জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানকারী শক্তিগুলোর অবিশ্বাস-অনাস্থার জেরে অর্থনৈতিক-প্রশাসনিক বিন্যাসসহ মৌলিক কিছু সংস্কারও অনিশ্চিত করে তুলেছে। আশা-নিরাশার অবিরাম দোলাচলে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপিসহ চব্বিশের আন্দোলনকারীরা যে যাকে পারছে কথা-কাজে সমানে ঘায়েল করছে। যা সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তের আলোর রেখাও নিভিয়ে দেওয়ার শঙ্কা তৈরি করছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর অন্ধকার যুগের অবসানের আশাবাদকে মার খাইয়ে দিচ্ছে। তারুণ্যের খণ্ডিত অংশের ওপর বেশি ভরসা করে ড. ইউনূসের সরকার ক্রমেই বেকায়দায় পড়ছে। উপদেষ্টাদের মুখে মুখে সংস্কারের স্তুতি গীতিতে ক্লান্তি ধরেছে প্রধান দল বিএনপির। তারা বলেই দিয়েছে, সংস্কারের চেয়ে খানাপিনা বেশি হচ্ছে। দ্রুত নির্বাচনের বিষয়ে উতলা দলটি।
জামায়াত-এনসিপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে একটার পর আরেকটা ইস্যুতে। সর্বশেষ এনে ঠেকিয়েছে ভোটের সংখ্যানুপাতিক হারের নির্বাচনে। আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, গণহত্যার বিচারের আগে নির্বাচন নয়-এসবের পর এনসিপির এখন প্রধান দাবি জুলাই ঘোষণা। এক জুলাই শেষে আরেক জুলাইতেও সেই ঘোষণা দিতে না পারার নেপথ্যে বড় ব্যর্থতা ও ষড়যন্ত্র দেখছে তারা। বলছে, আগামী ৩ আগস্টে নিজেরাই জুলাই ঘোষণা দিয়ে বসবে, যা চলমান ও প্রথাগত রাজনীতিতে অসম্ভব।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, এখন ‘জুলাই ঘোষণা জারি’র প্রয়োজন নেই। এইটার কোনো সাংবিধানিক বা আইনি ভিত্তি নেই...। তাই এইটা হবে অর্থহীন। কিন্তু ছাত্র সমন্বয়কদের (বর্তমান এনসিপি নেতা) কাছে এর অনেক অর্থ। নইলে জুলাই আন্দোলনের স্বীকৃতিই থাকে না। তারা নিজেরাও হয়ে যান ফৌজদারি অপরাধী। এরই মধ্যে সেই জুলাই-আগস্টের ঘটনাকে বিপ্লব বা অভ্যুত্থান না মানার মানসিকতা তৈরি হয়েছে, যা তাদের জন্য রীতিমতো বিপজ্জনক। একইভাবে তাদেরকে ছাড়া নির্বাচনও অসম্ভব। রাজনীতির সমান্তরালে অর্থনীতিসহ সর্বত্র অস্থিরতা। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে কেবল লাল সূচক। প্রফেসর ইউনূস বা তার উপদেষ্টা পরিষদের কেউ বিপ্লবী নন। প্রচলিত রাষ্ট্র আর সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকে একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে দেশ চালাচ্ছেন কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচি ছাড়াই।
এ জন্য তিনি বা তার উপদেষ্টাদের মধ্যে জুলাই ঘোষণা দেওয়ার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। অর্থ ও পুঁজিবাজার থেকে প্রতিদিন দেশ-বিদেশে লাল সংকেত দেখানো হচ্ছে। পুঁজিবাজারে মাঝেমধ্যে উন্নতির কিছু লক্ষণ দেখা গেলেও ব্যাংক সুদ হার নিম্নমুখী। ডলারমূল্য প্রায় স্থিতিশীল। সঞ্চয়পত্রের সুদ হারও নিম্নমুখী। সীমান্তের ওপার থেকেও নানা ধরনের আতঙ্ক ও উত্তেজক খবর ছড়ানো হচ্ছে। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে গোটা রাজনীতি-অর্থনীতি-কূটনীতি সর্বত্র।
অর্থ উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলসহ সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে বসে সংকট, সমস্যা ও সমাধান নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে দৃষ্টান্তমূলক বাজেট দিতে পারেননি। তিনি সেই পথে যানওনি। বিগত সরকারের আমলের ২ লাখ ৪৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা পাচারের অঙ্ক জানাতে পারলেও এ বিষয়ে কিছু করা যায়নি। তবে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে এসব টাকা ফেরত আনার। বৈদেশিক ঋণ আনা ও ছাড়ের সাফল্যকে বড় কৃতিত্ব মানতে নারাজ রাজনৈতিক শক্তিগুলো। তারা বলছে, নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার তা আরও বেশি পারবে। আরও পারবে দেশের অভ্যন্তরে থাকা বিপুল অপ্রদর্শিত আয় ও বাক্সবন্দী অর্থ অর্থনীতির মূলধারায় আনতে।
সরকার, আন্দোলন ও ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলোর এমন মতিগতির মাঝে অর্থনৈতিক স্যাবোটাজের কবলে পড়েছে সরকার। মন্ত্রণালয়সহ অর্থের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ঘাপটি মেরে আছে গেল সরকারের লোকেরা। তারা এরই মধ্যে লাখ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি করে সরকারের আর্থিক খাতে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক দুরবস্থার পেছনে কেবল বৈশ্বিক সংকট নয়, বরং ‘ভেতরের শত্রু’ যারপরনাই তৎপর। বিশাল রাজস্ব ঘাটতি, প্রণোদনার ভুল বণ্টন, এলসি সংকট, রিজার্ভের অস্বচ্ছতা-এসব কিছুর পেছনে তাদের একটি পরিকল্পিত অব্যবস্থাপনা ও নীরব ধ্বংসযজ্ঞ চলমান। উদাহরণ প্রশান্ত কুমার হালদারের অর্থ পাচার। যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের দুইশর বেশি কর্মকর্তা । তারা বহাল তবিয়তে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য দুর্ভাগ্যের। বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো কোনো যোগ্য গভর্নরের দেখা মেলেনি, যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব নিয়ে বড় কোনো পরিবর্তন দেখাতে পেরেছেন, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব রেখেছে। বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর অনেক আশা দেখিয়েছেন, তৎপরতাও দেখিয়েছেন। সম্প্রতি বলতে শুরু করেছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে তা সম্ভব নয়।