয়ে।
বাংলাদেশের সঙ্গে শুল্ক ইস্যুতে মার্কিন টানাপোড়েন চলছে। বাংলাদেশ সেটা সমাধানের চেষ্টাও করছে। নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান লন্ডন সফর শেষ করে দ্রুত আমেরিকায় গিয়ে উপপররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করায় সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও বলা হয়েছে, তিনি বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে কথা বলেছেন। বাণিজ্য নিয়ে কথা বলার জন্য তো বাণিজ্য উপদেষ্টা আছেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আছেন। খলিলুর রহমানকে কেন এটা নিয়ে আলাপ করতে হবে? এ প্রশ্নকে গুরুত্ব দিয়ে কারও কারও ধারণা, মার্কিন স্বার্থকে গোপন রেখে সরকার কিছু একটা করছে। কখনো কোরাল দ্বীপ রক্ষার নামে, কখনো বাণিজ্য শুল্কের নামে আসল বিষয় আড়াল করছে। এতে ড. ইউনূস আমেরিকার স্বার্থে কাজ করছেন, ধারণাটি দিন দিন পোক্ত হচ্ছে। সেই সঙ্গে পুরোনো কিছু ভেজালে নতুন করে টোকা পড়ছে। আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, পরে জাতীয় নির্বাচন, সংখ্যানুপাতে সংসদ সদস্য ঠিক করাসহ পুরোনো আরও নানা কিছু তাজা করা হচ্ছে।
এসবের মধ্য দিয়ে কেবল নির্বাচন নয়; জরুরি আরও অনেক কিছু অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য, স্বল্প আয়ের মানুষের জীবন-জীবিকার সমস্যা, বেকারত্ব, চাকরিপ্রার্থীদের সমস্যা হয়ে পড়েছে গুরুত্বহীন। তার ওপর মব ভায়োলেন্স। দলবদ্ধ হয়ে একটা অজুহাতে হামলা করার প্রবণতা ও পরিমাণ বেড়েই চলেছে। তা প্রায় নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথাও কোথাও পুলিশের উপস্থিতিতেও ঘটছে। বিশেষ করে, গত ১০ মাসে এ রকম ঘটনায় হামলা হয়েছে চিহ্নিত কোনো ব্যক্তির ওপর, কোনো অফিসে, চলেছে ঘরবাড়ি লুটপাট, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা, মাজার, আখড়া ভাঙার ঘটনাও ঘটেছে, বন্ধ হয়েছে নারীদের ফুটবল ম্যাচ। যাকে-তাকে ফ্যাসিস্ট ট্যাগ দিয়ে যেখানে যাকে পারছে নাজেহাল করছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বলা হয়েছে, সরকার মব ভায়োলেন্স সমর্থন করে না। তার প্রেস সেক্রেটারি বলছেন, এগুলো মব নয়, প্রেশার গ্রুপ। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, মব ভায়োলেন্স মানবতার শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সভা-সমাবেশ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ রাজনৈতিক দলগুলো।
মব নিয়ে যে যার মতো সাইড নিচ্ছেন। সমান্তরালে বাড়ছে মব ভায়োলেন্স। সাধারণত গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন হলে সাময়িক শাসনতান্ত্রিক শূন্যতায় একধরনের অরাজকতা চলে। আর এই সময়ে তাৎক্ষণিক সুবিধা নেওয়া, শত্রুতা, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা, জমি, বাড়ি, সম্পদ দখল করার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে। লক্ষণীয় বিষয় ছিল, শঙ্কা থাকলেও ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর দেশ সরকারবিহীন থাকার সময় এ ধরনের ঘটনা তেমন ঘটেনি। যত ঘটনা শুরু হয় ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনের কয়েক দিন পর থেকে। সম্প্রতি ব্যাপকতা কেবল বাড়ছে। এর মাঝেও একটি ভিন্ন ইঙ্গিত।