আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আবহমানকাল থেকে বাংলা ভূখণ্ডে নানা জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্মমতের অনুসারীরা পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে মিলেমিশে একত্রে বসবাসের মাধ্যমে সাম্প্র ায়িক বা আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির ঐতিহ্য সংহত রেখেছে।
সম্প্রতি আমরা লক্ষ করছি, হঠাৎ করেই যেন হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার লক্ষ্যে একটি মহল আবার সোচ্চার হয়েছে। একটি মহল বিভিন্ন অজুহাতে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে।
প্রকৃত ইসলামের আকর্ষণীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসার জোর-জবরদস্তি এবং বল প্রয়োগে নয়, বরং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির দ্বারা মানুষের হৃদয় জয় করার মাধ্যমে সম্ভব। বল প্রয়োগ করলে অন্যের অধিকার যেমন দেওয়া যায় না, তেমনি আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভও এর দ্বারা সম্ভব নয়।
কোনোক্রমেই এ ধারণার উদ্রেক করা ঠিক হবে না, ইসলাম প্রচারে তরবারি প্রয়োগের নির্দেশ রয়েছে। ধর্ম বিশ্বাসের বিস্তার ঘটাতে না তরবারি হাতে নেওয়া হয়েছিল আর না উগ্রতা। শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্যই কেবল তরবারি ব্যবহৃত হয়েছিল। এটাই সত্য, ইমানের বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে অবশ্যই এটি অর্থাৎ তরবারি কখনো ব্যবহৃত হয়নি। কারণ, ইমানি বিষয়গুলো তো মানব হৃদয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। ধর্মের টানে নিজেকে উৎসর্গ করতে হয়। মক্কার প্রথম ১৩ বছর মুসলমানদের জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। এমনকি মদিনায় হিজরত করার পরও শত্রুরা তাদের ওপর চড়াও হলে সম্পূর্ণ অসজ্জিত অবস্থায় থেকেও তাদেরকে ফিরতি যুদ্ধ করতে হয়েছে। চাপ প্রয়োগে মুসলমান হলে কেউ কি এমন কোরবানি করতে পারে?
অনেকে এই প্রশ্নও করে থাকে, ইসলাম অর্থ যদি শান্তিই হয়ে থাকে, তবে মুসলমানরা যুদ্ধ করেছে কেন? মুসলমানরা যুদ্ধ করার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল আত্মরক্ষা করা। শত্রুরা সর্বদা উত্ত্যক্ত করেছে, করেছে আগ্রাসী আক্রমণ আর মুসলমানরা আত্মরক্ষা করতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল নিরস্ত্র মুসলমানদেরকে যখন অবলীলায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন অহেতুক এই রক্তপাত ঠেকাতে এবং নির্মম নিষ্ঠুরতার শাস্তি দিতে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আরবদের রীতি ছিল এটা, আর শান্তি বজায় রাখতে এর অবশ্য প্রয়োজনও ছিল এবং সে ধারা আজও সর্বত্র স্বীকৃত। তৃতীয়ত, যুদ্ধ করা হলে তা করা হবে বিরোধীদের দুর্বল করতে, কেননা তারা একত্রিত হচ্ছে মুসলমানদের নির্মূল করতে, শুধু এ কারণে যে তারা এক আল্লাহর ইবাদত করে। এ অবস্থায় যুদ্ধ করা না হলে কাফেররা একজন মুসলমানকেও বাঁচতে দিত না। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে তারা মঠ, মন্দির, গির্জা, সিনেগগ এবং মসজিদগুলোকে ধূলিসাৎ করবে আর নির্মম নিষ্ঠুরতা ক্রমেই বেড়ে চলবে।’ (সুরা হজ, আয়াত : ৪০)
