এ বছরের গোড়ার দিকে রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট পদের প্রাইমারি নির্বাচনের তিন-চার মাস আগে একটি পারিবারিক ইভেন্টে মার্কিন রাজনীতি নিয়ে আলোচনার একপর্যায়ে আমার এক প্রিয়ভাজন ছোট ভাই জানায়, নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দূরে থাক, প্রাইমারিতেই ট্রাম্প জিততে পারবেন না। পরে ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাসকারী আমার এক শ্রদ্ধেয় বড় ভাই, যিনি ট্রাম্পকে প্রাইমেট (Primate) জাতীয় প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করে থাকেন, তিনিও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়লাভের আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানান। সম্ভবত ট্রাম্পের অসাবধানী কথাবার্তা ও অস্থির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য (erratic Character and persona) এবং ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল ভবন হামলায় তার যুক্ত থাকার বিষয়ে জনমনে সৃষ্ট অসন্তোষের কথা ভেবেই তারা ওই অভিমত দেন। বলা বাহুল্য, তাদের দুজনের ভবিষ্যদ্বাণীই ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
রিপাবলিকান প্রাইমারিতে এক ডজনের বেশি প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধরাশায়ী করে ট্রাম্পের বিপুল বিজয় তো হয়ই, ৫ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসও তার কাছে একরকম গো-হারা হারেন। তার বিজয়কে অনায়াসে ভূমিধস বিজয় বলা যায়। বিজয়ের জন্য ২৭০ ইলেক্টোরাল ভোটের প্রয়োজন হলেও ট্রাম্প পান ৩১২ ভোট। কমলা হ্যারিস পান ২২৬ ভোট। পপুলার ভোটেও তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে কমবেশি এক মিলিয়ন বেশি ভোট পান। কংগ্রেসের উভয় কক্ষেও রিপাবলিকানদের জয় হয়। তার এহেন চমকপ্রদ বিজয় দেখে কেউ কেউ তাকে সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে অসাধারণ একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে বর্ণনার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সাতটি ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেটের সব কটিতেই ট্রাম্প জয় পান, যদিও সেসব স্টেটের ছয়টিতে ডেমোক্র্যাটিকরা গভর্নর পদে আসীন ছিলেন। আইনসভাও ছিল ডেমোক্র্যাটদের নিয়ন্ত্রণে।
নির্বাচনে কমলা হ্যারিসের বিপুল পরাজয় নিয়ে বিভিন্ন মহল, বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটিক শিবিরে হালে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে; যেটাকে অনেকে Pointing I Soul Searching বলে উল্লেখ করেছেন। পরাজয়ের জন্য অন্যের ওপর দোষারোপ ও আত্মবিশ্লেষণ-এসব আলোচনা-পর্যালোচনায় উঠে আসতে দেখা যায়।
ডেমোক্র্যাটরা হরহামেশা ট্রাম্পকে গণতন্ত্রের দুশমন, ফ্যাসিস্ট, হিটলারতুল্য নাজি ও একজন কনভিক্টেড ফেলন (Convicted Felon) ইত্যাদি নানা বিশেষণে ভূষিত করার পরও মার্কিন জনগণ কীভাবে এ রকম একজন জঘন্য ব্যক্তির হাতে দেশ পরিচালনার মহান ও গুরুদায়িত্ব তুলে দিল, তা ভেবে তাদের অনেককে রীতিমতো পেরেশান হতে দেখা যাচ্ছে। ডেমোক্র্যাট নেতাকর্মীরা ছাড়াও লিবারেল মেইনস্টিম মিডিয়ায় বর্তমানে এ নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় হচ্ছে, যেটাকে এক প্রকার মাতম বলা যায়। এসব মিডিয়া কমলা হ্যারিসকে বিজয়ী করতে বিগত কয়েক মাস ধরে বিরামহীনভাবে কমলার গুণকীর্তন ও ট্রাম্পবিরোধী ব্যঙ্গ-বিদ্রপাত্মক প্রচার-প্রচারণায় লিপ্ত ছিল। প্রভাবশালী লিবারেল সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্ট, এলএ টাইমস ও ইউএসএ টুডে নির্বাচনে নিরপেক্ষতা বজয় রাখার অজুহাত তুলে এবারের নির্বাচনে কাউকে এনডোর্স না করলেও এসব পত্রিকায় লাগাতার ট্রাম্পবিরোধী প্রচার-প্রচারণার কমতি ছিল না। নিউইয়র্ক টাইমস অবশ্য কোনো রাখঢাক ছাড়াই ‘The only Perfect Choice for America’ শিরোনামে নিবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে কমলা হ্যারিসকে এনডোর্স করে। এ ছাড়া এই