(পূর্ব প্রকাশের পর)
দেশের বাইরেও বিভিন্ন দেশে বঙ্গবন্ধুর নামে সড়ক ও মহাসড়কের নামকরণ করা হয়েছে। তার মধ্যে সর্বপ্রথম ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় ১৯৯৭ সালে কলকাতাস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনের রাস্তাটির নামকরণ করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরণি। তারপর দিল্লি শহরে পৌর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ২০১৭ সালের ৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান জানিয়ে শঙ্কর রোড-মন্দির মর্গ ট্রাফিক চত্বর লেকে রামমোহন লোহিয়া হাসপাতালের সামনের রাস্তার কিছু অংশের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শেখ মুজিব সড়ক। আগে ওই অংশের নাম ছিল আওরঙ্গজেব রোড।
একইভাবে ২০১৭ সালে কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনের একটি প্রধান সড়কের নাম রাখা হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান রোড। এই সম্মান দেখানোর পরবর্তী পর্যায়ে ঢাকার কূটনৈতিক জোনের অন্যতম প্রধান সড়ক বারিধারার পার্ক রোডের নাম পাল্টে করা হয়েছিল রাজা নরোদম সিহানুকের নামে। ২০১৯ সালে ফিলিস্তিনের একটি ঐতিহ্যবাহী শহর হেভরনের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামে। একইভাবে ২০২০ সালে মরিশাসের প্যারাডাইস আইল্যান্ডের রাজধানী পোর্ট লুইসের একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামে-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্ট্রিট।
১৯৯৭ সালে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় স্থাপিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুলবার্ড নামে একটি সড়ক। আঙ্কারায় সড়ক ছাড়াও রয়েছে বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্য।
যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম নগরী শিকাগোতে রয়েছে ‘শেখ মুজিব ওয়ে’। শিকাগো সিটি কাউন্সিলের উদ্যোগে ২০১৮ সালে এই নগরীর ব্যস্ততম এলাকা ডেভন অ্যাভিনিউয়ের একটি অংশের ওই নামকরণ হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি মহাসড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘In Memory of Sheikh Mujibur Rahman’ নামে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের ঢাকায় রয়েছে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, ফরিদপুরে রয়েছে মুজিব সড়ক, সাভারে রয়েছে বঙ্গবন্ধু সড়ক, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে রয়েছে শেখ মুজিব সড়ক ও সিরাজগঞ্জে রয়েছে শেখ মুজিব সড়ক। বান্দরবান, নারায়ণগঞ্জ, যশোর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁওয়ে একইভাবে বিভিন্ন সড়কের নামের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নাম।
এ ছাড়া আরও কিছু স্থাপনার নাম পরিবর্তন করে শেখ সাহেবের নামে দেওয়া হয়েছে। যেমন একসময়ের চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী প্রদর্শনী কেন্দ্র। ঢাকার ধানমন্ডিতে হয়েছে বঙ্গবন্ধু টাওয়ার। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু চত্বর স্মৃতিস্তম্ভ ঢাকা, বঙ্গবন্ধু স্কয়ার ফরিদপুর নামে রয়েছে আরও কয়েকটি স্থাপনা।
বঙ্গবন্ধুর নামে বিভিন্ন মিডিয়া ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রামাণ্যচিত্রও নির্মিত হয়েছে। তার মধ্যে হলো জাপান কর্তৃক নির্মিত ‘রহমান দ্য ফাদার অব বেঙ্গল’, ডেভিড ফ্রস্ট নির্মিত ‘ডেভিড ফ্রস্ট প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ’, বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের ওপর নির্মিত ‘Welcome Bangabandhu’, ফাখরুল আরেফীন খানের ‘দ্য স্পিচ’, আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরীর ‘পলাশি থেকে ধানমন্ডি’, শ্যাম বেনেগলের ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গুণীজনদের স্মরণ করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কৃতীমান শিক্ষাগুরুদেরকে ‘চেয়ার পদক’-এ ভূষিত করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে, সম্মানজনক গবেষণায় নিয়োজিত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের এই সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এ ধরনের ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ স্থাপিত হয়েছে দেশে এবং বিদেশের অনেকগুলো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস এবং ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, ব্রাজিলের ব্রাসিলিয়া ইউনিভার্সিটি ও কানাডার সাস্কাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়।