তবে এটা ঠিক, মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে যুদ্ধের প্রয়োজন কখনো ছিল না। ইতিহাস এই সাক্ষ্যই বহন করছে, মুসলমানরা কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে গেলেও কোনো একজনকেও মুসলমান হতে কখনো বাধ্য করা হয়নি। প্রত্যেক ব্যক্তিরই ইবাদতের স্বাধীনতা আছে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মহানবী (সা.) সুনির্দিষ্ট করে বলে দিতেন, ‘বয়োবৃদ্ধদের, নারীদের এবং শিশুদের অনিষ্ট করবে না আর উপাসনালয়ের ক্ষতি সাধন করবে না।’ এমনকি বৃক্ষরাজি পর্যন্ত তিনি কর্তন করতে নিষেধ করেছেন।
মুসলমান দেশগুলোতে খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মাবলম্বীরা যাতে তাদের অধিকার সঠিকভাবে ভোগ করতে পারে, সে জন্য অমুসলমানদের থেকে ‘জিজিয়া’ অর্থাৎ ‘নিরাপত্তাঝুঁকি কর’ নেওয়া হতো। আর কারও যদি তা দেওয়ার সামর্থ্য না থাকত, তবে তা আদায় করা থেকে তাকে অব্যাহতিও দেওয়া হতো।
ইসলামে মুসলমান ও অমুসলমানের সম-অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ইসলাম শত্রুদের সঙ্গেও দয়ার্দ্র আচরণ করে, তা শান্তিকালীন সময়েই হোক বা যুদ্ধাবস্থায়ই হোক। সর্বাবস্থায় ইসলাম অমুসলমানদের অধিকার মর্যাদার সঙ্গে সংরক্ষণ করে। বিদ্বেষ ছড়ানো ও আক্রমণের অধিকার ইসলামে নেই। চড়াও হওয়া বা আক্রমণ করার অধিকার ইসলামে নেই। ইসলামের বাস্তব শিক্ষা হলো, কেবল আক্রান্ত হলেই তুমি যুদ্ধ করতে পারো।
অধিকন্তু ইসলামে এ নির্দেশও রয়েছে, আক্রমণকারী বা আগ্রাসী হয়ো না, চুক্তি ভঙ্গকারী হয়ো না। আগ্রাসন বলতে কী বোঝায়? সে যুগে ইসলামবিরোধীরা পরাজিত সৈন্যদের দেহ ছিন্নভিন্ন করে বিকৃত করত, এটা সমরনীতির পরিপন্থী, জিঘাংসামূলক অত্যন্ত গর্হিত এক কর্ম। ইসলামে এটি নিষিদ্ধ। শিশু ও নারীদের হত্যা করাও নিষিদ্ধ। ধর্মীয় নেতাদের পাদরি-পুরোহিত, রাব্বি প্রমুখকে তাদের উপাসনালয়ে হত্যা করা সম্পূর্ণ অবৈধ। অন্য কথায়, যুদ্ধ কেবল সমরক্ষেত্রেই সংঘটিত হতে পারে। অথবা অন্য কোনো বিকল্প খুঁজে না পেয়ে যদি শহর বা নগরে যুদ্ধ করতে বাধ্যও হতে হয়, তবু কেবল তাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করা যেতে পারে, যারা বিরোধিতায় আগ বাড়িয়ে অস্ত্র ধারণ করে আক্রমণ চালিয়েছে।
আজ আমরা যা লক্ষ করছি, তা হলো সুন্দর, সাবলীল ও সুগঠিত এসব ইসলামি শিক্ষার ওপর কোনো দলই আমল করছে না। বিভিন্ন দেশে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীরা শিশু, নারী, বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাইকে হত্যা করছে। অপরদিকে আগ্রাসী বাহিনী শহর-নগর-বন্দরে বোমা বর্ষণ করছে, গুলি চালাচ্ছে, করছে অতর্কিত আক্রমণ। তারা নগরগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে নগর অবকাঠামো সমূলে বিনাশ করছে। এতে নাগরিক অধিকারের কিছুই আর অবশিষ্ট থাকছে না।
প্রতিটি বৃহৎ শক্তিই এখন পারমাণবিক বিপুল অস্ত্রসম্ভারের অধিকারী, এমনকি দরিদ্র দেশগুলো পর্যন্ত অস্ত্রসম্ভার মজুতকরণের এই দৌড়ে শামিল হচ্ছে। মানবজাতি একেবারে ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে গেছে। যেখানে কি না পবিত্র কোরআন আমাদেরকে নিরপরাধ, নিরীহদের কোনো ক্ষতি না করার শিক্ষা দেয়, সেখানে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ তাৎক্ষণিকভাবে জানমালের বিপুল ক্ষতি সাধন করা ছাড়াও