পত্রিকায় প্রায় প্রতিদিন ট্রাম্পবিরোধী খবরাখবর, বিশ্লেষণ ও নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়। প্রায় সব টিভি চ্যানেলের টক শো ও লেট নাইট শোতে জিমি ফ্যালন, জিমি কিমেল, স্টিফেন কোলবোয়ার প্রমুখের মতো কমেডিয়ান নিরন্তর ট্রাম্পকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রপে ছিলেন, যা নির্বাচন-পরবর্তী সময়েও বহাল রয়েছে। কমলা হ্যারিসের পক্ষে শোবিজের বহু তারকাকে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিতে দেখা যায়, যাদের মধ্যে ছিলেন টেইলর সুইফট, বিয়ন্সে, অপরাহ উইনফ্রে, কার্ডি বি, কেটি পেরি, ব্রুস স্প্রিংস্টিন প্রমুখ। এ জন্য তাদেরকে বড় অঙ্কের অর্থ প্রদান করা হয় বলে জানা যায়। কিন্তু কমলার মন্দ ভাগ্য, এসবের কোনো কিছুই তার জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে ব্যর্থ হয়।
কমলা হ্যারিসের পরাজয়ের পেছনে যেসব কারণ কাজ করেছে, সে সম্পর্কে বিভিন্ন মহল ও মিডিয়ায় বিস্তর আলোচনা হওয়ায় তা নিয়ে আর তেমন কিছু বলছি না।
বিভিন্ন মহল ও ডেমোক্র্যাটরা প্রকৃত জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু (যেমন অর্থনীতি, বর্ডার) বাছাই করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পাশাপাশি ইদানীং যে বিষয়টিকে কমলার পরাজয়ের পেছনে বড় কারণ বলে মনে করছেন, সেটা হলো নির্বাচন থেকে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সরে যেতে খুব বেশি দেরি করার ঘটনা। তিনি আরও অনেক আগে সরে গেলে দলের প্রাইমারি নির্বাচন থেকে জনগণ তাদের একজন পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে বেছে নিতে পারতেন। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে দেরি করায় কমলা হ্যারিস ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীকে বেছে নেওয়ার সুযোগ না থাকায় দলকে পরাজয়ের গ্লানি নিতে হয়। তা ছাড়া দেরির কারণে কমলা হ্যারিসও নির্বাচনের ময়দানে মাত্র তিন মাস সময় পেয়েছেন, যা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মতো একটি বিশাল ক্যাম্পেইনের জন্য যথেষ্ট ছিল না। আবার কেউ কেউ সেক্সিজম (Sexism) ও রেসিজমকে (Racism) তার পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। কমলা হ্যারিস কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা হওয়ায় তিনি বর্ণবাদের শিকার হন। তা ছাড়া বহু পুরুষ ভোটার একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে দ্বিধান্বিত ছিলেন বলে বলা হয়। এসব ভোটারের কেউ কেউ এখনো নারীর উপযুক্ত স্থান রান্নাঘর বলে মনে করে থাকেন।
বহু ডেমোক্র্যাট ও মহল নির্বাচনে পরাজয় সত্ত্বেও ট্রাম্পের সম্ভাব্য গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের (Mass Deportation, গুরুত্বপূর্ণ পদে বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়োগ ইত্যাদি) বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম (Resistance) অব্যাহত রাখার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ট্রাম্প যদি দেশ ও গণতন্ত্রবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন বা হওয়ার চেষ্টা করেন, তবে অবশ্যই তার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ হওয়া প্রয়োজন। তবে সেটা করতে গিয়ে দেশে যাতে কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখা প্রয়োজন। সেটা হলে ডেমোক্র্যাটদের জন্য তা ক্ষতি ছাড়া লাভের কিছু হবে না। গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন মহলে বিদ্যমান অতিরিক্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাম্য নয়। এ সম্পর্কে জনৈক রাজনৈতিক ভাষ্যকারের একটি বক্তব্যকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা সমীচীন হবে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। রাজনৈতিক ভাষ্যকারের বক্তব্য হলো, ‘Our Democracy is alive and well. It is not Fragile. It will Survive any Presidency. It is designed to do so.’
লেখক : কলামিস্ট