তবে সব ক্ষেত্রে যে শুধু মেধা যাচাইয়ের ভিত্তিতে এই বঙ্গবন্ধু চেয়ারের জন্য যোগ্য ব্যক্তিকে মনোয়ন দেওয়া হয়, সেটা সঠিক নয়। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে বঙ্গবন্ধু চেয়ার পদে নিয়োগ পাওয়া অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মো. আতিউর রহমানের কথা উল্লেখযোগ্য। তিনি ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং তার আমলে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাইবার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। এই ঘটনার দিন ছিল শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং ঘটনাটার জন্য দায়ী করা হয় একটি ত্রুটিযুক্ত প্রিন্টারকে, যেটি ব্যবহৃত হতো টাকার লেনদেনের হিসাব-নিকাশের কাজে। সেই প্রিন্টার দিয়েই হ্যাকাররা বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রিজার্ভ চুরির ঘটনাটা ঘটিয়েছিল বলে প্রমাণিত হয় এবং বিষয়টার জন্য কোরিয়ান হ্যাকারদের দায়ী করা হয়েছিল সে সময়ে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের বিদেশি মুদ্রার দেখভালের দায়িত্ব পালন করে থাকে। এমন একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লেনদেনের কাজে কেন ত্রুটিপূর্ণ একটি প্রিন্টার ব্যবহৃত হবে বা হয়েছিল, এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক হলেও সেই সময়ে অনেকেই রহস্যজনক নীরবতা পালন করেছিল। টাকা সরিয়ে নেওয়ার জন্য এই সাইবার হ্যাকিং গ্রুপ ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দাতব্য সংস্থা, ক্যাসিনোসহ সহযোগীদের একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ব্যবহারের ভেতর দিয়ে এই হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটিয়েছিল।
আশ্চর্যজনক বিষয় ছিল ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি এই চুরির ঘটনা ঘটলেও এক মাসেরও বেশি সময় ধরে সেই চুরির ঘটনাটা চেপে রেখেছিল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। পরে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. ফরাস উদ্দিনকে (যিনি একসময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদে কাজ করে গেছেন) প্রধান করে একটি তদন্ত টিম গঠন করাও হয়েছিল। সেই তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত ১৩ কর্মকর্তার নাম উঠলে গভর্নর আতিউর রহমান নিজের ওপর দায়িত্ব টেনে নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। ঘটনাটি ঘটেছিল ৪ ফেব্রুয়ারি আর তার পরের মাস ১৫ মার্চ তিনি পদত্যাগ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে শিক্ষক পদে যোগ দেন। এই রকম এক ব্যক্তি, যিনি রাষ্ট্রের এত বড় একটা দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, তার মতো একজনকে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ হিসেবে সম্মানিত করার ভেতর দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে সরকারের সদিচ্ছার বিষয়টিও। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও বঙ্গবন্ধু চেয়ার স্থাপনের অধিকার রাখে। যেমন শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (BPATC) প্রখ্যাত সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনকে বঙ্গবন্ধু চেয়ারের সম্মাননা প্রদান করেছিল।
এ ছাড়া দেশের বাইরে ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু চেয়ার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বাংলাদেশ-ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস (আইসিসিআর) বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ ছাড়া ল্যাটিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলের প্রখ্যাত ব্রাসিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি পর্তুগিজ ভাষায় অনুবাদ করারও দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একইভাবে বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ইতালির রোমে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সদর দফতরে ‘শেখ মুজিব-বাংলাদেশ, রোম’ স্থাপনের জন্যও একটি সমঝোতা চুক্তি হয়েছিল। ওই চুক্তির ফলে এফএওর মূল ভবনে বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে ‘রোম’ স্থাপন করায় অনুষ্ঠিতব্য বিভিন্ন সভা, সমাবেশ বা সেমিনারে উপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি তুলে ধরার ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে বলেও আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্ব আশা করেছিল।