শারীরিক প্রতিবন্ধিতা ঘটায়, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলতেই থাকে। সুতরাং এটা তো হত্যা করার চেয়েও জঘন্য অপরাধ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা ব্যবহৃত হওয়ার পর মানুষ ভেবেছিল, বিশ্ব এমন এক মারাত্মক মারণাস্ত্র বানানো থেকে হয়তো বিরতই থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সেসব অস্ত্রের প্রাণসংহারী ক্ষমতা বাড়াতে তারা আরও এগিয়ে গেছে। আর নিশ্চিতভাবেই বিশ্ব সামগ্রিক ধ্বংসলীলা সাধনকারী মারণাস্ত্রের উন্নত সংস্করণ উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতার দৌড়ে ছুটেই চলছে।
মূলত একজন মুসলমানের বিনা কারণে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার অনুমতি নেই, যদি না তা এমন লোকদের বিরুদ্ধে হয়, যারা আল্লাহর দ্বীন পালনে ও প্রচারে বাধা দেয় অথবা বিশ্বে শান্তি-বিনাশের কারণ হয়। শান্তি বজায় রাখতে এটা অনুপম সৌন্দর্যমণ্ডিত শিক্ষা নয় কি? চরমপন্থী মতাদর্শের কোনো স্থান এখানে নেই। এত সব নমুনা ও আদর্শ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আপত্তি হলো পবিত্র কোরআন ও মহানবী (সা.) চরমপন্থা অবলম্বন করা আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটানোর শিক্ষাও দেয়, নাউজুবিল্লাহ।
আসলে আজ আমরা মহানবীর সম্প্রীতির শিক্ষা ভুলে উগ্রতার পথ বেছে নিয়েছি। মহানবীর (সা.) মৃত্যুর অল্প দিন আগে বিদায় হজের সময় বিরাট ইসলামি সমাগমকে সম্বোধন করে তিনি (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদি পিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনোমতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের ওপর একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়, কালোও সাদার চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে বিচার্য বিষয় হবে, কে আল্লাহ ও বান্দার হক কতদূর আদায় করল। এর দ্বারা আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মপরায়ণ।’ (বায়হাকি) এই মহান শব্দগুলো ইসলামের উচ্চতম আদর্শ ও শ্রেষ্ঠতম নীতিমালার একটি দিক উজ্জ্বলভাবে চিত্রায়িত করেছে। শতধা বিভক্ত একটি সমাজকে অত্যাধুনিক গণতন্ত্রের সমতাভিত্তিক সমাজে ঐক্যবদ্ধ করার কী অসাধারণ উদাত্ত আহ্বান।
যারা আজ সামাজিক পরিমণ্ডলে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে, রক্তপাত ঘটানোর আহ্বান করে, ধ্বংসযজ্ঞ ও নৈতিকতা-বর্জিত কর্মকাণ্ড চালায়, তারা কখনো সমাজের শান্তিপ্রিয় নাগরিক হতে পারে না। বাংলাদেশের সংস্কৃতি সহস্রাব্দ প্রাচীন, বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ। ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো দেশের সংস্কৃতিকে পছন্দ নাও করতে পারি, তাই বলে এ নিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলার কোনো অনুমতি ইসলাম আমাকে দেয় না। আমাদের এই দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ, এখানে কোনোরূপ সন্ত্রাস ও জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত কোনো অপশক্তির স্থান নেই আর হাজার বছরের সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে কোনোভাবেই বিনষ্ট করার সুযোগও নেই।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।