কানাডার সাস্কাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ও এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল ইনস্টিটিউট ফর ফুড সিকিউরিটিতে স্থাপন করা হয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’। মূলত দেশের বাইরে অন্য কোনো উন্নত দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ স্থাপনের ভেতরে ওই উদ্যোগটাই প্রথম। মূলত চেয়ার স্থাপনের আওতায় বাংলাদেশের জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদাভিত্তিক সমসাময়িক বিষয়ের ওপর জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমের ছয়জন গবেষক পিএইচডি ও ১৫ জন গবেষক পোস্ট ডক্টরালে গবেষণা করার সুযোগ পাওয়ার কথা।
এ ছাড়া রয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেল, যা অনেকের কাছে কর্ণফুলী টানেল নামেও পরিচিত। চীনের সহায়তায় ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল। এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং। পরে শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি টানেল নির্মাণের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছিলেন এবং ওই কাজ সম্পন্ন হতে সময় নিয়েছিল প্রায় ৯ বছর। এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ করার জন্য নির্ধারিত সময় হিসেবে ২০২২ সালকে ধরা হলেও বাড়তি আরও এক বছরের মতো লেগেছিল। এটি বাংলাদেশের প্রথম সুড়ঙ্গ পথ, আবার দক্ষিণ এশিয়ায় নদী তলদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম সুড়ঙ্গ পথ হিসেবেও বিবেচিত। এই সুড়ঙ্গ পথের নির্মাণকাজ করেছিল চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড।
এই সড়ঙ্গ পথ নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল কর্ণফুলী নদীর উপরের দুই সেতুতে চাপ কমাতে সাহায্য করা ছাড়াও বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনকারী হিসেবে এই টানেলের একটা ভূমিকা থাকবে। এই টানেল নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ১০ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ সুদে ৫ হাজার ৯১৩ দশমিক ১৯ কোটি টাকা দিয়েছে ২০ বছর মেয়াদি ঋণ হিসেবে এবং এই টানেল নির্মাণের প্রকল্প পরিচালকের বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল, কর্ণফুলী টানেল দেশের অর্থনীতিতে একটা বড় প্রভাব ফেলবে। যার পরিমাণ হবে দেশের জিডিপিতে বার্ষিক শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশের মতো। কিন্তু প্রথমেই ঋণ পরিশোধের বিষয়টা মাথায় নিলে প্রবৃদ্ধির এই হারের কথা অসাড় হয়ে পড়ে। যেমন ২০২৫ সাল থেকে চীনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধের কথা কিন্তু টানেল থেকে পাওয়া অর্থ ওই ঋণ পরিশোধের জন্য কখনোই পর্যাপ্ত নয় বা হবে না। টানেল কর্তৃপক্ষের মতে, উদ্বোধনের পর থেকে প্রথম এক বছরে দৈনিক আয়ের যে হিসাব দৈনিক ব্যয়ের দিক দিয়ে তা চার গুণেরও কম। যেমন উদ্বোধনের পর ওই টানেল দিয়ে প্রতিদিন তিন হাজারের মতো যানবাহন চলাচল করেছে, টোল বাবদ তার আয়ের পরিমাণ ১০ লাখ বা তার চেয়ে কিছুটা বেশি হবে। অপরদিকে ওই টানেল চালু রাখার জন্য প্রতিদিনের খরচ বাবদ হিসাব হচ্ছে ৩৭ লাখ টাকারও উপরে, যা এখন সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়া হয়ে থাকে। এ অবস্থায় ঋণ পরিশোধের বিষয়টি সামনে এলে আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। শুধু ঢাকা-কক্সবাজারের সড়ক দূরত্ব কমবে ৫০ কিলোমিটারের মতো। এ ছাড়া বড় কোনো সুফল আসবে না বা আসেওনি ওই কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের কারণে। কারণ টানেলটি সার্বক্ষণিকভাবে চালু রাখার জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ যেমন নিশ্চিত রাখার একটা বিষয় রয়েছে, সেই সঙ্গে টানেলের ভেতর থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড অপসারণ করে সেখানে অক্সিজেনের প্রবেশ করানোর টেকনিক অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রেও বড় একটা খরচের ধাক্কা রয়েছে, অধিকন্তু টোলের বিষয়টাও একটা ফ্যাক্টর। কর্ণফুলী টানেলের ৩০ কিলোমিটারের দূরত্বে রয়েছে শাহ আমানত সেতু। বলা হয়ে থাকে, ওই সেতুর টোলের চেয়ে কর্ণফুলী টানেলের টোল যানবাহন ভেদে আড়াই থেকে ছয় গুণ বেশি। ওই বাড়তি টোলও টানেলের ভেতর দিয়ে কম যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে একটা ভূমিকা পালন করে থাকে। সবকিছু মিলিয়ে কর্ণফুলী টানেল এখন সরকারের জন্য বড় এক মাথাব্যথার কারণ। এ ধরনের মেগা প্রকল্প শুধু চমক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তৈরি করা যে কতটা বোকামি, এখন সেটা সবার কাছেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। এই টানেলের নামের আগে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটা জুড়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে পিতাকে অমরত্বের আসনে বসানোর শেখ হাসিনার একটা প্রয়াস হিসেবেই দেখছেন অনেকে।
তবে শুধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে, সেটা ঠিক নয়। পুরো শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে বাংলাদেশে ১২৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছিল এবং তা শেখ হাসিনার শাসনামলের পুরোটা সময়জুড়ে নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়েছিল। দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৫৫টি। এর মধ্যে ১৩টির নামকরণ করা হয়েছে শেখ পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের নামে। যেমন বঙ্গবন্ধুর নামে রয়েছে নয়টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে তার স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছার নামে। দুটি শেখ হাসিনার নামে। কেবল বঙ্গবন্ধুর নামে দেশে রয়েছে ৮১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও রয়েছে মাদ্রাসা এবং কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছার নামে রয়েছে ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শেখ হাসিনার নামে রয়েছে নয়টি। শেখ হাসিনার ভাই শেখ রাসেলের নামে রয়েছে ১০টি এবং বোন শেখ রেহানার নামে মাত্র একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং ফুফাতো ভাই শেখ মণির নামেও একটি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে।
এ ছাড়াও রয়েছে শেখ হাসিনা যাবতীয় যুব কেন্দ্র ও শেখ হাসিনা পল্লী উন্নয়ন অ্যাকাডেমি। আরও রয়েছে বিএনএস শেখ হাসিনা নৌবাহিনী জাহাজ। রয়েছে শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম ঢাকা এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম মানিকগঞ্জ ও শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক পল্লী জামালপুর। শেখ হাসিনার নামে বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন কলেজের ভবনেরও নামকরণ করা হয়েছে। যেমন চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বুটেক্স, বরিশাল, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি। এ ছাড়া রয়েছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ও শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল টেকনোলজি, জামালপুর। সড়কের নামকরণ করা থেকেও বাদ যায়নি শেখ হাসিনার নাম। শেখ হাসিনা রোড চট্টগ্রাম এবং অন্যটি মাদারীপুর শেখ হাসিনা মহাসড়ক। রংপুরে রয়েছে গঙ্গাচড়া হাসিনা সেতু। পটুয়াখালী ও কক্সবাজারে রয়েছে হাসিনার নামে দুটি সামরিক স্থাপনা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে নেত্রকোনা, খুলনা ও কিশোরগঞ্জের তিনটি, যেগুলোর নামকরণ করা হয়েছে শেখ হাসিনার নামে। একটি পরিবারের নামে দেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের এই নামকরণের ইতিহাস বিশ্বের কোনো দেশে পাতি পাতি করে খুঁজলেও তার নজির মিলবে না। তিনি বড় গর্বভরে উচ্চারণ করতেন, ‘এই দেশটি স্বাধীন করেছেন আমার বাবা, কাজেই পৈতৃক সূত্রে দেশের মালিক আমি।’
তার সেই চেতনাকে শাণিত করেছিলেন তার আশপাশে থাকা সব দুর্নীতিবাজ রাঘব বোয়াল, দুর্নীতিবাজ আমলা এবং দুর্নীতিবাজ দলীয় চামচারা। যার কারণে শেখ পরিবারের এমন ভরাডুবি!! শুধু শেখ পরিবারই নয়, ৭০ বছরের পুরোনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ একদিন মুসলিম লীগের মতো ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে, এ বিষয়েও সচেতন সমাজ বলাবলি করা শুরু করে দিয়েছেন এখন।